ঢাকার ছাদ রেস্তোরাঁয় তাপপ্রবাহের বিপদ by মো. মাইদুল ইসলাম

* রাজধানীর বহুতল ভবনের ছাদে স্থাপিত রেস্তোরাঁর ৯৯ শতাংশই অননুমোদিত, রাজউকের পক্ষ থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

* ভবনের ছাদে বাগান থাকলে তা আশপাশের এলাকার তাপমাত্রা কমাতে বড় ভূমিকা পালন করে।

পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা কিংবা নিরিবিলি সময় কাটাতে কয়েক বছর ধরে খোলামেলা পরিবেশে ছাদ রেস্তোরাঁকে বেছে নিচ্ছেন নগরের বাসিন্দারা। বদ্ধ রাজধানীতে বিনোদন ও মনোরঞ্জনে এ ধরনের রেস্তোরাঁকে অনন্য বলছেন অনেকেই।

তবে ঢাকায় বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দুই শর মতো ছাদ রেস্তোরাঁর কোনোটিরই অনুমোদন নেই। এসব রেস্তোরাঁ নিয়ে চিন্তিত পরিবেশবাদীরা, এমনকি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (রাজউক)। ছাদে উচ্চ তাপে রান্না এবং প্লাস্টিক–জাতীয় দাহ্যবস্তু ব্যবহার করে সাজানোর কারণে সংশ্লিষ্ট ভবন ও এর আশপাশের ভবনে আগুন লাগা এবং তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। ঝুঁকি ও অবৈধতার প্রশ্নে কয়েকটি ছাদ রেস্তোরাঁ ভেঙেও দিয়েছে রাজউক। তারপরও নিয়মনীতি ও অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিমালিকানাধীন এ ধরনের রেস্তোরাঁর সংখ্যা বাড়ছে। বাদ যায়নি সরকারি ভবনের ছাদও।

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঢাকা শহরে যে তীব্র তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়, তা কমাতে ঢাকার বহুতল ভবনের ওপর ছাদবাগান হতে পারে অন্যতম বিকল্প। কিন্তু ছাদবাগানের পরিবর্তে ভবনের ছাদগুলো হয়ে উঠছে একেকটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। ফলে যে ছাদ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অতিরিক্ত তাপমাত্রা মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারত, তা–ই বাড়িয়ে তুলছে তাপপ্রবাহ।

রাজউক বলছে, এসব রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গিয়ে চাপের মুখে পড়েছে সংস্থাটি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভাষ্য, মেগা সিটি ঢাকায় বহুতল ভবনের ছাদে রেস্তোরাঁ এখন গোদের ওপর বিষফোড়া।

অনুমোদন দেয়নি রাজউক

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজে আগুন লাগে। এ ঘটনার পর ৫ মার্চ রাজউকের একটি মতবিনিময় সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজউকের আওতাধীন ৮টি জোনের ২৪টি সাবজোনের কর্মকর্তাদের ২১ মার্চের মধ্যে অনুমোদিত নকশা অনুসারে ও নকশার ব্যত৵য় করে পরিচালিত রেস্তোরাঁর তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

নির্দেশনা অনুসারে গত বছরের মে পর্যন্ত রাজউকের মোট ২৪টির মধ্যে ১২টি সাবজোনের কর্মকর্তারা রাজউকের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ–১–এর পরিচালকের কাছে রেস্তোরাঁর তালিকা পাঠান। সেই তালিকা প্রথম আলোর কাছে এসেছে। তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মোট ৮১৯টি রেস্তোরাঁ পরিদর্শন করতে পেরেছেন কর্মকর্তারা। এগুলোর মধ্যে ছাদ রেস্তোরাঁ আছে ২৫টি। সব কটিই অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে উল্লেখ করে এগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন কর্মকর্তারা।

রাজউকের তালিকা ধরে গুগল ম্যাপ এবং রেস্টুরেন্ট লোকেটর ব্যবহার করে ঢাকা শহরে ২০০টির বেশি ছাদ রেস্তোরাঁর খোঁজ পাওয়া গেছে। তালিকা হাতে পাওয়ার পর উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডি, আগারগাঁও, গুলশান ও সাভার এলাকার অন্তত ১৫টি ছাদ রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের বহুতল ভবনের ছাদগুলোকে রেস্তোরাঁ স্থাপনের জন্য বেছে নিয়েছেন মালিকেরা। ছাদগুলোর একাংশে রান্নার সরঞ্জাম বসিয়ে দিনের ১১–১২ ঘণ্টা উচ্চ তাপে বাংলা, থাই এবং চায়নিজ খাবার রান্না করা হচ্ছে। কোনো কোনো রেস্তোরাঁর এক পাশে টিন বা কৃত্রিম উপকরণ দিয়ে ছাউনি এবং কাচ দিয়ে ঘেরা ছোট কক্ষে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কয়েকজনের বসার ব্যবস্থা আছে। বাদবাকি ছাদে প্লাস্টিকের সরঞ্জাম, কাঠ ও বাঁশের উপকরণ এবং টবে গাছ লাগিয়ে সাজানো হয়েছে। এসব রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের রান্না হয়। ছুটির দিনগুলোতে রান্নার পরিমাণ বাড়ে দেড় থেকে তিন গুণ।

রাজউকের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ (চলতি দায়িত্ব) আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর বহুতল ভবনের ছাদে স্থাপিত রেস্তোরাঁর ৯৯ শতাংশই অননুমোদিত, রাজউকের পক্ষ থেকে এগুলোর কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। রেস্তোরাঁগুলো নিজেদের মতো করে তৈরি করা হয়েছে এবং সেভাবেই পরিচালিত হয়ে আসছে। আমরা বেশ কয়েকটি রুফটপ রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়েছি, সেগুলো বন্ধ করা হয়েছে। ধীরে ধীরে বাকিগুলো পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অবৈধ এসব রেস্তোরাঁর ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে গেলে নানামুখী চাপের মধ্যে পড়তে হয় উল্লেখ করে আশরাফুল ইসলাম বলেন, এসব রেস্তোরাঁ পরিচালিত হওয়ার পেছনে রেস্তোরাঁ ও ভবনমালিকের পাশাপাশি যাঁরা সেখানে যান, সবার দায় আছে।

বিধিমালায় নেই

বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ভবনের ছাদে বড় কোনো স্থাপনা নির্মাণের নিয়ম নেই। বিধিমালায় ছাদে পতিত বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং তা ব্যবহারের উপযুক্ত ব্যবস্থা ইমারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মূল ভবন ৫০০ বর্গমিটারের বেশি হলে ছাদে সংগৃহীত বৃষ্টির পানি পুনর্ব্যবহার এবং পানি ভূগর্ভে পাঠানোর ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডেও (বিএনবিসি) বহুতল ভবনের ছাদে রেস্তোরাঁ নির্মাণের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে ভবন ব্যবহারের জন্য ব্যবহার বা বসবাসযোগ্যের সনদ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।

এদিকে উন্মুক্ত স্থানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে ভবনের ছাদকে ব্যবহারের ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি সরাসরি ছাদে পড়ার ব্যবস্থা, গাছ লাগানো বা ছাদবাগান, বসার স্থান, দোলনা, খোলা ছাউনির ব্যবস্থা করা হলে ১০ শতাংশ গৃহকর মওকুফ করার ব্যবস্থা করেছে ডিএনসিসি।

নগর–পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা বলছেন, বহুতল ভবনের ছাদগুলোকে দুর্যোগ–আশ্রয় এলাকা (ডিজাস্টার রিফিউজ এরিয়া) হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সেখান থেকে হেলিকপ্টার বা অন্য কোনোভাবে বাসিন্দাদের উদ্ধার করা যায়। ফলে সেটি উন্মুক্ত রাখা কিংবা ছাদবাগান বানানোর জন্যই উপযুক্ত।

স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ভবনে আগুন লাগলে বা ধসে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হলে মানুষ ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে মই দিয়ে বা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করা হয়। সেই ছাদে যদি রেস্তোরাঁ থাকে আর সেখানে চুলা থেকে আগুন ধরে, তাহলে ওই ভবনই শুধু নয়; আশপাশের ভবনগুলোর জন্যও বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

বাড়ছে আগুন লাগার ঝুঁকি

কোনো ছাদ রেস্তোরাঁকে অগ্নিনিরাপত্তার সনদ দেয়নি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, কয়েক বছর আগে দু–তিনটি রেস্তোরাঁকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু ঝুঁকি বিবেচনায় সেগুলোরও নবায়ন আবেদন গ্রহণ করেনি ফায়ার সার্ভিস। বর্তমানে ছাদ রেস্তোরাঁর অগ্নিনিরাপত্তার সনদ দেওয়া বন্ধ আছে।

ফলে এসব রেস্তোরাঁ আগুনের ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের ছাদ উন্মুক্ত রাখা খুব জরুরি। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে খোলা ছাদ দুর্যোগের সময় মানুষকে আশ্রয় দেয়। সেখানে রেস্তোরাঁর মতো স্থাপনা নির্মাণে আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়ে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে ছাদ রেস্তোরাঁয় আগুন লাগার ঘটনা অহরহই ঘটছে। গত বছরের ১৫ এপ্রিল ভারতের ইন্দোরে ‘মাচান’ নামের একটি ছাদ রেস্তোরাঁয় আগুন লেগে পুড়ে যায়। এর আগের বছরের ১৯ অক্টোবর বেঙ্গালুরুর ‘মাডপাইপ’ নামের একটি রেস্তোরাঁয় আগুন লাগে। ২০২২ সালে পুনেতে, তারও আগে ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ের একটি ছাদ রেস্তোরাঁয় আগুন লেগে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। আর বাংলাদেশের রেস্তোরাঁগুলোতে আগুন লাগার ঘটনা হারহামেশাই ঘটে থাকে।

বাংলাদেশের রেস্তোরাঁগুলোর রান্নাঘর মান্ধাতার আমলের বলে সেগুলোকে অগ্নিনিরাপত্তার সনদ দেওয়া হয় না উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম ও আইন মেনে ছাদ রেস্তোরাঁগুলো নির্মিত হয় না বলে সেগুলোর ঝুঁকি বেশি। তবে আন্তর্জাতিক মান–কাঠামো অনুসরণ করে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা যেতে পারে।

রেস্তোরাঁর সংখ্যা ২ শতাধিক

রাজধানীতে মোট কতটি ছাদ রেস্তোরাঁ আছে তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোনো সরকারি–বেসরকারি সংস্থার কাছে পাওয়া যায়নি। তবে রাজউকের তালিকাটি ধরে ‘গুগল ম্যাপ’ ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ‘রেস্টুরেন্ট লোকেটর’ ব্যবহার করে ২০০টি ছাদ রেস্তোরাঁ খুঁজে পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতিও ছাদ রেস্তোরাঁর সংখ্যা ২০০টির বেশি নয় বলে জানিয়েছে। তবে নগরের বাসিন্দাদের চাহিদা থাকায় এ ধরনের রেস্তোরাঁর সংখ্যা আরও বাড়ছে বলে জানিয়েছে সমিতি। সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সব ছাদ রেস্তোরাঁ তাদের সংগঠনের সদস্যভুক্ত নয়। কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে।

সরকারি ভবনেও ছাদ রেস্তোরাঁ

২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ছাদে রেস্তোরাঁ চালু হয়। সাড়ে ছয় হাজার বর্গফুটের রেস্তোরাঁটিতে একসঙ্গে ১৫০ জন মানুষ বসে খেতে পারেন। বুফে সিস্টেমে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ জনের খাবারের বন্দোবস্ত আছে সেখানে।

অবশ্য পর্যটন করপোরেশন বলছে, তারা স্থাপত্য অধিদপ্তরের নকশা অনুসারেই ১৩ তলা ভবনটির ছাদে রেস্তোরাঁ নির্মাণ করেছে। করপোরেশনের পরিকল্পনা ও পূর্ত পরিচালক মাহমুদ কবির প্রথম আলোকে বলেন, এই রেস্তোরাঁটি পুরোপুরি খোলা ছাদে স্থাপন করা হয়নি। রেস্তোরাঁর বড় অংশই খোলা রাখা হয়েছে। সেখানে সব ধরনের নিরাপত্তা আছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে তাঁর দাবির সপক্ষে কাগজপত্র সরবরাহ করার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কয়েকবার তাগাদা দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।

ভেঙে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি

গত বছরের ৪ মার্চ বিচারপতি নাঈমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ছাদ রেস্তোরাঁগুলোর পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হাইকোর্ট বলেন, ‘যেভাবে একের পর এক রুফটপ রেস্টুরেন্ট হচ্ছে, তাতে আমরা অবাক হচ্ছি। এসব রেস্টুরেন্টে একটা ফ্যান লাগিয়ে চালু করে দিচ্ছে।’

ওই দিনই (৪ মার্চ) ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ছাদের রেট্রো রুফটপ রেস্টুরেন্ট ভেঙে দেয় রাজউক। রাজউকের নকশায় ভবনটির ছাদ খোলামেলা দেখানো হলেও বাস্তবে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলায় তা ভেঙে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া সাতমসজিদ রোডের টুইন পিক ভবনের দুটিসহ ৪০টির বেশি রেস্তোরাঁ বন্ধ করার পাশাপাশি ভেঙে দিয়েছে রাজউক, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা জেলা প্রশাসনসহ সরকারি সংস্থা।

গবেষণা কী বলছে

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের যেসব বহুতল ভবনের ছাদে বাগান আছে, সেসব ভবন এবং এর আশপাশের তাপমাত্রা কমাতে বড় ভূমিকা পালন করছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, যে ছাদে গাছ আছে সেটির পৃষ্ঠের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কম থাকে। ফলে ছাদের বাগান আশপাশের পরিবেশকে ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া এটি বাড়ির ভেতরের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়, যা বিদ্যুৎ খরচ কমাতে এবং মানুষের আরামদায়ক জীবনযাত্রায় সাহায্য করে।

এই পরিস্থিতিতে গবেষকরা ঢাকা শহরের যেসব ছাদে বাগান করার সক্ষমতা আছে, সেখানে বাগান তৈরির ক্ষেত্রে জোর দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে ঢাকা শহরে যেভাবে তাপপ্রবাহ বাড়ছে সেটি মোকাবিলায় খোলা জায়গায় গ্রিন স্পেস (গাছপালা) ও ব্লু স্পেসের (জলাশয়) পাশাপাশি ছাদবাগানের বিকল্প নেই।

‘মিটিগেশন স্ট্রাটেজিস ফর দ্য আরবান মাইক্রোক্লাইমেট অব ঢাকা মেগাসিটি টু রিডিউস অ্যাডভার্স ক্লাইমেটিক চেঞ্জ ইমপ্যাক্ট’ বা ঢাকার শহুরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর মাইক্রোক্লাইমেট প্রশমন কৌশল শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

গবেষণার নেতৃত্ব দেন কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেসের আশরাফ দেওয়ান। তাঁর সহযোগী ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রুহুল সেলিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের তৌহিদা রশিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মাহফুজ কবির।

গবেষণাটিতে বলা হয়, ছাদে উদ্ভিদের উপস্থিতি বাইরে থেকে ভবনের ভেতরে তাপ প্রবেশে বাধা দেয়। তাই স্বল্প পরিমাণ তাপ ভবনে প্রবেশ করে। এ কারণে জ্বালানির (বিদ্যুৎ) ব্যবহার কমে এবং ভবনের বাসিন্দাদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়।

ছাদবাগান বাতাসের তাপমাত্রা কমাতেও কার্যকর বলে গবেষণাটিতে উঠে এসেছে। গবেষকেরা ভবনের ছাদের এক, দুই ও তিন মিটার উচ্চতায় গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতের বাগানবিহীন এবং বাগানসহ ছাদের তাপমাত্রা পরিমাপ করেন। ফলাফলে দেখা যায়, শীতকালে এক মিটার উচ্চতায় বাগানসহ ছাদের তাপমাত্রা বাগানবিহীন ছাদের তুলনায় ৩ দশমিক ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। অবশ্য দুই ও তিন মিটার উচ্চতায় দিনের সময়ের ভিত্তিতে তাপমাত্রার তারতম্য হয়। যেমন দুই মিটার উচ্চতায় বাগানসহ ছাদের বাতাসের তাপমাত্রা কমানোর হার অনেক বেশি। একই ছাদে তিন মিটার উচ্চতায় ভোর এবং সন্ধ্যার তাপমাত্রা কমানোর হার বেশি।

‘নিরাপত্তার বিকল্প বিনোদন নয়’

নিরাপত্তার প্রশ্ন উপেক্ষা করে নিছক বিনোদনের বিবেচনায় বহুতল ভবনের ছাদে রেস্তোরাঁ নির্মাণ সঠিক সিদ্ধান্ত নয় বলে মনে করছেন নগর–পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বহুতল ভবনের ছাদে আগুন জ্বালানো কোনোভাবেই উচিত নয়। পাশাপাশি স্থাপনা নির্মাণ করে ছাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা ঢাকার মতো শহরে নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। এ পরিস্থিতিতে ছাদ রেস্তোরাঁগুলোর ব্যাপারে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.