তিউনিসিয়াকে বাঁচাতে পারবে কি বিরোধীরা by ইউসরা ঘন্নুচি
তিউনিসিয়ার বড় শহর মেজোনায় দেয়াল ধসে তিন স্কুলশিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। মেজোনা সিদি বাউজিদ অঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চলটিই ২০১১ সালের বিপ্লবের জন্মস্থান। সেই বিপ্লবে স্বৈরশাসক জাইন আল-আবিদিন বেন আলীর পতন হয়েছিল এবং আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল।
এবারের প্রতিবাদ এক সপ্তাহ অব্যাহত ছিল। সেখানকার স্কুল ও দোকানপাট বন্ধ ছিল। বিক্ষোভকারীরা টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন এবং সরকারের অবহেলার বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।
নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ছোড়েন। শোকার্তরা যখন তাঁদের প্রিয় স্বজনদের স্মরণে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছিলেন তখনো কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। অনেকে আহত হন, অনেককে কাছের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়, টেলিযোগাযোগও সীমাবদ্ধ করা হয়। সাংবাদিকদের ওপরেও হামলা চালানো হয়, তাদের সংবাদ সংগ্রহে বাধা দেওয়া হয়।
এক দিনের বেশি সময় পার হওয়ার পরও সরকারের দিক থেকে শোক প্রকাশ করা হয়নি। এরপর যখন প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ টেলিভিশনে ভাষণ দিলেন, তখনো তিনি কোনো সমবেদনা প্রকাশ করলেন না। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের আঘাতে দেয়ালটি আগে থেকেই ভঙ্গুর ছিল। মন্দ কপাল যে এবার সেটি ভেঙে পড়েছে।’
দায় নেওয়ার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ স্কুলটির প্রিন্সিপালকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। অথচ কয়েক মাস আগে স্কুলপ্রাচীরের সেই ভঙ্গুর অবস্থার কথা তিনি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন।
রাজধানী তিউনিস ও মেজানো—দুই জায়গাতেই বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেতে চাইলে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়।
প্রেসিডেন্ট সাইদ কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভকারীদের ‘উসকানি সৃষ্টিকারী’, ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে দোষারোপ করেন। স্কুলের প্রাচীর ধসে মৃত্যুর জন্য তিনি ভাগ্যকে দোষ দেন। এরপর তিনি মেজানোয় যান। সেখানে শুধু গুটিকয়েক বাসিন্দাকে বাছাই করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁরা প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান এবং প্রশংসা করেন।
প্রায় চার বছর ধরে চলা দমন-পীড়ন এবং জবাবদিহিহীন শাসনের পথ ধরে এবারের জনরোষ ও বিক্ষোভ দেখা গেল। প্রেসিডেন্ট সাইদ এখন রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন। বিক্ষোভকারীরা ভালো করেই জানেন যে সাইদ যে একক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানে কোনো মন্ত্রী, গভর্নর অথবা সরকারের কোনো প্রতিনিধির আদতে কেন ক্ষমতা নেই।
সাইদ তাঁর খেয়ালখুশিতে প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন, বরখাস্ত করেন। তিনি রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও ট্রেড ইউনিয়নকে কঠোরভাবে দমন করেন।
২০২১ সালের জুলাই মাসে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর তিনি দেশটির গণতান্ত্রিক ‘অন্ধকার দশকের’ জন্য নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে দায়ী করেন। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ, বিদেশি এজেন্ট—সবাইকে তিনি বলির পাঁঠা বানান।
কিন্তু এই কৌশল খুব দ্রুতই কার্যকারিতা হারাতে থাকে। সম্ভবত তিনি এখন সেই জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি হতে বাধ্য হচ্ছেন, যাঁরা একসময় তাঁর জনতুষ্টিবাদী প্রতিশ্রুতিগুলোয় বিশ্বাস রেখেছিলেন। সব গণতান্ত্রিক রক্ষাকবচ গুঁড়িয়ে দিয়ে, বিচার বিভাগকে নিজের ইচ্ছার দাস বানিয়ে এবং সমালোচকদের জেলে পুরেও তিনি যে কল্পিত স্বর্গের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাস্তবে সেটা হয়নি।
এর পরিবর্তে তাঁর স্বৈরশাসন দেশের সমস্যাগুলোকেই কেবল তীব্র করেছে। মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্য অভূতপূর্ব পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেই সাইদ এখন তাঁর জনতুষ্টিবাদী বয়ানগুলো (বিশ্বাসঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী) আরও প্রবলভাবে সামনে আনছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আরও নির্ভরশীল হয় পড়ছেন। আর অনুগত বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সমালোচকদের জেলে পুরছেন।
গত সপ্তাহে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে গত সপ্তাহে ৪০ জন বিরোধীর বিরুদ্ধে সাজানো মামলার যে রায় দেওয়া হয়েছে, সেটা সরকারের হতাশার বহিঃপ্রকাশ।
৪০ জনের বেশি আসামিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেকেই বিচারের আগে দুই বছর ধরে কারাগারে ছিলেন। এর মধ্যে আমার একজন বোনও রয়েছেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ। রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁকে ৩৩ বছরের কারাগার জেল দেওয়া হয়েছে।
এই কথিত ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা একমাত্র যে প্রমাণ সামনে এনেছেন, সেটা হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে বিদেশি সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের সঙ্গে একটা বৈঠক।
আরও প্রায় ১০০ জন বিরোধী মতের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, আন্দোলনকর্মী এবং আমলার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগে কয়েক ডজন মামলা করা হয়েছে।
তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলী লারায়েদ রয়েছেন। বিচারের আগেই ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকেই তাঁকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
আমার বাবা, রাশেদ ঘন্নুচির বিরুদ্ধেও বেশ কয়েকটি মামলা দেওয়া হয়েছে। তাঁর বয়স এখন ৮৩ বছর। মিথ্যা মামলায় তাঁকে এরই মধ্যে ২৭ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে।
দেশের ক্রমবর্ধমান ঋণ ও বেকারত্ব এবং ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কোনো সমাধান সাইদের কাছে নেই। তিউনিসিয়ার অনেককে এখন মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের আমলে তিউনিসিয়ায় এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অর্থনীতির পতন ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। তাতে ব্যাপক মেধা পাচার বেড়েছে। গত বছর যেটা বেড়েছে ২৮ শতাংশ। হাজার হাজার তিউনিসিয়ার নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে।
২০২১ সালে অভ্যুত্থানে ইউরোপীয় সরকারগুলো উদ্বেগ জানানো সত্ত্বেও সাইদকে তাঁরা সমর্থন দিয়ে আসছেন। যদিও ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা দেওয়ার জন্য তিনি যে সমস্যাগুলোকে কাজে লাগিয়েছিলেন, সেগুলো সমাধানে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।
আমার বাবা তাঁর অন্যায় আটকের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে কারাগার থেকে লিখেছিলেন: ‘দায়িত্বশীল স্বাধীনতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ন্যায়বিচার এবং সবার জন্য সমান অধিকারের ভিত্তিতে গণতন্ত্র—এর মধ্যেই একমাত্র সমাধান রয়েছে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাইদের নির্বিচার দমন-পীড়নে বিরোধী দলগুলো নিজেদের মধ্যকার মতপার্থক্য ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশকে পেছনে ফেলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ও তিউনিসিয়াকে খাদের কিনার থেকে ফেরাতে পারবে কি না।
● ইউসরা ঘন্নুচি তিউনিসীয়-ব্রিটিশ গবেষক ও লেখক
- দ্য মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
![]() |
| ৪০ জনের বেশি আসামিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেকেই বিচারের আগে দুই বছর ধরে কারাগারে ছিলেন। ছবি : এএফপি |

No comments