পুলিশের খাতায় ১,২৪,৬৯৫ নারী-শিশু নির্যাতনকারীর নাম by শুভ্র দেব

দেশ জুড়ে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। সাত বছরে পুলিশের এজাহারনামায় উঠেছে সোয়া লাখ নারী ও শিশুর নাম। যারা এই সময়ে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পুলিশের দেয়া পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৯৫ জন নারী-শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ৭৬৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় মামলা করেছেন। ২০২০ সালে সেটি আরও বেড়ে ২২ হাজার ৫১৭ জন ভুক্তভোগী মামলা করেন। এভাবেই ২০২১ সালে ২২ হাজার ১৩৬ জন। ২০২২ সালে ২১ হাজার ৭৬৬ জন। ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৯৪১ জন। ২০২৪ সালে ১৭ হাজার ৫৭১ জন মামলা করেন। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০ জন মামলা করেছেন।

মামলার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই সময়টা সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা রেঞ্জে। পুলিশের এই রেঞ্জে প্রায় ২০ হাজার ৮৭টি মামলা হয়েছে। এরপরে বেশি মামলা হয়েছে চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১৫ হাজার ৩৪টি। পর্যায়ক্রমে রাজশাহী রেঞ্জে ১৪ হাজার ৮১টি। রংপুর রেঞ্জে ১৪ হাজার ৭২৭টি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৮৯০টি। ময়মনসিংহ রেঞ্জে ১০ হাজার ৯৯৩টি। খুলনা রেঞ্জে ১০ হাজার ৮২৮টি ও বরিশাল রেঞ্জে ৮ হাজার ৬০৪টি।  পুলিশের এসব ইউনিট ছাড়াও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি), রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি), রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি), গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি), সিলেট রেঞ্জ ও রেলওয়ে পুলিশের বিভিন্ন থানায়ও অনেক মামলা দায়ের হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডিএমপিতে ২০২৪ সালে ১ হাজার ৪৬০, ২০২৩ সালে ১ হাজার ৬০২, ২০২২ সালে ২ হাজার ১২, ২০২১ সালে ২ হাজার ২১৮, ২০২০ সালে ২ হাজার ১৯৮ ও ২০১৯ সালে ২ হাজার ৪০০টি মামলা হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জে ২০২৪ সালে ২ হাজার ৯২৮, ২০২৩ সালে ৩ হাজার ২৯১, ২০২২ সালে ৩ হাজার ৪৭৯, ২০২১ সালে ৩ হাজার ৫৫৯, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৩৯৮, ২০১৯ সালে ২ হাজার ৪৩২টি। ময়মনসিংহ রেঞ্জে ২০২৪ সালে ১ হাজার ৩৩২, ২০২৩ সালে ১ হাজার ৭৯৮, ২০২২ সালে ২ হাজার ১৭২, ২০২১ সালে ২ হাজার ১৫৫, ২০২০ সালে ১ হাজার ৮৬১ ও ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬৭৫টি। চট্টগ্রাম রেঞ্জে ২০২৪ সালে ১ হাজার ৯৭৫, ২০২৩ সালে ২ হাজার ২০, ২০২২ সালে ২ হাজার ৪৮৬, ২০২১ সালে ২ হাজার ৮২৩, ২০২০ সালে ২ হাজার ৮৮৮, ২০১৯ সালে ২ হাজার ৮৬০। খুলনা রেঞ্জে ২০২৪ সালে ১ হাজার ৫৫৫, ২০২৩ সালে ১ হাজার ৬৯৮, ২০২২ সালে ১ হাজার ৯৩২, ২০২১ সালে ২ হাজার ১৫, ২০২০ সালে ২ হাজার ১৩৫ ও ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪৯৩। বরিশাল রেঞ্জে ২০২৪ সালে ১ হাজার ৭১১, ২০২৩ সালে ১ হাজার ৩০১, ২০২২ সালে ১ হাজার ২৮৩, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩০০, ২০২০ সালে ১ হাজার ৪৩২ ও ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬৭৭। রাজশাহী রেঞ্জে ২০২৪ সালে ২ হাজার ২৫৪, ২০২৩ সালে ২ হাজার ২৮৯, ২০২২ সালে ২ হাজার ৬২৪, ২০২১ সালে ২ হাজার ৩১০, ২০২০ সালে ২ হাজার ৮৬১ ও ২০১৯ সালে ২ হাজার ৪৭৪। রংপুর রেঞ্জে ২০২৪ সালে ২ হাজার ২০০, ২০২৩ সালে ২ হাজার ৩৭৭, ২০২২ সালে ২ হাজার ৬৪৬, ২০২১ সালে ২ হাজার ৫২৯, ২০২০ সালে ২ হাজার ৫৪৩ ও ২০১৯ সালে ২ হাজার ৪৩২ জন ভুক্তভোগী নির্যাতনের শিকার হয়ে মামলা করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী ও শিশুরা প্রতিনিয়তই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ঘর থেকে শুরু করে পাড়াপ্রতিবেশী, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্তু অনেক ভুক্তভোগী এসব নির্যাতনের পরেও হয়রানি, মামলায় ঝক্কিঝামেলা, বিচার না পাবার শঙ্কা, প্রভাবশালীদের চাপ, হুমকি, মামলা পরিচালনা করতে অর্থের প্রয়োজন, লোক জানাজানি, সমাজ সেটিকে উল্টোভাবে নিবে এমন নানা কারণে আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে চান না। তাই হিসাবমতে, দেশে যে পরিমাণ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন। তবুও দেশের গতানুগতিক অপরাধ যেমন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, অপহরণসহ অন্যান্য অপরাধের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মামলা হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায়। অপরাধ ও সমাজ নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন ঠেকানোর জন্য সরকার অনেক আইন ও নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করে রেখেছে। কিন্তু সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় এমন অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না। এখানে মামলার তদন্ত, বিচারহীনতা, অপরাধীরা প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাওয়া, মামলার আলামত না পাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। কারণ অপরাধীরা এক সময় মনে করেন মামলা তাদের শাস্তি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে না। এর ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বের হয়ে যাবেন। এজন্য কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকে।  

সমাজ ও অপরাধবিজ্ঞানী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের আইন আছে। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া বা এই নির্যাতন বন্ধ করতে না পারাই একটি মৌলিক প্রশ্ন। আইন তৈরি করে সেটি বন্ধ করতে পারছে না কেন। আইনের জটিলতা বা চ্যালেঞ্জটা কোথায়। আরেকটা প্রশ্ন হলো যে আইন তৈরি হয়েছে সেটি যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা। এই দুটা প্রশ্নের সদত্তোর আমাদের দেশে নাই। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আইনে যে সাজার কথা বলা আছে সেটি সমাজে খুব বেশি প্রভাব ও সতর্কতা সৃষ্টি করে না। যেহেতু দ্রুত সময়ের ভেতরে বিচার সম্পন্ন হয় না, সময়ক্ষেপণ, বিচারহীনতার কারণে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন হয় সেটা থেকে অপরাধীরা মনে তারা পার পেয়ে যাবেন। পার পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে আমাদের দেশে।

তিনি বলেন, অধিকাংশ মামলাই হলো প্রান্তিক পর্যায়ের নারী ও শিশুদের। নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের নারী ও শিশুরা বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন। এই নারী ও শিশুদের  ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বলছে তাদের সুরক্ষার জন্য আইন করা হয়েছে, বিভিন্ন সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুরক্ষার জন্য কি কি আছে সেদিক দিয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। নারীদের সুরক্ষার জন্য সবই আছে। কিন্তু সেটি ঠিকমতো কাজ করছে না। শাস্তিভিত্তিক বিচার ব্যবস্থায় যদি বিচার না হয় দ্রুত সময়ের মধ্যে তাহলে ভুক্তভোগীর সংখ্যা বাড়বেই। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.