আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ: আন্দোলনকারীদের উল্লাস, আনন্দ মিছিল
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ব্যানারে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করছিল ছাত্র-জনতা। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফরমগুলো অংশ নেয়। শনিবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে চলা অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটির যাত্রা শুরু হয়।
দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৫ সালে দলটির নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও দলটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সে সময়কার কর্মকাণ্ডের জন্য ’৭১-এর ২৬শে মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও স্বাধীনতা পরবর্তী নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত হয় দলটি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার।
তার মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ টানা ১৬ বছরের শাসনামল দেশের ইতিহাসে গুম, খুন আর লুটপাটের রেকর্ড গড়ে। ক্ষমতায় থাকতে বিনা ভোট, রাতের ভোটের নির্বাচন করে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েও ঘৃণ্য ইতিহাস তৈরি করে দলটি। প্রবল গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। দেশ ছেড়ে পালান দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতা। যারা দেশে আছেন তারাও রয়েছেন আত্মগোপনে।
এরপর থেকেই ছাত্র-জনতা গণহত্যার অপরাধে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি তুলে আসছে। ২৩শে অক্টোবর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা হয়েছে। এসব মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত করতে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।
ওদিকে গতকাল রাতে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা উল্লাস প্রকাশ করে। শাহবাগে আন্দোলনকারীদেরও উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়।
আন্দোলনকারীদের উল্লাস, আনন্দ মিছিল
গণহত্যার বিচার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের পর শাহবাগ এলাকায় অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাস করেন। সরকারি এই সিদ্ধান্তের পর টানা দুইদিন চলা অবস্থান কর্মসূচি রূপ নেয় আনন্দ মিছিলে। আন্দোলনকারীরা শাহবাগ থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় এলাকায় মিছিল করে বিভিন্ন সেøাগান দেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্ত জানানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল হয়েছে। ওদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সরকারি সিদ্ধান্ত জানানোর পর দলের নেতাকর্মীদের সড়কে অবস্থান ধরে রাখতে বলেন। পরে তারা করণীয় নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে বৈঠক করেন। রাত একটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শাহবাগে কয়েকশ’ আন্দোলনকারীকে অবস্থান করতে দেখা যায়।
ওদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ ৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় গতকালও দিনভর অবরুদ্ধ ছিল। টানা অবরোধ এবং অবস্থান কর্মসূচি থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা দ্রুত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আল্টিমেটাম দেন। গণজমায়েতে বক্তারা বলেন, যারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চায় না তারা ফ্যাসিবাদী। আওয়ামী লীগ একটি খুনি দল। তাদের এই দেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই। হাজারো ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের অবৈধ সরকার। এই খুনের দায়েই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয় দিনের মতো শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচিতে গতকাল বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
সকাল থেকেই শাহবাগ মোড়ের চারপাশের সড়কগুলো অবরোধ থাকায় যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তবে এম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার যানবাহন চলাচলে ছাড় দেয়া হয়। ছাত্র-জনতার অবস্থানের কারণে শাহবাগ মোড়ের প্রতিটি সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। বিকাল গড়াতেই লোকে লোকারণ্য হয় পুরো শাহবাগ মোড় চত্বর। বিকাল ৩টার পর থেকেই এলাকা জুড়ে ছোট-বড় মিছিল আসতে শুরু করে। মিছিলগুলো টিএসসি, মৎস্য ভবন ও নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন দিক থেকে শাহবাগমুখী হয়। গণজমায়েতে অংশ নেয় এনসিপি, ইসলামী ছাত্রশিবির, হেফাজতে ইসলাম, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এদিন রাত ১০টা থেকে এনসিপি’র মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে যমুনার সামনে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা। পরে রাত ১টার দিকে মিছিল নিয়ে যমুনার সামনে যান এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন। শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে পাঁচটি পিকআপ ভ্যান একত্র করে সমাবেশের জন্য যমুনার পাশে ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের পাশের ফোয়ারার সামনে ‘জমায়েত মঞ্চ’ তৈরি করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে রাতভর অবস্থান এবং মিন্টো রোডের মোড়ে মঞ্চ তৈরি করে বিক্ষোভের পর গত শুক্রবার বিকাল থেকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

No comments