নাহিদরা নতুন বাসা খুঁজে পাবেন? by সাজেদুল হক

বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের অন্যতম চরিত্র তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। তার নামে এভিনিউ। পাশেই সংসদ ভবন। গণতন্ত্রের তীর্থস্থান। এখানে গণতন্ত্রের চর্চা কতোটা হয়েছে সে প্রশ্ন আলাদা। এই সংসদ ভবনকে সামনে রেখেই আজ আত্মপ্রকাশ ঘটতে চলেছে নতুন এক রাজনৈতিক শক্তির। এদেশের অলিতে-গলিতে রাজনৈতিক দল। গেল ক’মাসেই জন্ম হয়েছে অন্তত ১৬টি নতুন দলের। তবুও নাহিদ ইসলামদের নেতৃত্বে অভিষিক্ত দলটি নিশ্চিতভাবেই আলাদা। কেবল এ ভূমিতে কেন, এতগুলো তরুণ কবে, কোথায় কোন দলের জন্ম দিয়েছে কে জানে!

শহীদ মিনার থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ। গেল কয়েক মাসে কতো ঘটনাই না ঘটে গেল। ওলটপালট হয়ে গেল সব। কখনো কখনো এমন হয়। সময়ের চাকা ঘোরে খুবই দ্রুত। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে স্বৈরশাসকের পতন। দুনিয়ায় এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। আপাত মনে হবে আকস্মিক, অকস্মাৎ এক ঝড়। আদতে এ তরুণদের একটি অংশ নিজেদের তৈরি করেছে অনেকদিন ধরেই। রাজনীতি আর সমাজ নিয়ে নতুন করে ভেবেছে তারা। পড়েছে, পরামর্শ করেছে। অপেক্ষায় ছিল একটি মোক্ষম সময়ের। ইতিহাস তাদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে।

তবে ৩রা আগস্টের শহীদ মিনার আর ২৮শে ফেব্রুয়ারির মানিক মিয়া এভিনিউ এক নয়। শুধু স্থান আর সময় নয়। সেটা যে আলাদা বুঝতেই পারছেন। ভিন্নতা আসলে তার চেয়েও বেশি। নাহিদ ইসলাম। ২৬ বছরের এক তরুণ। গোয়েন্দা সংস্থার গোপন সেল ঘুরে এসেছেন। শরীরে নির্যাতনের দাগ। এসবও শেষ পর্যন্ত দমাতে পারেনি তাকে। শহীদ মিনার থেকে ডাক দেন একদফার। ঘোষণা দেন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের। সেই সমাবেশে শামিল ছিল হাসিনাবিরোধী পুরো বাংলাদেশ। বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল, শিবির, ডান, বাম, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়-এর সাধারন শিক্ষার্থী সবাই শামিল ছিলেন শহীদ মিনারে। কট্টর আওয়ামী লীগ ছাড়া রাজনীতির আর সব রং মুছে গিয়েছিল। কিন্তু ২৮শে ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া এভিনিউতে নাহিদ ইসলাম যখন নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন- পরিস্থিতি এরইমধ্যে অনেকটা পাল্টে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য সাবেক এই উপদেষ্টা এটা বুঝতে শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ তাদের শত্রু গণ্য করে তা স্পষ্ট। অনেক ইস্যুতে বিএনপি’র সঙ্গেও তাদের বাহাস-বিতর্ক হচ্ছে। জামায়াতের সঙ্গে তুলনামূলক কম। কিন্তু বিএনপি বা জামায়াত কেউই তো আজ আর মানিক মিয়া এভিনিউতে থাকছে না।

জুলাই আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে ইতিমধ্যে একটি ছাত্র সংগঠনের অভিষেক হয়েছে। যাত্রা শুরুর দিনই ঘটেছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হাতাহাতি আর বিশৃঙ্খলায় জড়িয়েছেন নতুন সংগঠনের সমর্থকরা। নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল স্পষ্ট। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে এ অভিযোগ উঠেছে জোরেশোরে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে তাদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। পুরো বাংলাদেশে আন্দোলনের রেখাটাই পাল্টে দিয়েছেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নেতারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন এটাও বলা হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক দল অভিষেকের আগেও নানা টানাপড়েন চলছে। বেগ পেতে হয়েছে নেতা নির্বাচনে। শিবিরের সাবেক দুই আলোচিত নেতা এরইমধ্যে নিজেদের নতুন দল থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। একটি রিপোর্ট বলছে, সামনের দিনে নতুন দলে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হতে পারে।
নতুন রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘বাংলাদেশমুখী, মধ্যপন্থি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক দল হিসেবে। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল অনেক। সকাল-বিকাল পার্টিরও কোনো অভাব নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে এর নেতাকর্মীরা বরাবরই সমালোচিত। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, ক্ষমতার দাপট দেখানোসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে যান তারা। বহিষ্কার-আবিষ্কারের খেলা চলতে থাকে। নতুন রাজনৈতিক দলের জন্যও এটি একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে। নাহিদ ইসলাম এরইমধ্যে তার একধরনের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করেছেন। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা নতুন নজির। পুরো দলের ক্ষেত্রেও আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা রাখতে হবে। দল চালাতে অর্থ প্রয়োজন হয়। সেটা কে না জানে। স্বচ্ছতাই এখানে মুখ্য বিষয়।

এই তরুণরা আর পাঁচ-দশটা তরুণের মতো নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকদের অন্যতম শেখ হাসিনাকে উৎখাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। ৫ই আগস্টের আগেও যেটাকে অসম্ভব মনে হচ্ছিলো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন, প্রয়োজন নতুন রাজনীতি। এই তরুণদের হাত ধরে যদি সেটা আসে তা হবে জাতির জীবনে এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। কিন্তু রাজনীতির পথ বরাবরই পিচ্ছিল। এখানে সফলতার সহজ-সরল কোনো পন্থা নেই। বিপ্লব বা অভ্যুত্থান এক ধরনের অস্থিরতাও তৈরি করে। পুরনো সব নিয়ম ভেঙে দেয়া কেবল মুখের কথা নয়।

ভারতীয় সাংবাদিক অর্ক দেব ফেসবুকে এক লেখায় ঢাকায় নাহিদ ইসলামের সঙ্গে তার সাক্ষাতের বিবরণ দিয়েছেন। নাহিদের রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নেয়া প্রসঙ্গে তিনি লিখেন, ‘নাহিদ, এই  যে বিরুদ্ধবাদীর চোখ বেঁধে ফেলা, আসলে এর উল্টোপথে হাঁটা শুরু আজ থেকে। মনে পড়ছে আপনার কালশিটে। মনে পড়ছে ব্যাডমিন্টন  কোর্টে দাঁড়িয়ে আপনার স্বগতোক্তি, ভাই নতুন একটা বাসা খুঁজতে হবে। আমরা সবাই নতুন বাসা খুঁজছি, যে বাসা সবার, পক্ষের-বিপক্ষের-প্রান্তিকের, বিশ্ব জুড়ে যাদের গায়ে মনে কালশিটে আজও, তাদের সবার।’

এখন প্রশ্ন হলো নাহিদরা কি সেই বাসা খুঁজে পাবেন। যে বাসা হবে বাংলাদেশপন্থিদের, মধ্যপন্থিদের। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাংলাদেশির জন্য যেখানে ইনসাফ পাওয়া যাবে। পুরনো শৃঙ্খল ভেঙে মিলবে মুক্তি। নাহিদরা একা নন। এমন বাসা, এমন দেশ তো আসলে আমরা সবাই খুঁজছি। যদিও জানি, পথটা বড্ড কঠিন।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.