আমেরিকাকে বাদ দিয়েই ইউরোপকে চলতে হবে by জোশকা ফিশার
এই বড় পরিবর্তন এমনভাবে শুরু হয়েছে, যার জন্য আগে থেকে কারও কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। আর এই পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে ইউরোপ। ইউরোপ আবার যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে—ইউক্রেনে যে যুদ্ধ চলছে, সেটিই তার স্পষ্ট প্রমাণ। অথচ এ পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপে থাকা মার্কিন সেনাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, ইউরোপকে এখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমাদের কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের ইউরোপীয়দের নিজেদেরই দিতে হবে; পুরোপুরি নিজেদের দায়িত্বেই দিতে হবে।
ভুল বুঝবেন না, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে সরে যাচ্ছে। তারা হয়তো পুরোপুরি বিদায়ের সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি, কিন্তু সব ইঙ্গিত সেই দিকেই যাচ্ছে। তাই ইউরোপীয়দের এমনভাবে কাজ করা উচিত, যেন যুক্তরাষ্ট্রের পুরোপুরি সরে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী।
এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র শুধু দূরে সরে যাচ্ছে না, বরং এটি একটি গ্যারান্টার শক্তি হিসেবে এবং বৈশ্বিক মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থার প্রধান বাজার হিসেবে তাদের ভূমিকা থেকেও সরে আসছে।
এখনই তারা বন্ধু ও বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে অর্থনৈতিক আগ্রাসন শুরু করেছে, যা কিনা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। মুক্তবাণিজ্যের জায়গায় এসেছে সুরক্ষাবাদ (প্রটেকশনিজম) এবং এর ফলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
বিশ্ব এখন এমন একটি অবস্থার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে শুল্কনির্ভর বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে নতুন ভূরাজনৈতিক জোটগুলোর প্রতিফলন ঘটবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পশ্চিম ইউরোপ আমেরিকার নিরাপত্তাছায়ার নিচে বসবাস করেছে। এই অঞ্চলগুলো এমন মূল্যবোধ শেয়ার করত, যা গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতিকে সমর্থন করত। শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই মূল্যবোধ পুরো ইউরোপজুড়েই গৃহীত হয়েছিল।
কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রত্যাহার ইউরোপীয়দের সামনে একেবারে ভিন্ন বাস্তবতা হাজির করছে। ইউরোপীয়দের সামনে নতুন বাস্তবতা হলো: নিজেদের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ তাদের নিজেদেরই গড়ে তুলতে হবে। এখন আর পুরোনো ছায়ার নিচে বসে থাকলে চলবে না।
আমাদের এমন একটি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, যেখানে একদিকে থাকবে সাম্রাজ্যবাদী ও আগ্রাসী রাশিয়া, আর অন্যদিকে থাকবে এমন একটি আমেরিকা—যার ওপর আর ভরসা করা যাবে না। এই বাস্তবতা আমাদের সামনে একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরছে: আমরা কি সত্যিই নিজেদের এমন একটি শক্তিতে রূপান্তরিত করতে প্রস্তুত, যে নিজে টিকে থাকতে ও নেতৃত্ব দিতে পারে?
যদি ইউরোপের জনগণ এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়, তাহলে ইউরোপীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সব কাঠামোকে (সামরিক, রাজনৈতিক, আর্থিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক) সামনে আনতেই হবে। প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম হওয়ার মানে হলো নিজের শক্তি ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির ওপর আস্থা রাখা।
আমরা এখন শুধু একটি ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি না, বরং একই সঙ্গে এক বিশাল প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছি। ডিজিটাল বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান সব অর্থনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলবে এবং তাদের মধ্যে জটিল সম্পর্কগুলোকেও নতুনভাবে রূপ দেবে।
এই বিশাল পরিবর্তনের মুখে ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী জাতীয় রাষ্ট্রগুলো কেবল তখনই টিকে থাকতে পারবে, যদি তারা একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটি অভিন্ন রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি প্রকাশ করতে পারে। প্রত্যেকে আলাদাভাবে (এমনকি সবচেয়ে বড় দেশ জার্মানিও) এ কাজের জন্য খুবই ছোট ভূমিকা রাখতে পারবে।
আমাদের সামনে যেসব বাইরের চাপ আছে, সেগুলোর গুরুত্ব কমিয়ে দেখার সুযোগ নেই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে হুমকি দিচ্ছেন। ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ তো করেইনি, বরং বরাবরই ইউরোপকে অবজ্ঞা করে এসেছে। শুধু তা–ই নয়, এখন তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, যাতে আমেরিকা নিজেও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবু তারা সে পথেই এগোচ্ছে। এ অবস্থায় ইউরোপসহ আমেরিকার অন্য বাণিজ্য অংশীদারেরাও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়ছে।
এ পরিস্থিতির মধ্যেই চীন তাদের শক্তি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আধুনিক সামরিক প্রযুক্তির উন্নয়নে খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। ফলে বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য এখন বড় রকমের পরিবর্তনের মুখে।
এসব চাপ আগামী মাস ও বছরগুলোতে আরও বাড়বে। কিন্তু ইউরোপীয়দের হাতে এখনো সুযোগ আছে। আমরা চাইলে বর্তমান সংকটকে নতুনভাবে গড়ে তোলার এক সুযোগ হিসেবে নিতে পারি। আমাদের চ্যালেঞ্জ শুধু অভ্যন্তরীণ ও বাইরের বাধাগুলো পেরোনো নয়, বরং নিজেদের বৈচিত্র্যময় পরিচয়ও রক্ষা করা।
সময়টা ইউরোপের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুযোগটা যদি এখন হারিয়ে যায়, তাহলে হয়তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। ট্রাম্প আর পুতিন হয়তো এমন নেতা নন, যাঁদের আমরা এ মুহূর্তে নেতৃত্বে দেখতে চাই, কিন্তু বাস্তবতা হলো—এখন তাঁরা বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব রাখছেন। তাই ইউরোপের আর অপেক্ষা করার সময় নেই। আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেদেরই তৈরি করতে হবে। আমাদের এমন একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ইউরোপ গড়তে হবে, যে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যৎ হবে একটা দুর্বল, ভীত, অন্যের দয়ানির্ভর জীবন।
এই লক্ষ্য পূরণে আমাদের প্রথমত, ইউরোপকে মিলিয়ে এমন একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে, যেন কেউ সহজে চোখ রাঙাতে না পারে। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও নতুন উদ্ভাবনে এগিয়ে থাকতে হবে, যেন আমাদের অর্থনীতি টিকে থাকতে পারে। তৃতীয়ত, একটি অভিন্ন পুঁজিবাজার তৈরি করতে হবে, যাতে অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপ আরও সংহত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—সব দেশ মিলে একটি সাধারণ রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও একে বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে।
● জোশকা ফিশার জার্মানির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
![]() |
| সময়টা ইউরোপের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছবি: এএফপি |

No comments