যুদ্ধবিরতির নামে ‘উচ্ছেদ’ কি গাজায় ট্রাম্প–নেতানিয়াহুর নতুন কৌশল
এদিকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় ইসরায়েল হামলা অব্যাহত রেখেছে। উপত্যকাটিতে এ পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৫৭৫ জনের বেশি নিহত হয়েছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্প যদি সত্যিই গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চান, তাঁকে ইসরায়েলকে দেওয়া মার্কিন সামরিক সহায়তা কাজে লাগিয়ে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ব্রায়ান ফিনুকেন ট্রাম্পের বার্তাকে তাঁর পূর্বসুরি জো বাইডেনের দ্ব্যর্থপূর্ণ বার্তার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ফিনুকিন বলেন, দুজনই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিলেন; কিন্তু যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েলকে চাপ দিতে তাঁরা অনিচ্ছুক।
ফিনুকেন বলেন, ‘এ যেন বাইডেন প্রশাসনের পুরোনো দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি। আপনি হোয়াইট হাউস থেকে একই ধরনের ঘোষণা শুনবেন; কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যপট বদলায় না। যুদ্ধবিরতিই যদি সত্যি হোয়াইট হাউসের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হয়, তবে তা কার্যকর করার জন্য তাদের যথেষ্ট চাপ প্রয়োগের ক্ষমতাও আছে।’
যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দেয় এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনৈতিকভাবে তাদের পক্ষ নেয়।
যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা চলতি সপ্তাহে গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন। এটা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। তবে ওয়াশিংটনে নেতানিয়াহু সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গাজায় কাজ এখনো শেষ হয়নি। হামাসকে নির্মূল করতেই হবে।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক আইনজীবী ফিনুকেন নেতানিয়াহুর এ মন্তব্যকে ‘খুবই বাগাড়ম্বরপূর্ণ’ ও ‘অস্পষ্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ট্রাম্প চাইলে ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাপ দিতে পারেন। সামরিক সহায়তা স্থগিত করার হুমকিও ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে এবং প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক সাফল্য অর্জনের জন্যও সহায়ক।
ট্রাম্প–নেতানিয়াহুর একই সুর
নেতানিয়াহু গত সোমবার ওয়াশিংটনে পৌঁছানোর পর ট্রাম্পের সঙ্গে একজোট হয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য ‘বিজয় উদ্যাপন’ করেছেন।
শুরু থেকেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের অহমিকাকে তুষ্ট করার কৌশল নেন। ওই দিন রাতে হোয়াইট হাউসের নৈশভোজে বসে তিনি ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন বলে ঘোষণা করেন।
পরদিন মঙ্গলবার এ দুই নেতা আবারও সাক্ষাৎ করেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, তাঁদের আলোচনা গাজা ও যুদ্ধবিরতি নিয়ে। এর এক দিন পর নেতানিয়াহু বলেন, তাঁরা গাজা নিয়ে পুরোপুরি ‘একমত’।
নেতানিয়াহু বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি সমঝোতা চান; তবে যেকোনো মূল্যে নয়। আমিও একটি সমঝোতা চাই; কিন্তু যেকোনো মূল্যে নয়। ইসরায়েলের নিরাপত্তা চাহিদা আছে এবং আমরা একসঙ্গে তা সমাধানের চেষ্টা করছি।’
মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্র্যাফটের রিসার্চ ফেলো অ্যানেল শেলিন বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির পথে প্রধান বাধা প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল। হামাস ইতিমধ্যে যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তির দাবি জানিয়েছে, যেটা ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে।’
অ্যানেল শেলিন বলেন, ‘ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির কথা বললেও এখনো পর্যন্ত আমরা দেখিনি যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব কাজে লাগিয়ে তা কার্যকরের জন্য চাপ দিচ্ছেন।’
বরং ট্রাম্প প্রশাসন গর্ব করে বলছে, তারা ভারী বোমার চালান আবারও চালু করেছে। এটি বাইডেন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছিলেন।
গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি
যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চললেও গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে।
হাসপাতালগুলোর জ্বালানি ফুরিয়ে যাচ্ছে, প্রতিরোধযোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, খাদ্যসংকট চরমে উঠেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বেসরকারি ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে খাদ্য নিতে গিয়েও শত শত ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের গুলিতে নিহত হচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈদেশিক নীতি গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির (সিআইপি) সভাপতি ন্যান্সি ওকাইল বলেন, ট্রাম্প গাজা যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে; কারণ তিনি শান্তিরক্ষী হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি বাড়ানো ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে চান।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ট্রাম্প ইরাক ও আফগান যুদ্ধের পর মার্কিনদের ক্লান্তির কথা বলে বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত তিনি ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি ইসরায়েল–ইরান সংঘাতের তত্ত্বাবধান করেছিলেন; এমনকি এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এতে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ওকাইল বলেন, শুধু মৌখিকভাবে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে গাজায় নৃশংসতা বন্ধ করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘যদি এর সঙ্গে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, যেমন ইসরায়েলকে সাহায্য বা অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করা; তবে নেতানিয়াহুর শান্তি আলোচনায গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।’
নেতানিয়াহুর বাস্তুচ্যুতির কৌশল
৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি যদি কার্যকরও হয়, তবু অধিকারকর্মীরা উদ্বিগ্ন। কারণ, সে সময় হয়তো ইসরায়েল গাজাবাসীকে বিতাড়িত ও দখলদারত্ব আরও ব্যাপক করতে চাইবে।
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বুধবার জানিয়েছে, তারা প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ১০ জন ইসরায়েলি বন্দীকে মুক্তি দিতে রাজি। তবে এখনো মূল অচলাবস্থা গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা নিয়ে।
ইসরায়েলের হারেৎস পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ দক্ষিণ গাজায় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বন্দিশিবির তৈরির পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল ‘বহির্গমন পরিকল্পনা’ (ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন) কার্যকর করতে চায়।
মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এটি জাতিগত নির্মূলের শামিল ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।
গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার এ ধারণা নতুন নয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলের উগ্রপন্থী মন্ত্রীরা তা প্রকাশ্যে বলে আসছেন। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ (অবকাশকেন্দ্র বা সাগরসৈকতের শহর) বানানোর স্বপ্নের কথা বলার পর বিশ্বসম্প্রদায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে শুরু করে।
নেতানিয়াহু এবার সফরের সময়ও বলেছেন, ‘গাজার মানুষ চাইলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে।’
জবরদস্তিমূলক স্থানান্তর
যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এ সপ্তাহে গাজায় জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পনার প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়নি, তবে হোয়াইট হাউস থেকে বক্তব্য এসেছে—ফিলিস্তিনিদের আর গাজায় থাকার উপায় নেই।
ট্রাম্পের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ জায়গা এখন মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে এবং প্রেসিডেন্টের হৃদয় অনেক বড়। তিনি চান, এটি একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ অঞ্চল হোক; যেখানে পরিবারগুলো উন্নতি করতে পারে।’
তবে অধিকারকর্মীরা জোর দিয়ে বলছেন, বোমাবর্ষণের মধ্যেও মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ না থাকা মানুষের থাকার কিংবা স্থান ত্যাগ করার ‘স্বাধীন’ পছন্দ থাকতে পারে না।
অ্যানেল শেলিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশঙ্কা, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু গাজায় জাতিগত নির্মূল ও সেখানকার বাসিন্দাদের অন্যত্র স্থানান্তর করার জন্য কাজ করছেন।’
শেলিন আরও বলেন, ‘অনেকেই ধারণা করেছিলেন, হয়তো ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সহায়তার বিনিময়ে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্প চাপ প্রয়োগ (ইসরায়েলের ওপর) করবেন; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তিনি যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে গাজাবাসীকে জোর করে বিতাড়িত করতে চাইছেন।’
ওকাইল বলেন, বোমাবর্ষণ ও অনাহারের হুমকিতে মানুষকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করার মানে তাঁদের বন্দুকের মুখে তাড়িয়ে দেওয়া। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির নামে যদি দখলদারি বাড়ানো ও জাতিগত নির্মূলই হয় তাদের উদ্দেশ্য, তবে তারা আদৌ কোনো যুদ্ধবিরতি চায় না; বরং সেটি ধ্বংস করতে চায়।’
![]() |
| ফিলিস্তিনি মা সামাহ আল-নুরি গতকাল বৃহস্পতিবার দেইর আল-বালাহর একটি চিকিৎসাকেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি হামলায় মেয়েকে হারিয়েছেন। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তিনি। ছবি: রয়টার্স ফিলিস্তিনের গাজায় গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৮২ জন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আলোচনা ও রাফায় ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর করার ইসরায়েল–মার্কিন পরিকল্পনা নিয়ে সমালোচনা চলার মধ্যে গতকাল ভোর থেকে এসব হামলা হয়। এদিকে এই ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জন দেইর আল-বালাহ এলাকায় খাবার সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। এর মধ্যে ৯টি শিশু আর ৪ জন নারী। এ হামলায় আরও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৯টিই শিশু। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সহায়তা নিতে আসা পরিবারগুলোর সদস্যদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা একেবারেই অমানবিক। ক্যাথরিন আরও বলেন, গাজায় এখন যা ঘটছে, সেটারই নির্মম বাস্তবতা হলো এই ঘটনা। মাসের পর মাস ধরে এখানে যথেষ্ট সাহায্য ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আর সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিতে মৌলিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ক্যাথরিনের মতে, ত্রাণসহায়তার ঘাটতি থাকার মানেই হলো শিশুরা অনাহারে ভুগছে। আর তাতে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিও বাড়ছে। পুরোদমে যদি সহায়তা ও সেবা নিশ্চিত না করা যায়, তবে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এ হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন পুরোপুরি মেনে চলতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ক্যাথরিন। এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসও। তারা বলেছে, এটি গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ‘চলমান জাতিহত্যা অভিযানের অংশ’। এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, ‘ইসরায়েল এখন স্কুল, রাস্তা, আশ্রয়কেন্দ্র ও বেসামরিক এলাকায় নিরীহ মানুষের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব হামলা একেবারে পরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে; যা পুরোদমে জাতিগত নির্মূল অভিযানের শামিল। আর এ অপরাধ পুরো বিশ্বের চোখের সামনেই ঘটছে।’ |

No comments