এনটিএমসি যেভাবে নজরদারি করতো by কাজী সোহাগ
২০০৮ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মোবাইল অপারেটরদের অর্থায়নে ডিজিএফআই ভবনে ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) গঠিত হয়। পরে ২০১৩ সালের ৩১শে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এনএমসি পরিবর্তিত হয়ে ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)’ নামে নবরূপে আত্মপ্রকাশ করে। সংস্থাটি ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কার্যক্রম শুরু করে। ২০২২ সাল থেকে এনটিএমসি’র মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।
অভিযোগ রয়েছে- এনটিএমসি’র দায়িত্বে থাকাকালীন একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেন তিনি। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড তার নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে ছড়িয়ে দেয়া হতো। এসব কল রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে অনেক সুশীল সমাজের লোকজনকে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হতো। ৭টি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এনটিএমসি গঠন করা হলেও মূলত সরকার বিরোধীদের দমনে সংস্থাটি কাজ করেছে বলে দাবি করেছেন টেলিযোগাযোগ সংশ্লিষ্টরা। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় সরকারের নির্দেশক্রমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থাসমূহকে আইনানুগ ইন্টারসেপশন সুবিধা প্রদান এবং নির্ধারিত কর্তৃপক্ষকে যোগাযোগ সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা প্রদান। ৭ উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে- সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সকল প্রকার ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য আইনানুগ ইন্টারসেপশন এর কাঠামো তৈরি করা, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সংস্থাসমূহকে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে প্রচলিত ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমগুলোতে মনিটরিং ও নজরদারি করার ব্যবস্থা করে দেয়া, যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিগত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে সরকার কর্তৃক নির্দেশিত সংস্থাসমূহকে সরবরাহ করা হয়, ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেমের সচলতা ও কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২৪/৭ রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম চলায়মান রাখা, এনটিএমসি ও এনটিএমসি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের জনবলের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, যোগাযোগমাধ্যম ও তথ্য প্রযুক্তিগত বিষয়ে সার্বক্ষণিক গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রাখা এবং এনটিএমসি’র সকল প্রযুক্তি যুগোপযোগী করার মাধ্যমে চলমান ও ভবিষ্যৎ টেকনোলজির সঙ্গে বাংলাদেশের ইন্টারসেপশন সিস্টেমের সামঞ্জস্যতা বজায় রাখা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি, আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন করে ল’ফুল ইন্টারসেপশন কার্যক্রম গতিশীল রাখা।
বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটি এ ধরনের কাজের সঙ্গে খুব কমই সম্পৃক্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এই সংস্থার কার্যক্রম সংবিধান পরিপন্থি। সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদে চিঠিপত্র ও যোগাযোগের সকল মাধ্যমের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ এই সংস্থাটি গঠন করা হয় বিতর্কিত বরখাস্তকৃত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের পরামর্শে। মূলত নাগরিকের যোগাযোগে আড়িপাতা এবং নজরদারিতে রাখার জন্য সেইসঙ্গে ফোন কল, ফোনালাপ রেকর্ড, ইন্টারনেট ও বিভিন্ন অ্যাপে আড়িপাতা ছাড়া অন্য কোনো কাজই করেনি এই সংস্থাটি। মোবাইল অপারেটরদেরও বাধ্য করতো বিভিন্ন ধরনের মেসেজ গ্রাহকদের মাঝে প্রদান করতে। ফোনালাপ রেকর্ড এমনকি ভিডিও কলিং রেকর্ড করে অনেক সম্ভ্রান্ত নাগরিককে হেনস্তা করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তিনি বলেন, বিক্যাল মাউন্টেন ডাটা ইন্টার সেপ্টর এর মতো ভয়ানক যন্ত্র ব্যবহার করে আসছিল সংস্থাটি। এমনকি বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন বিতর্কিত ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এর কাছ থেকে পেগাসাস স্পাই ওয়ার কেনা হয়েছিল বলে দেশ ও বিদেশের স্বনামধন্য গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিকভাবেও বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা এর প্রতিবাদ করেছিলাম এবং তদন্ত চেয়েছিলাম। যদিও ওই সময়ের সরকার এ বিষয়ে বক্তব্যে বলেছিলেন- এই ধরনের যন্ত্রপাতি ইসরাইলের কাছ থেকে কেনা হয়নি।
পেগাসাস স্পাইবার অ্যাপটি গ্রাহকের কাছে ম্যালওয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হতো সংস্থার পক্ষ থেকে। অনেক গ্রাহক না বুঝেই ইন্সটল করলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের ব্যবহৃত ডিভাইসটি সংস্থার নিয়ন্ত্রণে চলে আসতো। এইভাবে নাগরিকদের সকল কার্যক্রমের তথ্য হাতিয়ে নিতো এই বিতর্কিত সংস্থাটি। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা এবং সংবিধান পরিপন্থি। সেইসঙ্গে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তাই দেশ জাতি এবং এবং সংবিধানকে সমুন্নত রেখে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা দেয়ার নিমিত্তে এ ধরনের সংস্থা বিলুপ্তি সময়ের দাবি এবং আবশ্যক। তাছাড়া এই সংস্থার অবৈধ যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। আমরা নাগরিকদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য ও সুরক্ষার স্বার্থে এই সংস্থার বিলুপ্তি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি করছি। এদিকে এনটিএমসি’র ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে- বিশ্বব্যাপী অবাধ তথ্য প্রবাহের কারণে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক অপরাধ সংঘটনের মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এতে আরও বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশ বলে এনটিএমসি’র অধীনে ৪৪ জন জনবল (২৩ জন কর্মকর্তা ও ২১ জন অন্যান্য পদবি) এর পদ সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হতে জনবল সমন্বয় করা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইবনে ফজল সায়েখুজ্জামান।
অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলা হয়, এনটিএমসি বিভিন্ন পর্যায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে ডিজিএফআই ভবনের সীমিত পরিসরে বিভিন্ন অবকাঠামোগত অসুবিধার সম্মুখীন হয়। যার ফলশ্রুতিতে জাতীয় নিরাপত্তায় এনটিএমসি’র ভূমিকার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ইং তারিখে নিজস্ব বিশেষায়িত ভবন নির্মাণের নির্দেশ দেয়া হয়। এনটিএমসি’র অফিস বিল্ডিং এর জন্য তেজগাঁও বিমানবন্দরস্থ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ত্রাণভাণ্ডার সংলগ্ন ০.৯৪ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রযুক্তির আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ ও ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে আইনপ্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ ইন্টারনেট ভিত্তিক অপরাধ কার্যক্রম তদন্তে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয় । উক্ত সমস্যা বিবেচনা করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিসরে এনটিএমসি’র সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন।
No comments