গাজায় কেউ না খেয়ে নেই—দাবি নেতানিয়াহুর, দ্বিমত ট্রাম্পের
তবে গাজায় কেউ অনাহারে না থাকার নেতানিয়াহুর এ দাবির সঙ্গে একমত হতে পারেননি তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উপত্যকাটির অস্থিচর্মসার মানুষের যেসব ছবি প্রকাশ পাচ্ছে সেগুলোর কথা উল্লেখ করে গতকাল সোমবার তিনি বলেন, ‘ওই শিশুদের খুবই ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গাজায় ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণসহায়তা প্রবেশের সুযোগ করে দিতে ইসরায়েল এ সপ্তাহান্তে সেখানে মানবিক বিরতি ঘোষণা করেছে। আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলা ও অন্যান্য উদ্যোগের ঘোষণাও এসেছে।
কিন্তু বাস্তবে সেখানে পরিস্থিতির খুবই সামান্য বা একেবারেই পরিবর্তন হয়নি বলে জানাচ্ছেন গাজার বাসিন্দারা।
জাতিসংঘ বলেছে, ত্রাণসহায়তা বৃদ্ধির এ উদ্যোগ এক সপ্তাহ ধরে চলবে। তবে ইসরায়েল এখনো তাদের এ ব্যবস্থা কত দিন জারি থাকবে সে বিষয়ে কিছু জানায়নি।
ইসরায়েল আকাশ থেকে গাজায় ত্রাণ ফেলেছে—এমন একটি স্থানে উপস্থিত ছিলেন হাসান আল-জালান। তিনি বলেন, ‘এভাবে ত্রাণ দেওয়া ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য অবমাননাকর।’ যেখানে ত্রাণ ফেলা হচ্ছে সেখানে মানুষ ত্রাণের জন্য লড়াই করছে। ওপর থেকে ছোলাভর্তি ক্যানগুলো মাটিতে পড়ে ভেঙে ভেতরের সব ছড়িয়ে–ছিটিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ইসরায়েলের দাবি, হামাসের কারণে গাজায় ফিলিস্তিনিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। তাদের অভিযোগ, হামাস সদস্যরা ত্রাণ লুট করে নিজেদের কাছে নিয়ে নিচ্ছেন এবং গাজায় নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সেগুলো ব্যবহার করছেন।
অবশ্য বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘও গাজায় পরিকল্পিতভাবে ত্রাণ লুট হওয়ার ইসরায়েলি অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বরং জাতিসংঘ বলেছে, গাজায় যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিলে লুটপাট কমে যাবে বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।
অনাহারে মৃত্যু বাড়ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) রোববার বলেছে, এ মাসে গাজায় অনাহারে ভুগে ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৪ শিশু রয়েছে। এ বছরের প্রথম ৬ মাসে উপত্যকাটিতে অনাহারে ১১ জন মারা গেছেন। সে তুলনায় এক মাসে ৬৩ জনের মৃত্যু উদ্বেগজনক রকম বেশি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলে উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, এ মাসে গাজায় অনাহার ও অপুষ্টিতে ভুগে ৮২ জন মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে ২৪টি শিশু ও ৫৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক।
গতকাল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আরও বলা হয়, বিগত ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সেখানে যুদ্ধের মধ্যে হতাহতের প্রকৃত তথ্য পাওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস বলে বিবেচনা করে জাতিসংঘ।
দ্য পেশেন্টস ফ্রেন্ডস হাসপাতাল গাজার উত্তরাঞ্চলে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য প্রধান জরুরি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। হাসপাতালটি থেকে বলা হয়েছে, এ মাসে তারা প্রথমবারের মতো অনাহারে এমন শিশুদের মৃত্যু দেখছে, যারা আগে অসুস্থ ছিল না।
অনাহারে মারা যাওয়া কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ বা কিডনির রোগে ভুগছিলেন। দীর্ঘদিন অনাহারে থাকার কারণে তাঁদের অসুস্থতা আরও গুরুতর হয়ে উঠেছিল বলে জানান গাজার চিকিৎসা কর্মকর্তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, উত্তর গাজায় অনাহারে চরম অপুষ্টির মাত্রা তিন গুণ বেড়েছে। সেখানে পাঁচ বছরের নিচে প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে প্রায় একজন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। মধ্য ও দক্ষিণ গাজায়ও অপুষ্টির মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে।
গাজায় মাত্র চারটি বিশেষায়িত কেন্দ্র রয়েছে; যেখানে অপুষ্টির চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘ বলেছে, সেগুলোতে ভিড় উপচে পড়ছে।
খাদ্যসংকট নিয়ে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন’ কয়েক মাস ধরে গাজায় দুর্ভিক্ষের সতর্কতা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইসরায়েল প্রবেশাধিকার সীমিত রাখায় সেখান থেকে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। তাই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা যাচ্ছে না।
গাজায় অপুষ্টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে, সতর্ক করল ডব্লিউএইচও
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে বলেছে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অপুষ্টির মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বিপজ্জনক গতিপথে রয়েছে।
দীর্ঘ বিরতির পর গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণসামগ্রী ফেলার কার্যক্রম আবার শুরুর পর ডব্লিউএইচওর কাছ থেকে এ সতর্কবার্তা এল।
গতকাল রোববার জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণসামগ্রী ফেলে। এর আগে ইসরায়েল জানায়, তারা গাজার কিছু অংশে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে যুদ্ধ বন্ধ রাখবে। যাকে তারা বলছে, ‘কৌশলগত বিরতি’। এ বিরতির আওতায় জাতিসংঘের ত্রাণবহরের জন্য করিডর তৈরি করে দেওয়ার কথাও জানায় তারা।
ইসরায়েলের দাবি, গাজাবাসীকে ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখার যে ‘মিথ্যা অভিযোগ’ উঠেছে, তা খণ্ডন করতেই এ বিশেষ ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলের ভাষ্য, হামাস ইচ্ছাকৃতভাবে এমন অভিযোগ তুলে বিশ্বের সামনে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে।
জর্ডানের সামরিক বাহিনী বলেছে, গাজাবাসীর জন্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে কাজ করছে। ইতিমধ্যে তারা উড়োজাহাজ দিয়ে তিন দফায় গাজায় ২৫ টন ত্রাণসামগ্রী ফেলেছে। এ ছাড়া মিসর হয়ে ত্রাণবাহী লরির একটি বহর গাজায় প্রবেশ করেছে। আরেকটি বহর ঢোকার কথা রয়েছে জর্ডান থেকে।
তবে গাজার মধ্যাঞ্চলে একটি ত্রাণবহর যে পথে অগ্রসর হচ্ছিল, তার পাশেই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৯ জন নিহত ও ৫৪ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এমনকি গত শনিবার যুদ্ধ সাময়িক বন্ধের বিষয়টি কার্যকরের এক ঘণ্টার মাথায় গাজার একটি আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল।
স্থানীয় সূত্রগুলো বিবিসিকে জানিয়েছে, গাজার মধ্যাঞ্চলের নেতজারিন করিডরের সালাহ আল-দিন সড়কে জাতিসংঘের ত্রাণবহরের অপেক্ষায় বহু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। সেখানেই গুলির ঘটনা ঘটে। হতাহত ব্যক্তিদের নুসাইরাতের আল-আওদা হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে জানান হাসপাতালটির একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তাদের সেনাদের দিকে কিছু সন্দেহভাজন ব্যক্তি এগিয়ে আসছিলেন। তাই সেনারা সতর্কবার্তা হিসেবে গুলি ছোড়েন। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়েছেন কি না, সে বিষয়ে তারা কিছু জানে না।
অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণসহায়তা প্রবেশ করতে না দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তীব্র আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে ইসরায়েল। এর মধ্যে গাজায় চরম খাদ্যসংকট ও অনাহারের ঘটনা নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। এ চাপে পড়ে ইসরায়েল এখন কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, গাজার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কয়েক দিন ধরে না খেয়ে দিন পার করছে। আর প্রতি চারজনের একজন দুর্ভিক্ষসদৃশ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণ ফেলা চরম দুর্ভোগ লাঘবে সহায়ক হবে। তবে গাজায় ত্রাণসহায়তা পাঠানোর একমাত্র কার্যকর ও টেকসই উপায় হলো স্থলপথ।
গাজায় যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। তিনি বলেছেন, প্রতিদিন গাজায় আরও ধ্বংস, আরও হত্যাকাণ্ড ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরও অমানবিকতা চলছে।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর প্রশাসন গাজায় আরও ত্রাণ পাঠাবে। তবে তিনি এ কথাও বলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা নয়।
| গাজায় তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা একটি শিশু। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফাইল। ছবি: এএফপি ও রয়টার্স |
No comments