বিনামূল্যে পাঠ্য বই: ২৭০ কোটি টাকা লোপাট by পিয়াস সরকার
পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা যায়, পাঠ্য বই ছাপাতে মূলত পাঁচ খাতে দুর্নীতি করা হয়েছে। বইয়ের আকারে সুক্ষ্মভাবে ছোট করা হতো। যার কারণে সেখানে খরচ কমে আসতো। কাগজের উজ্জ্বলতার জন্য নির্দিষ্ট মান থেকে কমিয়ে আনা হতো। আর এই অপরাধকে একপ্রকার বৈধতা দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ডা. দীপু মনি। পূর্বের বছরের পাঠ্য বই নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের ছাপানো বইয়ের কাগজের মান খারাপ নয়, রং কিছুটা ভিন্ন হলেও তা নিউজপ্রিন্ট নয়। ছাপানো কাগজ অনেক বেশি সাদা হলে তা চোখের জন্য তত ভালো নয়। আমাদের দেশে সবাই মনে করে বইয়ের কাগজ যত বেশি সাদা হবে তত বেশি ভালো কিন্তু তা নয়। আমাদের বইয়ের কাগজের উজ্জ্বলতা কিছুটা কম হলেও তা নিউজপ্রিন্ট নয়।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্য বই ছাপানো হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৪৫ কোটি ৬৪ লাখ ২৮ হাজার ৭৭৩ টাকা। এতে পাঠ্য বইয়ের প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠাসংখ্যার ক্ষেত্রেও করা হয় নয়ছয়। পাঠ্য বইয়ে প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠাসংখ্যা বেশি দেখিয়ে ছাপানো হয় এসব বই। আর বাঁধাইয়ের কাজেও নিম্নমানের সুতা ও আঠা ব্যবহারের অভিযোগও ছিল। একই মানের বই ছাপানো হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দরে। এনসিটিবি’র গুটিকয়েক কর্মকর্তা যাদের বইয়ের মান দেখভালের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তারাই কোটি কোটি টাকা লোপাট করেন।
২০২৩ সালের ছাপানো পাঠ্য বইয়ের কাজে অনিয়ম পেয়েছিল বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। সংস্থাটি জানায়, এসব অনিয়মের কারণে সরকারের প্রায় ২৪৫ কোটি টাকা লোপাট হয়। আর এ ছাড়াও দেনদরবার, উপঢৌকন ও অযাচিত বিলের কারণে আরও ২৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পত্র দেয়া হলেও যথাযোগ্য জবাব দেয়নি এনসিটিবি। পাঠ্য বই নিয়ে নানাবিধ সমালোচনা শুরু হলে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী গত মার্চে বলেছিলেন, কারও বিপক্ষে দুর্নীতির অভিযোগ মিললে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আদতে কোনো ব্যবস্থাই নেননি তিনি।
অডিট অধিদপ্তরের চিঠিতে বলা হয়েছিল, বই ছাপায় দরপত্রে অনিয়মের কারণে সরকারের ২৩৫ কোটি ৩০ লাখ ৫৭ হাজার ৭৮৫ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। চিঠিতে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং অর্থ আদায় করে এনসিটিবি’র তহবিলে জমা দেয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দেয়ায় অতিরিক্ত ৬ কোটি ৫৩ লাখ ৪১ হাজার ২৮৭ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এজন্য জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।
এছাড়া বই ছাপানোর কাজে গঠিত বিভিন্ন কমিটিকে অতিরিক্ত হারে ৬৪ লাখ ৭২ হাজার ৩০ টাকার অতিরিক্ত সম্মানী দেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটিতে তিনজন, মূল্যায়ন কমিটিতে সাতজন সদস্য থাকবেন। এই অতিরিক্ত সম্মানীসহ ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রাপ্যতা না থাকলেও সম্মানী ও উদ্দীপনা ভাতা দেয়ায়, আয়কর না কাটায়, অতিরিক্ত হারে প্রশিক্ষণ-কর্মশালা ভাতা ও নির্দিষ্ট সীমার বাইরে অতিরিক্ত অর্থ অগ্রিম দেয়ায় প্রায় ২৫ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে।
অধিদপ্তরের চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ৭ কোটি ৫৫ লাখ ৮ হাজার ১১২ টাকা অগ্রিম দেয়া হয়েছে। সার্ভিস চার্জ এবং প্রদত্ত সম্মানী থেকে আয়কর না কাটায় ৫ কোটি ৮৮ লাখ ১৩ হাজার ৬৭৬ টাকা এবং ভ্যাট আদায় না করায় ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬৩ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এসব অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে সুপারিশ করা হয়।
তথ্যমতে, সে বছর ২৮০টি লটে বই ছাপানো হয়। ৪৩ লটের বই ছাপানো হয় ২ টাকা ৬৮ টাকা করে। ২৩৭ লটের বই ছাপানো হয় ১ টাকা ৬৩ পয়সা দরে। একই মানের বই হওয়ার কথা থাকলেও ভিন্ন দামে বই ছাপানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছিল।
এনসিটিবি’র সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটিতে গত চার থেকে পাঁচ বছরে ব্যাপক পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে। আমাকেসহ কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছিল তাদের কথামতো না চলায়। এটার দুর্নীতি এতটাই স্ট্রং যে এটা ওপেন সিক্রেট ছিল। যার ভাগ সরাসরি যেত শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও পানি জাহাঙ্গীরের (শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী জাহাঙ্গীর আলম) কাছেও।
তিনি বলেন, এখন এসব দুর্নীতি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তদন্ত হলে এসব দুর্নীতির বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে আসবে। প্রথম ২০১৭ সালের দেয়া বইয়ে নিম্নমানের কাজ শুরু হয়। এরপর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় পরবর্তী বছর থেকে দুর্নীতি বাড়তেই থাকে। এরপর এমনি অবস্থা হয় যে ২০২৩ সালের পাঠ্য বইয়ে তারা নিজেদের ছেলে-মেয়ে ও পরিচিতজনদের জন্য আলাদাভাবে বই ছাপিয়ে নিতেন। বই মনিটরিংয়ের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৭৫ লাখ টাকা করে সম্মানী দেয়া হয়। কিন্তু জানা মতে, তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৫ লাখ টাকা। টিএ-ডিএ আরও ২ লাখ টাকার মতো। কিন্তু এই টাকা তারা আত্মসাৎ করেছেন। এই পুরো কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এনসিটি’র পূর্ববর্তী চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ফরহাদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রিয়াজুল হাসান বলেন, বিগত দিনে নানাবিধ অনিয়মের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরাও চাই এসব বিষয়ের তদন্ত হোক। উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি আর্থিক অনিয়ম বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রদান করে উপদেষ্টার দপ্তরে পৌঁছে দিতে।
No comments