যে আমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অপূর্ব সুন্দরী নারীর গল্প by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

আমপ্রেমীদের কাছে অতিপ্রিয় একটি আম আম্রপালি। আঁশহীন সুমিষ্ট ও রসালো—এর মূল বৈশিষ্ট্য। এই আমের নামকরণের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের অপূর্ব সুন্দরী এক নারীর নাম জড়িয়ে আছে। সেই নারীর নাম আম্রপালি।

সেই গল্প জানতে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জ্যোতিস্বী চাকমার সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। ভারতের বৈশালী নগরের (এখনকার বিহারে নগরটি ছিল) আমবাগানে এক মেয়েশিশুর জন্ম হয়। তাকে লালন-পালন করেন সেই নগরের উদ্যানপালক। আমের বাগানে জন্ম এবং উদ্যানপালকের ঘরে লালিত-পালিত বলে শিশুটির নাম হয় আম্রপালি। আম্রপালি দেখতে যেমন সুন্দর ছিলেন, তাঁর নানা গুণও ছিল। তিনি ভালো গাইতে ও নাচতে পারতেন, বীণা বাজাতেন, পালি ভাষায় কবিতা লিখতেন। সভানর্তকী ছিলেন তিনি। রূপে-গুণে অনন্য আম্রপালি শেষজীবনে তাঁর সব ধনসম্পদ বিলিয়ে দিয়ে গৌতম বুদ্ধের শিষ্য হয়ে যান।

আম্রপালি নামকরণের পর এই জাতের আমের চারা প্রথম লাগানো হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। আম–গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, উত্তর ভারতের বিখ্যাত আমের জাত দোসেরির ফুলের পুরুষ পরাগ এবং দক্ষিণ ভারতের নীলমের স্ত্রী পরাগের সংকরায়ণের মাধ্যমে হয়েছে আম্রপালি।

ভারত থেকে আম্রপালি জাতের আমের চারা বাংলাদেশে আনা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (১৯৯৬-২০০১) এম এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) একজন কর্মকর্তা ভারতে গিয়ে আম্রপালির কিছু চারা নিয়ে আসেন। তিনি নিজে সেখান থেকে কয়েকটি চারা নিয়ে খামারবাড়িতে রোপণ করেন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ১৯৯৬ সালে আম্রপালি জাতকে বারি আম-৩ নামে অবমুক্ত করে। কৃষিবিদেরা জানিয়েছেন, বিদেশি জাতের দেশি সংস্করণের এই রীতিকে বলা হয় পরিচিতি বা ইন্ট্রোডাকশন। আম্রপালি অবমুক্তের পেছনে ছিলেন কৃষিবিদ কাজী বদরুদ্দোজা।

ইন্ট্রোডাকশন পদ্ধতি হলো বিদেশি কোনো উন্নত জাতের গাছ নিয়ে এসে এ দেশে কয়েক বছর পর্যবেক্ষণ ও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করা হয়। আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারলে সেটি আমের জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়। বাংলাদেশে আম্রপালির ক্ষেত্রে তা–ই করা হয়েছে।

বারির ফল বিভাগের ‘আমের জাত ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি’–বিষয়ক প্রকাশনা ২০২১-এ এ অঞ্চলের আমের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আম পৃথিবীর প্রাচীনতম ফলগুলোর একটি। প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে এই উপমহাদেশে আমের চাষ হয়। এশিয়ার দেশগুলোতেও ফল হিসেবে আমের গ্রহণযোগ্যতা আছে।

এখন থেকে আড়াই হাজার আগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ভারতের মালয় থেকে পূর্ব এশিয়ায় আমের চাষাবাদ ছড়িয়ে দেন। চীনের পর্যটক হিউয়েন সাং প্রথম পর্যটক হিসেবে ৬৩২ থেকে ৬৪৫ সালের মধ্যে চীন তথা দূরপ্রাচ্যে আমের পরিচিত তুলে ধরেন। এ ছাড়া আরব বণিক ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা আম ছড়িয়ে দেন বিশ্বের নানা জায়গায়।

বাংলাদেশের আনাচকানাচে এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় ৮০০ জাতের আম। আমের উন্নত ও উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবনে চলে গবেষণা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জমির উদ্দিন জানিয়েছেন, বারি এখন পর্যন্ত আমের ৩টি হাইব্রিড জাতসহ মোট ১৮টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ১৪টি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম গবেষণা থেকে, বাকি চারটি রাজশাহীসহ অন্যান্য ফল গবেষণাকেন্দ্র থেকে হয়েছে।

আম্রপালি আম
আম্রপালি আম। ছবি: প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.