অপারেশন সিঁদুর থেকে আমরা যা বুঝলাম by শশী থারুর
প্রথমেই বলা যায়, ভারত জোরালোভাবে আঘাত করলেও সবকিছু খুব হিসাব করে করা হয়েছিল। হামলাগুলো ছিল নির্দিষ্ট জায়গায়, শুধু টার্গেট করা স্থাপনায়। যেন সাধারণ মানুষের ক্ষতি না হয়, সে জন্য রাতের বেলা অভিযান চালানো হয়। অপারেশন সিঁদুর ছিল সামরিক দিক থেকে এক বড় সাফল্য।
পাকিস্তান হামলার সময় পুরোপুরি সজাগ ছিল। তারপরও ভারত তাদের প্রতিরক্ষা ভেঙে নির্দিষ্ট জায়গায় আঘাত হানে এবং কয়েকজন পরিচিত জঙ্গিকে হত্যা করে। পরে এই জঙ্গিদের জানাজায় পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারাও অংশ নেন।
এই অভিযানে ভারত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জায়গায় হামলা চালিয়েছে। তবে শুরুতে ভারত ইচ্ছা করেই পাকিস্তানের সেনাঘাঁটি বা সরকারি কোনো স্থানে হামলা করেনি। এর মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে, এটি যুদ্ধ নয়; বরং এটি জঙ্গি হামলার জবাব। কিন্তু পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিলে ভারতকেও আরও কঠোর হতে হয়।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ধরন এখন বদলে গেছে। আগে ভারত সামরিক পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করত, কিন্তু এখন সেই দ্বিধা আর নেই।
এত দিন ধরে কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার ভয়েই ভারত শুধু কূটনৈতিক পথে এগোচ্ছিল—নানা তথ্য-প্রমাণ পেশ করছিল, কিন্তু ফল মিলছিল খুব সামান্য। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাসবিরোধী কমিটিও পাকিস্তানকে রক্ষা করত। কারণ, তাদের পক্ষে দাঁড়াত পরিষদের এক স্থায়ী সদস্য। ভারত এখন আর কেবল আন্তর্জাতিক কূটনীতির ওপর নির্ভর করবে না। কূটনীতি চালু থাকবে, কিন্তু তার সঙ্গে সশস্ত্র প্রতিক্রিয়াও থাকবে।
তৃতীয় বিষয় হলো, ভারত আর পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিতে ভীত থাকবে না। পাকিস্তান অনেক দিন ধরেই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিবেশী ও বিশ্বকে চাপে রাখত। কিন্তু ২০১৬ সালের সীমান্ত পেরিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, ২০১৯ সালে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলে বিমান হামলা এবং সর্বশেষ অভিযান—সব মিলিয়ে ভারত দেখিয়েছে, তারা এখন নিয়ন্ত্রণরেখা বা আন্তর্জাতিক সীমানা মানছে না। এবার তো পাকিস্তানের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ অংশেও আঘাত হেনেছে।
এভাবে ভারত প্রমাণ করেছে, পাকিস্তানের ভয় দেখানো আসলে ফাঁকা বুলি। ভারত বুঝতে পারছে, সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রিত সামরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের জবাব দেওয়া সম্ভব। তাতে পারমাণবিক যুদ্ধ বাধবেই, এমন ভাবনার কোনো ভিত্তি নেই। এখন থেকে যদি পাকিস্তান আবার কোনো জঙ্গি হামলা ঘটায়, তাহলে ভারত তার জবাবে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালাবে। অপারেশন সিঁদুরের মধ্য দিয়ে ভারতের দিক থেকে এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে।
এখন থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখনই তাদের মদদপুষ্ট জঙ্গিদের কাশ্মীর বা ভারতের অন্য কোথাও হামলার জন্য পাঠানোর কথা ভাববে, তখনই তাদের ভাবতে হবে, এই হামলার জন্য ভারতের শক্তিশালী সামরিক পাল্টা আঘাত তারা মোকাবিলা করতে পারবে কি না।
এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, ভারত এবার পানি নিয়েও বার্তা দিয়েছে। অপারেশন সিঁদুর শুরুর ঠিক আগেই ভারত জানিয়ে দেয়, তারা এখন সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখবে। যদিও ভারত এখনো সেই পানির ধারা সরিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো বাঁধ বা জলাধার বানায়নি, তবু এই ঘোষণা উপমহাদেশের ভূরাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
ভারত এখন আর শান্তির বিনিময়ে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে রাজি নয়। তারা স্পষ্ট বলছে, যদি সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না হয়, তাহলে পানি সরবরাহও প্রশ্নের মুখে পড়বে। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার জন্য এই পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—সেই বিষয়কেই এখন ভারত কৌশলগতভাবে সামনে এনেছে।
এই অভিযানের আরেকটা বড় উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকে দেখানো যে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত এবং তারা পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চলাফেরা করতে চায়। সামনে হয়তো যুদ্ধবিরতি কীভাবে হলো, তা নিয়ে অনেক তথ্য বের হবে। কিন্তু এখনই একটা জিনিস স্পষ্ট—ভারত যদি সামরিকভাবে চাপ না দিত, তাহলে এই যুদ্ধবিরতি হতো না। আর পাকিস্তান যখন হামলা থামিয়েছে, তখনই ভারতও তাদের অভিযান বন্ধ করেছে। এতে বোঝা যায়, ভারত যুদ্ধ করতে চায় না, কিন্তু কেউ জঙ্গি হামলা করলে তার জবাব দিতে দিল্লি পিছপা হবে না।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক শিগগিরই বদলে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম। বিশেষ করে কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো আলোচনার সুযোগ এখন অনেক দূরের বিষয়। আসলে কাশ্মীরই যে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের মূল কারণ বা সমাধান—এটি একটি ভুল ধারণা।
এই ধারণা মূলত পাকিস্তান উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়ে থাকে, যাতে ভারতের একটি অংশের ওপর অধিকার দাবি করা তাদের জন্য সহজ হয়। আসলে এই ধারণা একধরনের ধর্মভিত্তিক চিন্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরও বলেছেন, মুসলমানরা নাকি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে থাকতে পারে না।
পাকিস্তান এই মানসিকতা না বদলালে ভারতকে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যদিও ভারত মূলত যুদ্ধ নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার দিকেই মন দিয়েছে। তবু নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যাবে না, পাকিস্তানে শুভবুদ্ধি কাজ করে যাবে।
ভারত এরই মধ্যে দেখিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের উসকানির জবাব দিতে তারা প্রস্তুত। তবে সামনে ভারতকে আরও প্রস্তুতি নিতে হবে। সামরিক শক্তি বাড়াতে হবে। কূটনৈতিক দুর্বলতা দূর করতে হবে। দেশের ভেতরের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে। নাগরিকদেরও মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে।
স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের তুলনায় ভারত অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। ভারতের মোট অর্থনীতি পাকিস্তানের চেয়ে ১১ গুণ বড়। সামরিক শক্তিও অনেক বেশি। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির ভেতরে খুব প্রভাবশালী। তারা নিজেদের মতো করে বাজেট ঠিক করে। বড় বড় দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের পুরোনো সম্পর্ক আছে।
চীন ও তুরস্কের সঙ্গে তাদের সামরিক জোটও রয়েছে। এই জোটের কারণে পাকিস্তান দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। এখনো তারা তুরস্কের ড্রোন আর চীনের তৈরি যুদ্ধবিমান (যেমন জে-১০ সি) এবং গাইডেড মিসাইল (যেমন পিএল-১৫) দিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে এবং ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে ভারত শেষ পর্যন্ত জিতবে ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তানও বড় ক্ষতি করতে পারে।
● শশী থারুর ভারতের লোকসভায় কংগ্রেস পার্টির এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
![]() |
| ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানের একটি স্থাপনা। ছবি: রয়টার্স |

No comments