বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিপন্থি by ডা. রফিকুর রহমান
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। এটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে। সমাজের নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দেয়। মানুষের মননে অরাজকতার জন্ম দেয়। মানবিক সমাজ বিনির্মাণকে বাধাগ্রস্ত করে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন এখনো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায়ও কেন এখনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তা ব্যাখ্যা করতে একই কায়দায় প্রায় একই স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করা হচ্ছে; যা স্বৈরাচারী হাসিনার সময়কালের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হতো।
সম্প্রতি মানবজমিনে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় (২০শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার) রাজধানীর মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে দুইজন নিহত হয়েছেন। এ সময় পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। বুধবার দিবাগত রাত ১টার দিকে চাঁদ উদ্যান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত দু’জন চাঁদ উদ্যান এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মানবজমিন উল্লেখ করেছে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে যৌথ বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি চাঁদ উদ্যান এলাকায় বেশ কিছু সন্ত্রাসী বৈঠক করছে। এরই প্রেক্ষিতে যৌথ বাহিনীর একটি দল চাঁদ উদ্যানের লাউতলায় অভিযানে গেলে সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এ সময় আত্মরক্ষার্থে যৌথ বাহিনীর সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। এভাবে কিছুক্ষণ গোলাগুলি হয়। একপর্যায়ে পাঁচ সন্ত্রাসী আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারীদের আটকের সময় তাদের দুই সহযোগীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়। আটককৃতদের কাছ থেকে একটি রিভলভার ও কিছু গুলি পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।’
মানবজমিন পত্রিকায় ঘটনার দিনক্ষণ উল্লেখ না থাকলে এই সংবাদ পড়ে মনে হতো স্বৈরাচারী হাসিনার সময়কালের কোনো একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা। সেসময় ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের একটা মহোৎসব চলছিল বছরের পর বছর।
আজকের এই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনাও একই রকম, এ যেন কপি অ্যান্ড পেস্ট। যাই হোক, এর দায়ভার সরকারের ওপরই বর্তায়। ৫ই আগস্টের চেতনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সময়ে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়। এই সরকার জনগণের সরকার। লুটেরা এবং স্বৈরাচারী সরকারের মতো নয়। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট নিয়ে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত। যেকোনো বিবেচনায় এই সরকার বহু গুণে শক্তিশালী। কারণ, এ সরকার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী এবং বহু রক্ত দিয়ে কেনা।
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম নিহত দুইজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং ভয়ঙ্কর অপরাধী। তবে, অপরাধের মাত্রা যত বড়ই হোক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনো বিবেচনাই অনুমোদনযোগ্য নয়। এটা আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন। প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার রয়েছে জীবন ও নিরাপত্তার। আর এজন্যই অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব- এই অধিকার রক্ষা করা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এই অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর। আদালতে বিচারকার্য সম্পন্ন করে আসামি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর সে তার প্রাপ্য সাজা পাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিজ বিবেচনায় কাউকে কোনো ধরনের সাজা দেয়ার বিধান নেই। ৫ই আগস্টের চেতনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সময়ে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে যেখানে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির প্রত্যয় নিয়ে এই সরকার চলমান, সেখানে একই সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিন্দুমাত্র কোনো স্থান নেই। কোনোরকম কালক্ষেপণ না করে এই সংস্কৃতি থেকে এখনই বেরিয়ে আসতে হবে।
আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশীয় অস্ত্র বহনকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানে গিয়ে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি করলে সন্ত্রাসী নিহত হয়, সেই বিবেচনায় পুরনো পদ্ধতিতে অভিযানে না গিয়ে নতুন উন্নত কৌশল প্রণয়ন করতে হবে; যাতে প্রাণহানি বন্ধ করা যায়। প্রয়োজনে আধুনিক কৌশল রপ্ত করার জন্য বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ন্যায়বিচার একটি গণতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং আইনের শাসনকে একইসঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণ তাদের আস্থা হারায়। সরকারকে আর নিজের সরকার মনে করে না। সরকারের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বেড়ে যায়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা শুধু নৈতিক ও মানবিক দায়িত্বই নয়। এটি দেশের মানবাধিকারের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্যও অপরিহার্য।
লেখক: ডা. রফিকুর রহমান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
mdr.rafiqur@gmail.com

No comments