প্যারাসাইট ও গিরগিটি সংবাদ! by ডাঃ আলী জাহান

১. বেশ কয়েক বছর আগের কথা। কোনো একটা কারণে আমার পরিচিত ইংল্যান্ডের এক কাউন্সিলর সাহেবকে ফোন করেছি। ফোন ধরেই বললেন, আজকে রাতে একটি প্রোগ্রাম আছে, একটু পরে বেরিয়ে যাবেন। আমাকে পরে ফোন দেবেন। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘কার প্রোগ্রাম, কিসের প্রোগ্রাম? উনি বললেন, ‘বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক বিচারপতি এসেছেন, আজ রাতে তার একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আছে। আমি সেখানেই যাচ্ছি।’ আমি সেই বিচারপতির নাম জিজ্ঞেস করলাম। শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম যে এই বিচারপতির সংবর্ধনা সভায় এ কাউন্সিলর সাহেব যাচ্ছেন। অবৈধ সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কাউন্সিলর সাহেব সব সময় সোচ্চার। আর সেই অবৈধ সরকারের অবৈধ বিচারপতির সংবর্ধনা সবাই যাবার জন্য উনি পাগল হয়ে গেছেন! আমি একটু হোঁচট খেলাম। কাউন্সেলর সাহেব কি প্যারাসাইট নাকি গিরগিটি?

২. ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যে প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে, সেখান থেকে অটো পাশের মতো এমপি হয়েছেন এমন লোকজনকে বিলেতের মাটিতে তার দলীয় লোকজন সংবর্ধনা দেবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমারই কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব বা জুনিয়র যারা এই নির্বাচনকে মেনে নিতে পারেনি, তারাই এই অবৈধ নির্বাচনের নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। কিছু দাওয়াত পত্র আমার মোবাইলেও চলে আসে। কপাল ভালো যে বিনা ভোটের এমপি এবং মেয়রদের যে সম্বর্ধনা বৃটেনে দেওয়া হয়েছে সেখানে আমার যাওয়ার হিম্মত হয়নি। যাওয়ার রুচি হয়নি।

৩.
এখন আবার নতুন রোগের আবির্ভাব হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা নতুন উপদেষ্টাদের সাথে কোনো এক সময় কারো হয়তো দেখা হয়েছে, ছবি তোলা হয়েছে। এখন সেই লোকগুলো প্রধান উপদেষ্টা বা নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অথবা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে তোলা অতীতের ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কিছু মানুষ বলতে চায় ‘উনি কিন্তু আমার জানি দোস্ত ছিলেন’! আমি কিন্তু শুধুমাত্র কটাই মিয়া বা মজর আলী নই! পরিতাপের বিষয় হলো যে অনেক শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত লোকজনকে এমন কর্ম করতে দেখেছি।

৪. উপরের ঘটনাগুলো দেখে আপনার কাছে মনে হবে কিছু মানুষ আসলেই পরজীবী বা প্যারাসাইট। তাদের নিজস্ব কিছু দেবার নেই। নিজস্ব কোনো অবলম্বন নেই। অন্যের খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠাকে নিজের নামের বা ছবির সাথে জুড়ে দিয়ে একটু বাজার পাবার চেষ্টা করছেন। এই মানুষগুলো হচ্ছে পরজীবী বা প্যারাসাইট। সমস্যা হচ্ছে যে পরজীবী বা প্যারাসাইটকে আমরা বাগানে বাড়তে দিই না। কিন্তু মানুষ নামক এর পরজীবী গুলোকে বাড়তেই দিচ্ছি। মনে রাখবেন, এই পরজীবীগুলো এক সময় কিন্তু আসল গুলোকে খেয়ে ফেলবে!

৫. সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে (০৫.০৮.২৪) আরেক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। সে গোষ্ঠীকে বলা যেতে পারে গিরগিটি গুষ্টি। গিরগিটি হচ্ছে এমন সরীসৃপ প্রাণী যারা নিজেদের রং সহজেই পরিবর্তন করতে পারে। আমার দেখাশোনা অনেক কট্টর এবং অন্ধ প্রাক্তন সরকারের সমর্থক এখন রঙ বদলিয়েছেন। ফেসবুক থেকে আগের সব পোস্ট ডিলিট। এখন সুন্দর সুন্দর বাণী দিচ্ছেন। ‘এমন স্বাধীনতা তো আমাদের কাম্য ছিল না! আমি সব সময় রক্তপাতের বিরুদ্ধে! দেশের শান্তির পায়রারা ডানা মেলে উড়ুক।’ এমন সব হাবিজাবি কথা তাদের পোস্টে দেখবেন। নিজের পিতা মাতা এবং অভিভাবককে নিয়ে কোনো পোস্ট না দিলেও রাজনৈতিক পিতা-মাতা এবং অভিভাবকদের নিয়ে তারা নিয়মিত পোস্ট দিতেন। এই লোকগুলো এখন রঙ বদলিয়েছে। আগের অভিভাবকদের নিয়ে কোনো লেখালেখি না নেই। সবগুলো পোস্ট ফেসবুক থেকে ডিলিট করে দিয়েছেন। এখন শুধু অপেক্ষায় আছে কোথাও সামান্য ভুল ত্রুটি বা ফাঁক ফোকর পাওয়া যায় কিনা। আমার এক বন্ধু এদের নাম দিয়েছে ‘আফসোস পার্টি’!

৬. খেয়াল করে দেখবেন গত ১৪ বছরে আপনার/আমার পরিচিত অনেক মানুষই দানবে পরিণত হয়েছে। এক সময় যে এদের চলে যেতে হবে, বা মরে যেতে হবে তা কখনো চিন্তা করেছেন কিনা সন্দেহ হয়। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করেছে এরা। সেই হত্যাকারীদের কেউ কেউ এখন গিরগিটি হয়েছে। তাদের বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউ প্যারাসাইট হয়েছে। সময় হয়েছে এই গিরগিটি এবং পরজীবীদের সাথে সম্পর্ক ছেদ করার, এদের চিনে রাখার। আপনি না করলেও এই রাষ্ট্র কিন্তু তা করবে। গিরগিটি এবং পরজীবীদের বলি, আপনারা মানুষ হোন। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকুন। মনুষ্যত্ব নিয়ে বেঁচে থাকলে আপনাকে গিরগিটি বা পরজীবীদের মুখোশ নিতে হবে না। অভিশপ্ত জীবন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে না। এখানেই থাকতে পারবেন। মানুষ হয়ে। গিরগিটি বা প্যারাসাইট হয়ে নয়।


লেখক-
কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য
প্রাক্তন পুলিশ সার্জন, যুক্তরাজ্য পুলিশ
alijahanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.