শামিল হতে হবে ফিলিস্তিন বাঁচানোর মহাযুদ্ধে by মাহবুব নাহিদ

বাংলাদেশের বুকে এবার এক অবিস্মরণীয় ঈদ নেমে এসেছিল। এমন প্রবল উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার ঈদ আমরা যেন কমই পেয়েছি। ঈদের আনন্দের স্রোতধারা যতটা বয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা বইতে পারেনি। সুখ আমাদের সয়নি, ঢাকা থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের শহর গাজায় ইসরাইল কর্তৃক মানুষ হত্যার যে তাণ্ডব শুরু হয়েছে তা নাড়িয়ে দিয়েছে সকলের অন্তরাত্মা। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষেরা কিছুদিন আগেই এক স্বৈরাচারকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছে। মানুষের মাঝে সেই আবেগটুকু আছে, আজ যেন সবাই দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। সারা বিশ্ব আজ ফুলে ফেঁপে উঠেছে ক্ষোভে, বিক্ষোভের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়েছে আমাদের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই। মানুষের মাঝে যা উত্তেজনার জোয়ার দেখা গেছে, তাতে মনে হচ্ছে এবার কিছু একটা হবে। ইসরাইলের চলমান আগ্রাসন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে আমাদের টেনে নিয়ে যাবে কিনা এটা এখন অনেক বড় প্রশ্ন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের।

স্ট্রাইকস ফর গাজা, নো ওয়ার্ক, নো স্কুলে সংহতি জানিয়েছে সারা বিশ্ব। আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ নেমে গেছে রাস্তায়। কিন্তু আমাদের খুঁজতে হবে সমাধানের পথ। আমরা যখন এখানে বসে হিসাব লিখছি ফিলিস্তিনে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। সবচেয়ে কঠিন খবর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রেও মানুষ পথে নেমেছে, কিন্তু নতুন মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেয়ার পরই যেন ইসরাইলের আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে, এটাই কি তাহলে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার? এমনকি আমেরিকা ইরানে হামলা করার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা সৌদি আরবের সহায়তা চায়। ন্যাটোভিত্তিক যতগুলো দেশ আছে, তাদের একটা নীতি আছে। যদি জোটের অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশের ওপর হামলা হয়, তাহলে তারা ধরে নেবে যে সকলের ওপরেই হামলা হয়েছে। এমনটা নিয়ম ‘ওআইসি’র কি আছে? আছে কি নাই সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে, একটা প্রশ্ন তুলতেই হবে, যেই প্রশ্নটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ তুলেছে। পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার অস্ত্রশস্ত্র আছে কিন্তু তা ফিলিস্তিনের ভাইদের কোনো কাজে আসে নাই। নীল নদের এত পানি থাকতেও ফিলিস্তিনের মা-বোনেরা পানির অভাবে মারা যাচ্ছে। তুরস্ককে তথা এরদোয়ানকে তো সবাই মুসলিম ভ্রাতৃত্বের নেতা বা কাণ্ডারি হিসেবেই ধরে নিতেন, কিন্তু কোথায় এখন তিনি? তিনি কি গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসায় ব্যস্ত? সৌদি আরব বা আরব আমিরাতের এত তেল, কিন্তু গাজার হাসপাতালে কোনো জ্বালানি নাই। কী লাভ আমার ২২০ কোটি মুসলমান থেকে, কীইবা লাভ ৫০ লাখ মুসলিম সৈন্য দিয়ে?

ইসরাইল রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে থেকেই তারা বিভিন্নভাবে ফিলিস্তিনের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। নতুন করে ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। গাজা, রাফাহসহ বিভিন্ন এলাকায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ইসরাইলের বিপক্ষে ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে হামাস। হামাসের এই যুদ্ধে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ইরান। ইরান যে হামাসের পক্ষে থাকার ঘোষণা দিয়েছে তার মধ্যে আবার দুইটা ভিন্ন দিকও আছে। প্রথমত, ইরান কিন্তু একসময় ইসরাইলের পক্ষে ছিল, এমনকি ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশও কিন্তু ইরান। পরবর্তীতে তাদের দেশে ইসলামিক বিপ্লব আসার পরে ইরান ফিলিস্তিনপন্থি হয়ে যায়, এমনকি তারা ইসরাইলি দূতাবাস ভেঙে দিয়ে সেখানে ফিলিস্তিনি দূতাবাস গড়ে তোলেন। আরেকটা দিক হচ্ছে, ইরান শিয়া অধ্যুষিত দেশ হয়েও ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে যেখানে কথা ছিল সুন্নি মুসলিমদের নেতৃত্বস্থানীয় দেশ সৌদি আরবের এগিয়ে আসা। তবুও ইরান যে এসেছে, সেটাকেই সাধুবাদ জানানো উচিত।

প্রশ্নের মাঝেও অনেক প্রশ্ন থেকে যায়, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ওই একটাই, আসলেই কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠবে? বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসলেই যদি হয়ে যায় তাহলে পারমাণবিক অস্ত্রের নগ্ন খেলায় যেভাবে সবাই মেতে উঠবে তাতে পৃথিবী একটা শ্মশানে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক প্রকট। ডনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে বাইডেন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন কিছুটা হলেও গতি শ্লথ ছিল ইসরাইলের, কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে এই গতি বেড়ে যায়। ইসরাইলের আসলে লক্ষ্য কী? কেন এই ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে উঠলো তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু ইহুদিদের যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাস ভ্রান্ত হলেও তা থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের সবাইকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য একজন মাসিহ বা ত্রাতা আসবেন। সেই ত্রাতা আসতে হলে কিছু শর্ত আবার পূরণ করতে হবে তাদের। পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল ইহুদিদের এক জায়গায় আনতে হবে। তাদের একটা নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বর্তমানে যেখানে আল আকসা মসজিদ আছে, সেটা ভেঙে থার্ড টেম্পল বা কিং সালমানের মূর্তি স্থাপন করতে হবে। এজন্য আবার তাদেরকে পবিত্র হতে হবে, তাদের ভাষ্যমতে, এখন তারা অপবিত্র অবস্থায় আছে। পবিত্র হওয়ার জন্য তাদের এক বিশেষ লাল গরুর প্রয়োজন হবে, যার মাধ্যমে তারা পবিত্র হবে। অর্থাৎ তাদের সেই মাসিহ যে দাজ্জাল তা বোঝাই যায় আর তাদের উদ্দেশ্যের মাঝে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে বিলীন করে দিয়ে সেখানে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আরেকটা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল আকসা মসজিদ ভেঙে দেয়া। এই উদ্দেশ্য সফল করতে হলে যে চরম এক সংকট তৈরি হবে তা বোঝাই যাচ্ছে। আর ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপটেই কিন্তু জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্বের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।

এখন আল আকসা মসজিদ ভেঙে দিতে গেলে সারা বিশ্বের মুসলমানের অন্তরে আঘাত লাগার মতো বিষয়। এই মসজিদের সঙ্গে মুসলমানদের আত্মিক যোগাযোগ। এই মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা। এখান থেকে প্রিয় নবী (স.)কে মেরাজে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্থাৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ধ্বংস করা বা আল আকসা মসজিদ ভাঙার মতো পদক্ষেপ নিতে গেলে বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবেই। আর সেই যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধই হতে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে মুসলিম বিশ্বের এখনই উচিত প্রচণ্ড চাপ দেয়া শুরু করা। চাপ দেয়ার আগে নিতে হবে কিছু চাপ। সেটা হচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে এগিয়ে আসতে বৃহৎ ঐক্যের মাধ্যমে। নিজেদের এই স্বার্থ রক্ষার্থে প্রথমে সবার মাঝে ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এখন কে শিয়া, এক সুন্নি এই দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সকল যুদ্ধ বিগ্রহের মূলে লুকিয়ে থাকে বৈশ্বিক বাণিজ্য। ইসরাইলের বাণিজ্যের পথকে যদি কঠিন করে তোলা যায় তাহলে কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। তাদের বিশ্বব্যাপী ব্যবসার যে জাল ছড়িয়ে আছে তাতে যদি ভাঙন ধরানো যায় তাহলে কাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। পশ্চিমা বিশ্বের সকলেই যে ইসরাইল বা আমেরিকার পক্ষে চোখ বন্ধ করে লড়াই করবে তা কিন্তু নয়। এই কারণে প্রথমে নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করার পরে ইসরাইল এবং আমেরিকার শত্রুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। প্রথমে নিজেদের সংগঠন ওআইসিকে শক্ত করে দাঁড় করিয়ে সবাই মিলে ভীত নাড়িয়ে দিতে হবে জাতিসংঘের।

এই যে সীমাহীন নির্যাতন চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী, তার ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। অনেক সামাজিক মিডিয়া ওদের দখলে হলেও, ওদের মিডিয়া দিয়েই ওদেরকে পরাহত করা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ইতিমধ্যেই স্ট্রাইকস ফর গাজা ভালোই একটা মাত্রা পেয়েছে, এটাকে বিশ্বব্যাপী জোরদার করে তুলতে হবে। ওদের তৈরি অস্ত্র দিয়েই ওদেরকে কাবু করার পাঁয়তারা করতে হবে।

আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা একটা জোয়ার তুলি, কিছুদিন পরে তা আবার মিইয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে। পণ্য বয়কটের একটা ডাক আসে মাঝেমধ্যে, কিন্তু এটাকে একদম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করতে হবে। আসলেই ইসরাইলের সঙ্গে জড়িত যেসব পণ্য আছে সেগুলোকে সঠিকভাবে বাছাই করতে হবে। ব্যবসায়িকভাবে আঘাত করার চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতায় রিপাবলিকান পার্টি, তাদের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক ক্ষমতাধর, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে কেউ তাদেরকে ছুঁতে পারবে না। প্রয়োজনে ডেমোক্রেটদের সঙ্গে এটা নিয়ে যোগাযোগ করতে হবে।

স্বাধীন ফিলিস্তিনের মাটিতে যে অত্যাচার ইসরাইল চালাচ্ছে তা বন্ধ করা জরুরি। ফিলিস্তিনকে তাদের পুরাতন সীমানায় ফিরিয়ে দিতে হবে। এভাবে জাতিগত নিধন অনেকেই অনেক সময় চেষ্টা করেছে করার জন্য, কিন্তু দিনশেষে প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছে। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও ব্যর্থ হবে নিশ্চিত, তবে আর কোনো ভাইয়ের যেমন জীবন না যায় তার জন্য রুখে দাঁড়াতে হবে, প্রয়োজনে মার্চ টু গাজা ডাক দিতে হলেও দিতে হবে। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম গুলির সামনে দাঁড়াতে শিখে গেছে। অনেকেই মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ঘুরে এসেছে। কেউ যদি নাও দাঁড়ায় বাংলাদেশের অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ জীবন দিতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু দাঁড়াতে  হবে ক্ষমতাধরদের, সৌদি, ইরান, তুরস্ককে সব ভেদাভেদ ভুলে ইরানের সঙ্গে শামিল হতে হবে সকলের পেয়ারে ফিলিস্তিন বাঁচানোর মহাযুদ্ধে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.