যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের কীভাবে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল: আল–জাজিরার এক্সপ্লেইনার
গত শনিবার প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে গাজা ও পশ্চিম তীরে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত সাতজন ফিলিস্তিনির সাক্ষ্য যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি, দুজন ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা ওই চর্চার ব্যাপকতা স্বীকার করেছেন, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা হয়।
এ অভিযোগের জবাবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তাদের অভিযানে বেসামরিক লোকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং বেশ কয়েকটি অভিযোগের তদন্ত চলছে।
আসুন, জেনে নেওয়া যাক, মানবঢাল কী? ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কতটা ব্যাপকভাবে এ অস্ত্র ব্যবহার করছে। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল কি শিগগিরই আরেকটি দমনাভিযান চালাতে পারে—এমন সব প্রশ্নের উত্তর।
মানবঢাল কী, ইসরায়েল কীভাবে এটি ব্যবহার করছে
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের (আইএইচএল) অধীন, ‘মানবঢাল’ বলতে বোঝায়—হামলা থেকে সামরিক লক্ষ্যবস্তু রক্ষায় বেসামরিক বা অন্য সুরক্ষিত ব্যক্তিদের, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা।
ওই আইনে যুদ্ধের ময়দানে মানবঢালের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু গাজায় গণহত্যার সময় ইসরায়েলি সেনারা এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ চলতি বছরের শুরুর দিকে এক সেনাসদস্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য প্রকাশ করে, যেখানে তিনি জানান, তাঁর ইউনিটে দিনে ‘ছয়বার’ ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো এবং এ প্রক্রিয়া কার্যত ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীতে ‘স্বাভাবিক’ রীতি হয়ে উঠেছে।
গত আগস্টে হারেৎজ আরও প্রকাশ করে, গাজায় মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত ফিলিস্তিনিদের বয়স সাধারণত ২০-এর কোঠায় এবং কিছু ইউনিট এক সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের ব্যবহার করেছে। ফিলিস্তিনি বন্দীদের চিহ্নিত করে (কাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে) টানেলের মুখ বা বিভিন্ন ভবনে পাঠানো নিয়ে গর্বও করেছে এসব ইউনিট।
‘এটি (ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা) এখন (ইসরায়েলের) সামরিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে’, বলেন ‘হিউম্যান শিল্ডস: এ হিস্ট্রি অব পিপল ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’ গ্রন্থের সহরচয়িতা নিকোলা পেরুজিনি। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে বহু প্রমাণ রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থার পাশাপাশি অনেক ইসরায়েলি সেনা নিজেরাও সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের “পশুখাদ্য” হিসেবে ব্যবহার করার প্রমাণ পোস্ট করেছেন; দৃশ্যত তাদের (ইসরায়েলি বাহিনী) যেন কোনো জবাবদিহি নেই।
এ বিষয়ে বহু প্রমাণ রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থার পাশাপাশি অনেক ইসরায়েলি সেনা নিজেরাও সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের “পশুখাদ্য” হিসেবে ব্যবহার করার প্রমাণ পোস্ট করেছেন; দৃশ্যত তাদের (ইসরায়েলি বাহিনী) যেন কোনো জবাবদিহি নেই।-----—নিকোলা পেরুজিনি, ‘হিউম্যান শিল্ডস: এ হিস্ট্রি অব পিপল ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’ গ্রন্থের সহরচয়িতা
‘গত কয়েক দশকে প্রমাণ হয়েছে যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তদন্ত প্রকৃতপক্ষে তদন্ত নয়’, বলেন পেরুজিনি। তিনি জানান, এই চর্চার (ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল করা) নথিভুক্তিকরণ শুরু হয় ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (ফিলিস্তিনি অভ্যুত্থান) সময়। এ চর্চা জেনেভা কনভেনশনের প্রটোকল ১ অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
‘ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যত যুদ্ধ হয়েছে, তার ইতিহাসে এবারের যুদ্ধেই মানবঢাল ব্যবহার করার সবচেয়ে বেশি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, এ গণহত্যা সরাসরি সম্প্রচারিত (ভিডিও, ছবি ইত্যাদি মাধ্যমে) হচ্ছে’, বলেন পেরুজিনি। তিনি আরও বলেন, ‘অনুসন্ধান করে আমরা যা পেয়েছি, তা হলো—এককথায় এটি একটি পদ্ধতিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা।’
অভিযোগের জবাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
এই সংঘাত চলাকালীন অভিযোগের জবাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাধারণ কৌশল ছিল মন্তব্য না করা, পর্যাপ্ত তথ্য না থাকার কথা বলা অথবা যখন অস্বীকার করার উপায় থাকেনি, তখন তদন্তের ঘোষণা দেওয়া।
আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল গত বছর ইসরায়েলকে বেশ কিছু অভিযোগের মুখোমুখি করলেও তারা সেসবের কোনো জবাব দেয়নি। দলটি কয়েক হাজার ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে; যার বেশির ভাগই ইসরায়েলি সেনাদের অনলাইনে পোস্ট করা। এসব ছবি ও ভিডিও এবং অন্যদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে ইসরায়েলি বাহিনীর সম্ভাব্য একাধিক যুদ্ধাপরাধ, যেমন মানবঢালের ব্যবহারকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওই অনুসন্ধান থেকে তৈরি করা হয় প্রামাণ্যচিত্র। তাতে বর্ণিত ঘটনার মধ্যে ছিল জামাল আবু আল-ওলার কাহিনি। ইসরায়েলি বাহিনী তাঁকে বার্তাবাহক হিসেবে ব্যবহারে বাধ্য করে। ফুটেজে দেখা যায়, ওই তরুণ সাদা স্যুট পরিহিত, হাত বাঁধা ও মাথা হলুদ কাপড়ে মোড়া অবস্থায় খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে স্থানত্যাগ করতে বলছেন। তাঁর মা তাঁকে অনুসরণ করেন এবং নিজের চোখে দেখেন, কীভাবে এক স্নাইপারের গুলিতে তাঁর ছেলেটিকে পরে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার ব্যাখ্যায় আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ রডনি ডিকসন বলেন, আল-ওলাকে ‘সামরিক সম্পদ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘নানা দিক থেকেই কাউকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করার সংজ্ঞায় পড়ে।’
চলতি বছর গাজা শহরে ৮০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে মানবঢাল বানানোর অভিযোগ নিয়ে তদন্তের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তারা বলেছে, ‘আরও বিস্তারিত তথ্য’ প্রয়োজন।
ইসরায়েলি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হটেস্ট প্লেস ইন হেল’ ও ‘+৯৭২ সাময়িকী’র এক যৌথ প্রতিবেদনে ‘মসকুইটো প্রসিডিউর’ (মশা পদ্ধতি) নামে পরিচিত এক ভয়ংকর কৌশলের নতুন রূপ উঠে আসে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েলি সেনারা জানিয়েছেন, এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওই বৃদ্ধের গলায় বিস্ফোরক তার পেঁচিয়ে দেন এবং বলেন, তিনি যদি কোনো ভুল করেন (কথামতো কাজ না করা), তবে তাঁর মাথা উড়িয়ে দেওয়া হবে।
এরপর ওই বৃদ্ধকে গাজার জেইতুন এলাকায় তাঁর বাড়ি ছেড়ে পালাতে বলা হয়। পরে অন্য একটি ইসরায়েলি ব্যাটালিয়নের গুলিতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী নিহত হন।
যাহোক, যখন অপরাধের অকাট্য প্রমাণ সামনে আসে এবং তা জনমনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে, তখন ইসরায়েলি বাহিনী ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনাকে স্বীকার করে। যেমন, গত বছরের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আহত ফিলিস্তিনি যুবক মুজাহিদ আজমিকে এক সামরিক জিপের বনেটে বেঁধে পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে অভিযান চালানো হচ্ছে।
এ ঘটনাকে ‘মানবঢাল ব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন জাতিসংঘের অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডবিষয়ক বিশেষ দূত ফ্রান্সেস্কা আলবানিজ।
এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা ওই অভিযানের সময় গুলিবিনিময়ে জড়ায় এবং সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় ধরে ফেলে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ভিডিওটিতে দেখা সেনাদের আচরণ’ সেনাবাহিনীর ‘মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়’ এবং এ ঘটনার তদন্ত করা হবে।
তবে পেরুজিনির পর্যবেক্ষণ হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যুদ্ধাপরাধের যেসব অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে; তার পেছনে অন্যতম কারণ হলো, আইন বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন না যে ইসরায়েল নিজেই নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের সঠিক তদন্ত করতে পারবে।
মানবঢাল ব্যবহারের নির্দেশ দেয় কে
বহু প্রমাণ থাকার পরও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আদৌ এই পদ্ধতিগত মানবঢাল ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে কি না, সেটি অনিশ্চিত। তবু তাদের জবাবদিহি করার জন্য চাপ বাড়ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবঢাল ব্যবহারের এ প্রথা অনেক দশক ধরেই চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামের গোপন তথ্য প্রকাশকারী একটি সংগঠন ২০০২ সালে পশ্চিম তীরের বেথলেহেমে নিযুক্ত একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বর্ণিত ‘নেইবার প্রসিডিউর’ (প্রতিবেশী পদ্ধতি) নামের এক কৌশলের পক্ষে প্রমাণ তুলে ধরেছে।
‘আপনি একজন ফিলিস্তিনিকে আপনাকে সঙ্গ দেওয়ার আদেশ দেন। যে বাড়িতে ঢুকতে চান সেটির দরজা খুলতে, কড়া নাড়তে ও সেটিতে প্রবেশ করতে বলেন। উদ্দেশ্য খুব সহজ: যদি দরজা বিস্ফোরিত হয়, তবে ফিলিস্তিনিই উড়ে যাবে, আপনি (সেনারা) নন’, বলেন মেজর পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তা।
২০০৫ সালে, ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে এ প্রথা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাঁচ বছর পর, দুই ইসরায়েলি সেনাকে গাজা শহরের তাল আল-হাওয়া এলাকায় নয় বছর বয়সী একটি শিশুকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বোমা বা বিস্ফোরকদ্রব্যের সন্দেহজনক ফাঁদ শনাক্ত করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
মানবঢাল ব্যবহারের দায়ে ইসরায়েলে প্রথম কোনো দণ্ডাদেশ দেওয়ার জানা ঘটনা ছিল এটি। তবে এ ঘটনার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে মানবঢালের ব্যবহারকে যেন একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে, বিশেষ করে গত ১৯ মাস ধরে চলা গাজা যুদ্ধে।
বাস্তবে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে মানবঢাল ব্যবহারের নির্দেশগুলো ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই আসতে পারে।
গত আগস্টে হারেৎজের এক অনুসন্ধানে কিছু সূত্র উদ্ধৃত করে বলা হয়, সাবেক চিফ অব স্টাফ হারজি হালেভি শীর্ষপর্যায়ের ওই কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন, যিনি গাজায় ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়ে অবগত ছিলেন।
সম্প্রতি এপির প্রকাশিত প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইসরায়েলি কর্মকর্তার বরাতে বলা হয়, ২০০৪ সালের মাঝামাঝি গাজায় মানবঢাল ব্যবহারের প্রথা এতটাই সাধারণ হয়ে ওঠে যে, প্রতিটি পদাতিক ইউনিট তাদের দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কোনো না কোনো ফিলিস্তিনিকে ঘর পরিষ্কার করার (সেনাদের থাকার জায়গা) কাজে ব্যবহার করে। এমনকি প্রায়ই ‘একটা মশা আনো’ বলে আদেশ দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এক ইসরায়েলি সার্জেন্ট জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে গাজায় তাঁর ইউনিট মানবঢাল ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন তাঁদের বলা হয়, কোনো বিকল্প নেই। এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁদের বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই।
এপির এ প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দ্য জেরুজালেম পোস্টকে গত রোববার বলেছে, ‘যদি আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়’, তবে তারা অভিযোগগুলোর তদন্ত করবে।
চলতি বছরের মার্চে হারেৎজ জানায়, ইসরায়েলের সামরিক পুলিশ ছয়টি ঘটনার তদন্ত করছে, যেখানে সেনারা ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে, রেডক্রসের এক প্রতিবেদনে এ অপব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল।
![]() |
| ইসরায়েলের একজন সেনাসদস্য। ফাইল ছবি: রয়টার্স |

No comments