ইসরায়েলের কারাগার থেকে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দীরা সেখানকার সেনাসদস্য ও কারাকর্মীদের দুর্ব্যবহার ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন বিবিসির কাছে। দেশটির সেনাব্যারাক ও বিভিন্ন কারাগারে বন্দী নির্যাতন নিয়ে ইতিমধ্যে প্রকাশিত খবরগুলোর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো এ প্রতিবেদন।
মুক্তি পাওয়া বন্দীদের একজন মোহাম্মদ আবু তাইলেহ। ৩৬ বছর বয়সী গাজার বাসিন্দা তাইলেহ একজন মেকানিক। তিনি বলছিলেন, বন্দী থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে আগুন ধরে যায় শরীরে। এরপরের ঘটনা তিনি বর্ণনা করেন এভাবে, ‘গায়ে আগুন লাগার পর তা নেভানোর চেষ্টায় আমি পশুর মতো এদিক-ওদিক ছুটছিলাম।’
বিবিসি জানায়, মুক্তি পাওয়া বন্দীদের মধ্যে পাঁচজনের বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছে তারা। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী। ইসরায়েলের ‘আনলফুল কমব্যাট্যান্টস ল’–এর অধীন গ্রেপ্তার করা হয় এই ফিলিস্তিনিদের। এ আইনে দেশটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি, এমন ব্যক্তিদের কোনো অভিযোগ ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক করার বিধান আছে।
মুক্তি পাওয়া ওই পাঁচজন বলেছেন, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ করা হয়েছিল। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হেফাজতে থাকাকালে তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, গাজায় ইসরায়েলি জিম্মিদের অবস্থান ও বিভিন্ন সুড়ঙ্গ সম্পর্কে। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের নজিরবিহীন হামলার সঙ্গে তাঁদের যুক্ত থাকার কোনো প্রমাণ পায়নি কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় তাঁরা মুক্তি পেয়েছেন।
এই ফিলিস্তিনিদের কেউ কেউ ইসরায়েলিদের হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগে কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। তাঁরা কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন কি না, সে বিষয়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ও ইসরায়েলি কারা সার্ভিসের (আইপিএস) কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেয়নি।
বন্দীদের দেওয়া সাক্ষ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ
সাক্ষাৎকার দেওয়া বন্দীদের প্রত্যেকে বিবস্ত্র হওয়া, চোখ বাঁধা, হাতকড়া পরানো ও মারধরের শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন।
এই ফিলিস্তিনিরা কেউ কেউ এ-ও বলেছেন, তাঁদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, কুকুর দিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে। অসুস্থ হলেও তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা চোখের সামনে মরতে দেখেছেন অন্য বন্দীদের।
একজন বলেছেন, তিনি বন্দীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাতে দেখেছেন। অপর একজন বলেন, তাঁর মাথা রাসায়নিক পদার্থে চুবানো হয় এবং শরীরের পেছনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ড. লরেন্স–হিল কোথর্ন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ল’–এর সহপরিচালক। তিনি বলেন, ‘এই ব্যক্তিরা নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা আন্তর্জাতিক আইন ও ইসরায়েলি আইন উভয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। কিছু ক্ষেত্রে নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’
লরেন্স হিল-কোথর্ন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের অধীন সশস্ত্র সংঘাত নিয়ে থাকা আইনে সব বন্দীকে মানবিকভাবে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বন্দীদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা কোনো ধরনের অপরাধ বা ত্রুটির অভিযোগেই ক্ষুণ্ন করা যাবে না।’
বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়া পাঁচ ফিলিস্তিনিকে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আওতায় এ বছরের শুরুর দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। গাজা থেকে ৩৩ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত প্রায় ১,৯০০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছেড়ে দিয়েছে। ৩৩ জনের মধ্যে জীবিত ফিরেছেন ২৫ জন। বাকি আটজনের মরদেহ হস্তান্তর করেছে হামাস।
সাক্ষাৎকার দেওয়া পাঁচ ফিলিস্তিনির সবাই একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন—তাঁদের গাজা থেকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে সামরিক ব্যারাকে নেওয়া হয়। পরে কারাগারে পাঠানো হয়। কয়েক মাস পর ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁরা বলেছেন, গ্রেপ্তার করা থেকে মুক্তি—এ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে নির্যাতন করা হয়েছে তাঁদের।
গাজায় ফেরত আসা ফিলিস্তিনি বন্দীদের মধ্যে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁরাও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হেফাজতে ও কারাগারে থাকাকালে মারধরের শিকার হওয়া, ক্ষুধার কষ্ট ভোগ করা ও অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন বে’তসালেম ও জাতিসংঘকে মুক্তি পাওয়া অন্য ফিলিস্তিনি বন্দীদের দেওয়া সাক্ষ্যের সঙ্গে বিবিসির সঙ্গে কথা বলা ফিলিস্তিনিদের সাক্ষ্যের মিল রয়েছে। বে’তসালেম ও জাতিসংঘ গত বছরের জুলাই মাসে ফিলিস্তিনি বন্দী নির্যাতন নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বন্দীদের বিবস্ত্র করা; খাবার, পানি ও ঘুমাতে না দেওয়া; বৈদ্যুতিক শক ও সিগারেটের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া এবং কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার কথা উঠে এসেছে।
গত মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এক প্রতিবেদনে ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দীদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, হুমকি হিসেবে এগুলোর ব্যবহার আইডিএফের ‘মানসম্মত পরিচালনা পদ্ধতি’র অংশ। তবে ইসরায়েল এসব অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে।
গাজায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের প্রবেশের সুযোগ ইসরায়েলের তরফে বাধাহীন না থাকায় মুঠোফোনে ও খুদেবার্তার মাধ্যমে ওই ফিলিস্তিনিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। পাশাপাশি গাজায় চুক্তিবদ্ধ ফ্রিল্যান্সারদের সহায়তা নেওয়া হয়েছে।
এই পাঁচজনই বলেছেন, তাঁদের ওপর নির্যাতনের শুরু গ্রেপ্তার হওয়ার মুহূর্তটি থেকে। পরে তাঁদের বিবস্ত্র করা, চোখ বাঁধা ও মারধর করা হয়েছে।
এ পাঁচজনের একজন মোহাম্মদ আবু তাইলেহ বলেন, তাঁকে দিনের পর দিন নির্যাতন করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
তাইলেহ বলেন, গত বছরের মার্চে গাজা থেকে গ্রেপ্তার করার পর কাছাকাছি একটি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। একটি কক্ষে তিনি একা বন্দী ছিলেন। তিন দিন ইসরায়েলি সেনারা তাঁকে জিজ্ঞাসবাদ করেন।
এই ফিলিস্তিনি বলেন, পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যবহার করা রাসায়নিক একটি পাত্রে মিশিয়ে সেনারা তাঁর মাথা চুবিয়ে রাখেন। পরে জিজ্ঞাসাবাদকারীরা ঘুষি মারেন। এতে ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মেঝেতে তিনি পড়ে যান এবং চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর একটি কাপড় দিয়ে তাঁরা চোখ বাঁধলে ক্ষতস্থানের অবস্থা আরও খারাপ হয়।
তাইলেহ বলেন, সেনারা তাঁর শরীরে আগুনও ধরিয়ে দেন। তাঁর কথায়, ‘গায়ে আগুন লাগার পর তা নেভাতে আমি পশুর মতো এদিক-ওদিক ছুটছিলাম। এতে আগুন আমার ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।’ তখন সেনারা বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমাকে বারবার আঘাত করেন। তাঁদের সঙ্গে লাঠিও ছিল। তা দিয়ে তাঁরা আমাকে পেটাতেন ও খোঁচা দিতেন’, বলেন তাইলেহ। তিনি আরও বলেন, ‘তাঁরা আমাকে অ্যাসিড দিয়েও হামলা করেছেন। আর সে অবস্থায় আমি দেড়টা দিন কাটিয়েছি। চেয়ারে বসিয়ে তাঁরা আমার মাথায় অ্যাসিড ঢেলেছেন এবং তা আমার শরীরে গড়িয়ে পড়েছে।’
আবু তাইলেহর ওপর হামলার কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে বিবিসি কথা বলতে পারেনি। তবে গাজায় ফেরার পর তাইলেহর চিকিৎসা করা একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ রাসায়নিকে তাঁর চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আবু তাইলেহর দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে। এটি রাসায়নিক পদার্থ বা অন্য আঘাতজনিত কারণে হতে পারে।
তাইলেহর ক্ষতস্থানের ছবি ও তাঁর সাক্ষ্যের বিস্তারিত বিবিসি যুক্তরাজ্যের কয়েকজন চিকিৎসককে পাঠিয়েছে। তাঁরা বলেছেন, দৃশ্যত তাঁর শারীরিক অবস্থার সঙ্গে বক্তব্যের মিল রয়েছে। তবে ছবি দেখে তাঁরা যে মূল্যায়ন করেছেন, সেটির সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে।
বিবিসি তাইলেহর সাক্ষ্যের বিস্তারিত আইডিএফকে দিয়ে তা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। আইডিএফ তাইলেহর অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কোনো সাড়া দেয়নি। অবশ্য বলেছে, ‘তাদের মূল্যবোধের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ যেকোনো কর্মকাণ্ডকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেয় তারা।’
 |
| ফিলিস্তিনি বন্দীদের এভাবে নিপীড়নের ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরায়েল। ছবি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের ভিডিও থেকে নেওয়া |
 |
| ফিলিস্তিনি বন্দীদের কোথাও চোখ বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে, আবার কোথাও বসিয়ে রাখতে দেখা গেছে। ছবি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের ভিডিও থেকে নেওয়া |
No comments