দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘে সম্মেলন শুরু আজ: গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল -দুই মানবাধিকার সংস্থা
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন বিভক্ত করার প্রস্তাব তোলা হয়। পরে ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল এবং আরবদের জন্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলকে রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। দশকের পর দশক ধরে জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের সমর্থন জানিয়ে আসছে। তবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এএফপির তথ্য অনুযায়ী, জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে ফ্রান্সসহ ১৪২টিই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ তালিকায় যুক্তরাজ্যও যোগ দেবে বলে আশা ফ্রান্সের। কারণ, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে চিঠি দিয়েছেন ২২১ ব্রিটিশ আইনপ্রণেতা। জবাবে স্টারমার বলেছেন, এই স্বীকৃতি অবশ্যই বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হতে হবে।
জাতিসংঘের সম্মেলনে ইউরোপের আরও দেশ যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ নোয়েল ব্যারটও। এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষক রিচার্ড গোয়ান বলেন, দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বিষয় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার পথে ছিল। তবে ফিলিস্তিনকে ফ্রান্সের স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণার পর জাতিসংঘের এ সম্মেলনে প্রাণসঞ্চার হবে।
তবে ফিলিস্তিনের গাজায় ২১ মাস ধরে চলা ইসরায়েলের হামলা, দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের নতুন নতুন বসতি স্থাপন এবং দখল করা এলাকাগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার যে পরিকল্পনা কথা দেশটির কর্মকর্তারা তুলে ধরছেন, তাতে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান শেষ পর্যন্ত ভৌগলিকভাবে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
‘গাজায় অপুষ্টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে’
জাতিসংঘের সম্মেলন যখন শুরু হয়েছে, তখনো গাজায় নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৫৯ হাজার ৭৩৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন ১ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ। হতাহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় চরম আকার ধারণ করেছে খাদ্যসংকট। তবে রোববার থেকে অবরোধ কিছুটা শিথিল করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার কিছু অংশে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে হামলা স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে তারা। জাতিসংঘের ত্রাণবহরের জন্য করিডর তৈরি করে দেওয়ার কথাও জানিয়েছে। উড়োজাহাজে করে গাজায় ত্রাণসামগ্রী ফেলেছে জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অপুষ্টির মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। না খেতে পেয়ে আজও ১৪ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের একজন শিশু।
গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল: বলছে ইসরায়েলভিত্তিক দুই মানবাধিকার সংস্থা
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে ইসরায়েলভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় দুটি মানবাধিকার সংস্থা—বতসেলেম ও ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস। সংস্থা দুটি বলেছে, ইসরায়েলকে থামানো দেশটির পশ্চিমা মিত্রদের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব।
আজ সোমবার মানবাধিকার সংস্থা দুটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় বেসামরিক লোকজনের পরিচয় ফিলিস্তিনি হওয়ার কারণেই কেবল প্রায় দুই বছর ধরে তাঁদের নিশানা করছে ইসরায়েল। এর ফলে ফিলিস্তিনি সমাজে মারাত্মক—কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় নৃশংসতা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও ফিলিস্তিনি সংস্থা একে গণহত্যা বলে বর্ণনা করেছে। এবার ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুটি মানবাধিকার সংস্থা এ প্রতিবেদন দেওয়ার পর দেশটির ওপর চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে গাজায় ইসরায়েলের অপরাধের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার নারী, শিশু ও বৃদ্ধ ফিলিস্তিনিকে হত্যা; গণহারে বাস্তুচ্যুত করা এবং মানুষকে অনাহারে রাখা। এ ছাড়া ইসরায়েলের হামলায় ঘরবাড়িসহ বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংসের ফলে ফিলিস্তিনিরা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বতসেলেমের পরিচালক ইউলি নোভাক বলেন, ‘আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা স্পষ্ট—একটি গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।’ জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, সবাইকে নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে—গণহত্যার মুখে আপনি কী করবেন?’
ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস তাদের প্রতিবেদনে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর ইসরায়েলের হামলা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। অনেক হামলার তথ্য বিস্তারিত আকারে সংগ্রহ করে নথিবদ্ধ করেছে সংস্থাটির নিজস্ব দল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর আগে গাজায় নিয়মিত কার্যক্রম চালাত সংস্থাটি।
ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের পরিচালক গায় শালেভ বলেন, গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশনের ২(সি) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুধু স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চালানো ধ্বংসযজ্ঞই এই ‘যুদ্ধকে’ গণহত্যায় পরিণত করেছে। কোনো কিছুকে গণহত্যা বলার জন্য সনদের পাঁচটি অনুচ্ছেদের—সবকটি পূরণ করার প্রয়োজন নেই।
নিজেদের প্রতিবেদনে দুটি মানবাধিকার সংস্থাই বলেছে, ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররা দেশটির গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে। গাজায় মানুষের দুর্ভোগের জন্য তারাও যৌথভাবে দায়ী। ইউলি নোভাক বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তা ছাড়া এটি (গণহত্যা) সম্ভব হতো না। কোনো নেতাই এটি থামানোর জন্য নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো এত দিন পর্যন্ত যা করেছে, তার চেয়ে এখন তাদের জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার আইনি দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করেন গায় শালেভ। তিনি বলেন, ‘নিজেদের হাতে থাকা সব কৌশল কাজে লাগাতে হবে। নিজেদের চিন্তাভাবনা থেকে আমরা এই কথা বলছি না। এই আহ্বান গণহত্যা কনভেনশনেই জানানো হয়েছে।’
| দাতব্য রান্নাঘরের সরবরাহ করা খাবার সংগ্রহ করতে ফিলিস্তিনিদের ভিড়। আজ সোমবার গাজা নগরীতে। ছবি: রয়টার্স |
No comments