কোচবিহার: ‘কতো রবো আমি পন্থের দিকে’ by মাহমুদ হাফিজ

ভরদুপুরে হোটেল রয়েল প্যালেস থেকে বেরিয়ে অটোরিকশায় চেপে ‘বলরামপুর’ উচ্চারণ করতেই চোখ কপালে তুলে মিয়া বিবিকে দ্বিতীয় দফা দেখে নেয় তরুণ অটোচালক নুর জামাল হক। কেতাদুরস্ত আরোহীদের পোশাক আশাক জানান দিচ্ছে কোচবিহারের নয়া আগন্তুক এরা। মধ্যবৈশাখের চল্লিশ ছুঁই ছুঁই তাপাঙ্কের ঘর্মাক্ত দুপুর এদের গন্তব্যের সঙ্গে যায় না। যায় না বলে নুর জামাল হক হয়তো ভেবে নেয়, ভরদুপুরে পঁচিশ কিলোমিটার দূরগ্রাম বলরামপুরে এরা কেন যাবে, সেখানে কী কাজ এদের? শেষাবধি ভাড়ার টাকা পাওয়াই তার লক্ষ্য, তাই মনে যা-ই চলুক, চলা শুরু করে সে।

মাইন্ড রিড করে আমি বলি: নুর জামাল, আব্বাসউদ্দীন আহমদ নামে কারও নাম শুনেছো? তার বাড়িতে যাবো।
নুর জামালের বাড়ি বলরামপুর-তেরঙ্গির কাছেই। বাংলাদেশের রংপুরে অঞ্চল থেকে বেশি দূরে নয়। দেশ ভাগের রাজনৈতিক রেখাটি মনে মনে মুছে দিলে এ?ই আকাশ, বাতাস, মাটি একদম এক। তার মুখের ভাষা ও আচরণ নতুন আগন্তুকদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। অটোরিকশার তৃতীয় গিয়ার দাবিয়ে সে বলতে থাকে, বাপ চাচার কাছে শুনেছি, ওই নামে গান বাজনা করতেন একজন বলরামপুরে। বহু আগে গত হয়েছেন, ঘরবাড়ির চিহ্নও এখন নাই।

মনে মনে বলি- নুর জামাল মিয়া, আছে কী নেই সেটা জানা তোমার কাজ না। এজন্য তোমার বাপ-চাচা বা দাদার প্রয়োজন।
কোচবিহার শহর থেকে কেশব সড়ক ধরে অটোরিকশা ছাত গুড়িয়াহাটি হয়ে শীল তোরশা নদীর ভাটিমুখো চলতে থাকে। ভাটিমুখো মানে বাংলাদেশের দিকে। যত এগিয়ে যাই, সীমান্ত তত কাছে আসে। হলে কী, সীমান্তরেখার সব জায়গা তো আর মানুষের যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত না। রাষ্ট্র এর জন্য নির্ধারিত জায়গা তৈরি করে রেখেছে। তাই বাংলাদেশের কাছাকাছি যেতে থাকলেও বাড়ি যেদিন ফিরবো, বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা রাস্তার ঘুরপথে শত কিলোমিটার দূরত্বের চেকপোস্টেই যেতে হবে।
গুগল দেখাচ্ছে সামনে ঘুঘুমারি সেতু। ওঠার সময় পুরো অটো রিজার্ভ করতে চাইলেও চালক রাজি হয়নি। রুটের গাড়ি।  যাত্রী ওঠা-নামা করানোই এখানে অলিখিত নিয়ম। এতে চারজনের আসন বাড়িয়ে দ্বিগুণের বেশি মানে এগারো করা হয়েছে। সামনে চালকের ডানে এক বামে দুই। পিছনে মূল চার আসনের সামনে পা রাখার জায়গায় চিকন বেঞ্চ পেতে বানানো হয়েছে আরও চার আসন। মুখোমুখি। আরোহীদের একজনের পা আরেকজনের দু’পায়ের ফাঁকে গলিয়ে বসতে হয়। আমরা দু’জন মূল চার আসনের দু’টি আর পা ছাড়িয়ে সামনের দু’টি আসনের দখল নিয়ে চারজনের ভাড়ায় চালককে রাজি করিয়েছি। যাতে অন্তত অন্য আরোহীর দুই পায়ের ফাঁকে পা গলিয়ে বসতে না হয়। আমাদের পাশে বসেছে অনুজকে নিয়ে এক তরুণীমাতা। তার কোলে বছর বয়সী বাচ্চা। তাদের উল্টো পাশে মধ্যবয়স্ক দম্পতি। গৃহবধূর পরনে ঘরের আলমারি থেকে নামানো ‘তোলা’ শাড়ি। স্বামীও তোলা প্যান্ট জামা পরে তেল দেয়া মাথায় সিঁথি কেটে পথে নেমেছে। চালকের দুইপাশেও আরোহী আছে, তারা দূরে আর কম দূরত্বের যাত্রী বলে সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই।  

ঘুঘুমারিতে এসে শীল তোরশার সেতু পেরুলো নুর জামাল হক। তারপর গাড়ির সর্বোচ্চ গিয়ার দাবিয়ে ভট ভট করতে করতে দ্রুতই ধালিয়াবাড়ি, লাতকারপার, গারোপাড়া পার হতে লাগলো। চলন্ত গাড়ির বাতাসে বসে আমাদের চোখে ভাসলো দিগন্তপ্রসারী মাঠ, সবুজ ধান ক্ষেত, ভুট্টার আবাদ, ছোট ছোট নদী খাল, গ্রামীণ কাঁচা ঘরবাড়ি, রাস্তার পাশের দোকানপাট। এ ভিন্ন কোনো দেশ নয়, আমার দেশের মতোই একই আবহাওয়া ও ভূগোল। গাড়ি এসে দাঁড়ালো দোকানপাটে ভরা দেওয়ানহাট। এই দেওয়ানহাট জায়গাটা জংশনের মতো, ত্রিমোহণী। সোজা রাস্তা চলে গেছে দিনহাটা। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মস্থান দিনহাটা বলে জানতাম, এই তাহলে দিনহাটার পথ। আমরা যাবো বামে, তুফানগঞ্জের দিকে। তুফানগঞ্জ কোচবিহারের সাব ডিভিশনাল শহর। দেওয়ানহাট তেমাথায় সব গাড়িই কিছুক্ষণ থামে। অটো থামতে কেউ কেউ টয়লেটে, কেউ দোকানের দিকে গেল। কম দূরত্বের রাস্তায় আমরা না নেমে অটোতে বসে চারপাশ দেখতে থাকি। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে থাকা স্বামীর উদ্দেশ্যে সামনের মধ্যবয়সী গৃহবধূ চেঁচালো: এ্যাই, ওই দ্যাখো মিষ্টির দোকান। দই মিষ্টি নিয়ে এসো, ওই অজগাঁয়ে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না।
বোঝা গেল, এর কোচবিহার বা একটু সদর মতো জায়গায় থাকে, যাচ্ছে গ্রামীণ আত্মীয় বাড়ি।  

অটো চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর এক গাঁয়ের পথের মুখে দই মিষ্টির প্যাকেট হাতে দম্পতি নেমে গেল। আমরা এখন তুফানগঞ্জের পথে। গুগলে দেখছি, বলরামপুর আর বেশি দূরে নেই। গাড়ি অনেকটা ফাঁকা বলে বাচ্চা কোলে তরুণীমাতা ও তার ছোট ভাই এতক্ষণের গাদাগাদি অবস্থা থেকে আয়েশ করে বসেছে। আরাম আয়েশে মানুষের মনে বোধ হয় খোশগল্পের জজবা আসে। তারা আকস্মিক আমাদের নাম ধাম, ঘরবাড়ি, কোত্থেকে এলাম, কোথায় যাবো এসব জিজ্ঞেস করতে লাগলো। বিপুল প্রশ্নের উত্তরের পর পাল্টা চাপান হিসেবে আমি ও ভ্রমণসঙ্গী জলি তাদের ব্যাপারেও জানতে চাইলাম।

তরুণীমাতার নাম গীতশ্রী। চেহারা-গড়নে নামের সঙ্গে দিব্যি মানানসই। গ্রামে বেড়ে ওঠা সুন্দরী তরুণীর উচ্চতর ডিগ্রির নিতে ওপরে ওঠা হয়নি। হিসেবি অভিভাবকদের কল্যাণে মাধ্যমিক স্তরেই তার কপালে সিঁদুর আর কোলে বাচ্চা উঠেছে। তার কৌতুহলী জিজ্ঞাসা, বাংলাদেশ যেতে পাসপোর্ট লাগে কিনা, ভিসা কীভাবে পেতে হয় এসব। কারণ বাবার কাছে শুনেছে তাদের পূর্বপুরুষ বগুড়া বা রংপুরে ছিল, দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর তারা বাবা ঠাকুদ্দারা এইভাগে চলে আসে, ফেলে আসা ভাগের দেশে এখনো বাস করে আত্মীয়-স্বজন। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার একটি আকুল আকুতি সে সবসময় লালন করে মনে।

অনেকটা ফাঁকা একটি মাঠের প্রান্তে তরুণীমাতা গীতশ্রী চালককে অটো থামাতে বললো। নুর জামালের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম কম বাড়িঘরবিশিষ্ট গ্রামটির নাম তেরঙ্গি। নেমে যেতে যেতে গীতশ্রী অতিথিসেবার মিনতি জানিয়ে বললো, ফিরতি পথে একবার আমাদের বাড়ি বেড়ায়ে যাইয়েন, রাস্তার পাশেই তো! সে হয়তো পূর্বপুরুষের ভাগ হয়ে যাওয়া দেশে একটা সুতোর বিনুনি তৈরি করতে চাইছিল, যাতে সেই সুতো ধরে চলে যাওয়া যায় অতীত-শেকড়ে। কিন্তু আমাদের জীবন ও সময় অনেক দৃঢ় বন্ধনকেও কোনো না কোনো কারণে ছিন্ন করে, কাটিয়ে দেয় পথের মায়া। আবার কোনো কোনো সম্ভাব্য বন্ধনকে বাঁধতে দেয় না। পৃথিবীতে এরকম বিপরীতমুখিতা আছে বলেই জীবন এত সুন্দর ও প্রার্থিত।  

পার হয়ে ভাইবোন রাস্তার ডানপাশে চলে গেল। আমাদের দৃষ্টি তাদের অনুসরণ করে দেখতে পেল, রাস্তা-লাগোয়া নবনির্মিত একটি তিনতলা ভবনে তারা প্রবেশ-উদ্যত। বাড়ির বন্ধ গেটমুখে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করা অটোরিকশার দিকে আরেকবার তাকালে আবারো আমাদের চোখাচোখি হলো। সাদা রংয়ের দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি গীতশ্রীর শ্বশুরবাড়ি, নাকি সে বাপের বাড়ি বেড়াতে এলো-তা বোঝার আগেই সম্ভাব্য বন্ধনকে ছিন্ন করে আমাদের অটো উভয়ের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

এই রাস্তায় শীল তোরশা আর কালজানি নদীর মিলিত রূপ কালজানি নামে আরেকবার দেখা দিয়েছে তুফানগঞ্জের এগার কিলোমিটার আগে। কালজানির এই সেতুর নাম ভাওয়াইয়া সেতু। নদী ও সেতুর চার কিলোমিটার আগে রাস্তার পাশে দোকানপাট নিয়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম-গঞ্জের রূপ নিচ্ছে। গ্রামের নাম বলরামপুর। এই গ্রামে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কতো রবো আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’র মতো শত শত বহুশ্রুত ভাওয়াইয়া সংগীতের কিংবদন্তি আব্বাসউদ্দীন আহমেদের জন্ম। আমাদের গন্তব্য এই বলরামপুর আর কাজ বাংলাদেশের সংগীত কিংবদন্তির জন্ম ভিটের সন্ধান।

নুর জামাল হক বলরামপুরে আমাদের নামিয়ে সোজা ভাওইয়া সেতুর দিকে চলে গেল। মাথার ওপর গনগনে সূর্য আগুনের গোলা ঝরাচ্ছে। আল্লাহর দুনিয়ার মাটিও তেতে উঠেছে। এই কাঠফাটা রোদের তীব্র দাবদাহে আমরা নাকাল। কিন্তু এসে যখন পড়েছি, তখন আব্বাসউদ্দীন আহমেদের জন্ম ভিটে তো খুঁজতেই হবে। আর গ্রামের বাড়ি বাড়ি তালাশ করলে তা খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। দুই এক্সপ্লোরার বয়স্কগোছের মানুষ খোঁজ করি। চা দোকান, হোটেল, রেস্তরাঁ, ভ্যান অটোতে যাকেই দেখি, তার বয়সই মাত্র ত্রিশ চল্লিশের কোঠায়। জেনারেশন গ্যাপে আব্বাসউদ্দীন তো দূর তার নাতিপুতিদেরও চিনবে কিনা সন্দেহ! আমরা খুঁজছি, বৃটিশ না হোক ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান দেখেছে এমন বয়স্ক লোক। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরা এক বৃদ্ধকে। চুল দাড়ি পাকা, হাতে বাজারের থলে, পরনে ধুতি আর গায়ে পকেটওলা হাওয়াই শার্ট। তার নাম সদানন্দ। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন নামটি উচ্চারণ করতেই তিনি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তিনি বলরামপুরেরই মানুষ, বাংলাদেশে থাকেন। বছরে বছরে এ গাঁয়ে আসেন, বছর দুই থেকে আর আসেন না।

ভাবলাম, ইনি হয় মতিভ্রষ্ট না হয় অন্য কোন আব্বাসউদ্দীনের কথা বলছেন। পরক্ষণে আমার সিক্‌থ সেন্স সক্রিয় হয়। ভাবি, ইনি হয়তো আব্বাসউদ্দীনকে দেখেননি। তার নাম শুনেছেন। আব্বাসউদ্দীন ও তার পূর্বপুরুষের স্মৃতি সন্ধানে বছরান্তে তার পুত্র বিচারপতি মোস্তফা কামাল বা শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী এখানে আসতেন। তাদেরই বিশেষ করে মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে আব্বাসউদ্দীন ভেবে নিয়েছেন বৃদ্ধ সদানন্দ। শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী বছর দুই শয্যাগত, তাই হয়তো এখন আর পিতৃভূমিতে যান না। শিল্পীর জন্মভিটেটি কোথায় জিজ্ঞেস করলে বৃদ্ধ সদানন্দ এক টোটো চালককে ডেকে বললেন- ইনাদের মিস্ত্রি খানায় নিয়ে যাও। বললাম, মিস্ত্রি খানায় নয়, বলরামপুরেই শিল্পী জন্মেছিলেন। বৃদ্ধ সে কথায় কান না দিয়ে অটোচালককে হাত ইশারা করে দেখিয়ে বললেন, এই রাস্তা দিয়ে সোজা গিয়ে ডানের রাস্তায় ঢুকলেই মিস্ত্রি খানা।

টোটোচালক যুবক সোমনাথ আমাদের মূল রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে ডানপাশের পাড়ায় নামিয়ে চলে গেল। স্থানীয় বেনেতি দোকানী যুবক আরিফ হোসেনের কাছে আব্বাসউদ্দীন শব্দটি উচ্চারণ করার পর আর কিছু বলতে হলো না। সে বললো, সামনের হলুদ একতলা বিল্ডিংটা জীবন কাকুর। কাকুর বাসার পাশের রাস্তা দিয়ে পিছনের দিকে চলে যান। দেখবেন পুকুর, কবর আর শিল্পীর জন্মভিটে। ভাবলাম, বেনেতি দোকানে বসলেও সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত আরিফের কাছে অনেক খোঁজখবর। আমাদের কথার সময় দুপুরের গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত পাশের বাড়ির সিঁদুরপরা গৃহবধূ উৎকর্ণ হয়ে কথাবার্তা শুনছিল, একইভাবে উৎকর্ণ হয়ে রইলো দোকানে সদাই নিতে আসা আরেক মুসলিম গৃহবধূ। আরিফ হোসেনের ইশারা অনুসারে হলুদ বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে পিছনে মাঠের দিকে নেমে যেতে উদ্যত হতেই পাড়ার মসজিদ থেকে জোহরের আজান ভেসে এলো। বুঝতে অসুবিধে হলো না, বলরামপুরের মিস্ত্রিখানায় মুসলমানের সংখ্যা নিদেন কম নয়।
--- ২ ---
রাস্তার একপাশে জীবন সরকারের বাড়ি, অন্যপাশে প্রতুল আচার্যের পাকা ঘরদোর। দুই বাড়ির মধ্যকার গলি দিয়ে একশ’ কদম এগুলেই কয়েক একর জায়গা জুড়ে উন্মুক্ত প্রান্তর, প্রান্তরের একপাশে বড় পুকুর। অন্যকোণে বাঁধানো দু’টি কবর, অযত্নে বেড়ে ওঠা ঝোপজঙ্গলে ভরা। বাঁধানো কবরের সামনে স্থানীয় বাসিন্দাদের খড়ের গাদা। প্রান্তর ও পুকুরপ্রান্তে পরিত্যক্ত চৌচালা টিনের ঘর। পুরনো ও জ্বরাজীর্ণ। ঘরটি বাঁশ-কাঠ-টিনের বেড়া। শালকাঠের দরজা জানালাগুলো পুরনো ডিজাইনের। ঘরের ভিতরে কিছু নেই। সামনে সদর দিকে টানা বারান্দা, ঘরের পিছন দিকে দিগন্তছোঁয়া মাঠ। মাঠের দিকে টিনছাওয়া পোর্টিকো। দীর্ঘ অযত্নে এ ঘর অবাসযোগ্য পোকামাকড়ের ঘরবসতিতে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেশী বাড়ির জিয়ারুল আর প্রতুল আচার্য পোর্টিকোয় পড়ে থাকা একটি গরুগাড়ির কাঠামোর ওপর বসে খৈনি খাওয়ার এন্তেজাম করছিল। আচানক আনজানপহচান কেতাদুরস্ত মিয়াবিবিকে দেখে প্রথমে কিছুটা ভড়কে গেল। পরে আব্বাসউদ্দীন, আব্বাসদ্দীন শব্দ শুনে ধাতস্থ হয়ে উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে বললো, এই ঘরেই তিনি গান-বাজনা করতেন। প্রায়ই লোকজন আসে খোঁজখবর করতে। ওইখানে তার বাপ-মায়ের কবর। জিয়ারুল আর প্রতুল দুইধর্মের অনুসারী হলেও একসঙ্গে খৈনির এন্তেজাম করছে প্রসঙ্গ তুললে সহাস্যে দু’জনই সমস্বরে বললো, আমরা ভাই ভাই।
বললাম, খৈনি ব্রাদার্স।
টিনের ঘরের সমাহার নিয়ে প্রান্তরলাগোয়া আরেকটি বাড়ি।
খৈনি ব্রাদার্স আমাদের জানালো, সরকার পরিবারের এক ভাই এই বাড়িতে থাকতেন। কয়েকদিন আগে স্বর্গবাসে গেছেন। গৃহকর্তার মৃত্যুশোককবলিত বাড়িটিতে এ মুহূর্তে কারও সাড়া পাওয়া যাবে না বলে প্রতুল ও জিয়ারুল জানালো- সামনের হলুদ বিল্ডিংয়ে জীবন সরকারের সঙ্গে কথা বলুন, সব অতীত ইতিহাস জেনে যাবেন। তারা জানালো,  আব্বাসউদ্দীনের আইনজীবী বাবা দেশভাগের সময় সরকার পরিবারের সঙ্গে জমিজিরাত বিনিময় করেছিলেন। সিনিয়র সরকারের পাঁচপুত্র বলরামপুরে বেড়ে উঠলেও এখন তিনজনই শহরে থাকে। গ্রামে থাকা দুই ভাইয়ের একজন সম্প্রতি স্বর্গবাসী হলেন। রইলো বাকি জীবন সরকার। হাইস্কুল থেকে অবসর নিয়ে তিনি বাড়ি পাকা করেছেন। খৈনি ব্রাদার্সের তথ্যমতে, বিস্তর পৈতৃক  জমিজমা ছিল আব্বাসউদ্দীনের। মাঠের বিস্তীর্ণ জমিজমা ভাইদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেছে। এখন বেচাকেনায় শেষ হতে চলেছে। পুকুরপাড়ের টিনের ঘরকে কেন্দ্র পুরো প্রান্তর পরিত্যক্ত থাকলেও সরকারের উন্নয়নের জন্য অপেক্ষমান। বাড়ির এ অংশটুকু নিয়ে সরকার আব্বাসউদ্দীনের স্মৃতিরক্ষায় প্রকল্প হাতে নিতে পারে বলে শুনেছি। এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে তারা খৈনি মুখে দেয়ার এন্তেজামে মশগুল হলো।

পরিত্যক্ত প্রান্তরের প্রবেশমুখে হলুদরঙা একতলা বিল্ডিং জীবন সরকারের। তার সঙ্গে আলাপ করতে পারলে ভাওইয়া কিংবদন্তির দেশভাগ, সম্পত্তি বিনিময়ের অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে। বাড়ির দরজায় গিয়ে দেখি- তালাবদ্ধ। দোকানি আরিফ জানালো, কিছুক্ষণ আগে জীবন কাকু বাড়ি থেকে কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে যোগাযোগের একটি নম্বর পাওয়া গেল। ফোন করে আব্বাসউদ্দীনের প্রসঙ্গ তুললে তিনি বাসের ভিড়ে আছেন, এখন কথা বলতে পারবেন না ইত্যাদি বলে কথা শেষ করলেন। আরও কয়েকদফা ফোন করেও তার সঙ্গে ঠিকঠাক কথাবার্তা বলা সম্ভব হলো না। তিনি কথা বলতে অনাগ্রাহী বলে মনে হলো।
বাংলার লোকজ গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমেদ এর অতীত জীবন নিয়ে জীবন সরকারের সঙ্গে আলাপ করতে না পেরে মন খারাপ হলো। কিন্তু প্রত্যাশা মনে জেগে রইলো যে, আগামীতে এসে এখানে দেখতে পাবো শিল্পীর জীবন ইতিহাসে সমৃদ্ধ জাদুঘর।
রোদে ভরা একটি তপ্ত দুপুরকে মাথায় করে বলরামপুর থেকে বেরিয়ে আসি, পিছনে পড়ে থাকে প্রখ্যাত গায়কের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সুবর্ণস্মৃতির শেকড়। মনে বাজতে থাকে কালজয়ী এক লোকজ সুর। জলি গেয়ে ওঠে- ‘কতো রবো আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে’।
(মানবজমিন ঈদ আনন্দ ২০২৫ থেকে)

mzamin

No comments

Powered by Blogger.