মাতৃদুগ্ধের প্রসার বাড়াতে যা করণীয় by মো. রহমত উল্লাহ

শিশু বিশেষজ্ঞ বো ভালকুইস্টের মতে স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজনন চক্র আবর্তিত হয় দুটো ধাপে। একটি গর্ভধারণ আরেকটি বুকের দুধ খাওয়ানো। যেকোনো একটি ধাপের চর্চা ব্যতিরেকে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমানে মানবশিশু জন্মের পরে অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধাপটির চর্চা অবহেলিত রয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত যে জন্মের পরে মাতৃদুগ্ধের চেয়ে শিশুর জন্য উত্কৃষ্ট খাবার আর হতে পারে না। মাতৃদুগ্ধ প্রদানে সঠিক চর্চা করার মাধ্যমে যেমন শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব হয় তেমনি সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্যও প্রত্যক্ষ কল্যাণ বয়ে আনে।

বুকের দুধে বাচ্চার জন্য প্রয়োজনীয় সকল খাদ্য উপাদান সঠিক মাত্রায় বিদ্যমান, পাশাপাশি বুকের দুধ সর্বাধিক নিরাপদ খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। শিশুকে প্রক্রিয়াজাত দুধ খাওয়াতে মাকে খাবার তৈরি করতে যেমন কষ্ট পোহানোর দরকার পড়ে বুকের দুধ খাওয়াতে তেমনি কষ্টের কোনো বালাই থাকে না। এতে করে মায়ের কষ্ট ও সময় উভয় যেমন বাঁচে তেমনভাবে শিশু তার উপযুক্ত খাবার পেয়ে বেড়ে উঠতে পারে।

বুকের দুধ খাওয়ানোর চর্চা শিশুর মৃত্যুঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি শিশুকে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

বুকের দুধ খাওয়ানোর সঙ্গে নানা সূচক জড়িত। এর মধ্যে অন্যতম হলো জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ পান করানো এবং ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো। বিশ্বব্যাপী জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর (Early Initiation of Breastfeeding) হার ৪৪ শতাংশ এবং ইউনিসেফ গ্লোবাল ডাটাবেজ ২০১৮ অনুযায়ী বাংলাদেশে এ হার ৫০.৮ শতাংশ। ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানোর (Exclusive Breastfeeding) হার ৪০ শতাংশ এবং ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন-এর রিপোর্ট অনুয়ায়ী ২০১৮ সালে বাংলাদেশে এ হার ৫৫ শতাংশ। ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী মাত্র ২৩টি দেশ ৬০ শতাংশের ওপর এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং বা ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করতে পেরেছে। বুকের দুধ খাওয়ানোর বৈশ্বিক সূচকের চেয়ে দৃশ্যত বাংলাদেশ খানিকটা এগিয়ে থাকলেও এসব সূচকে আরো উন্নতি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

দ্য কস্ট অফ নট ব্রেস্টফিডিং শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে প্রতিবছর ৬৯৪৩২২ মৃত্যুর পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত নিয়মে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর চর্চা না করা। আর্থিক হিসেবে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইউনিসেফের তথ্য বলছে এদের মধ্যে ৫৯৫৩৭৯টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুর ক্ষেত্রে। ৯৮২৪৩ নারীর মৃত্যু ঘটে সঠিক উপায়ে সন্তানকে দুধ না খাওয়ানোর কারণে স্তন, জরায়ু ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিলতায়। বিশ্বব্যাপী শিশু স্থূলতার পেছনে সবচেয়ে বড়ো কারণ মাতৃদুগ্ধ না খাওয়ানো। ইউনিসেফের মতে ৯৭৪৯৫৬টি স্থূলতার ঘটনার পেছনে দায়ী সঠিক উপায়ে বুকের দুধ না খাওয়ানো।

ল্যানসেট ব্রেস্টফিডিং সিরিজের এক গবেষণায় দেখা গেছে সঠিক উপায়ে বুকের দুধ খাওয়ানোর চর্চা শুরু করতে পারলে প্রতিবছর বিশ্বে ৮২৩০০০ শিশুমৃত্যু এবং ২০০০০ মাতৃমৃত্যু ঠেকানো সম্ভব এবং ৩০০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি রোধ করা সম্ভব। অ্যালাইভ এন্ড থ্রাইভের গবেষণা বলছে সঠিক নিয়মে বুকের দুধ খাওয়ানোর চর্চা বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫৯৪৮টি শিশু এবং ৬১০ জন মায়ের মৃত্যু রোধ করতে সক্ষম। তাদের হিসেবে আরো বলছে বাংলাদেশে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাবার কিনতে অভিভাবকদের বার্ষিক খরচ ৫৩৪ মিলিয়ন ডলার এবং স্বাস্থ্যখাতে বুকের দুধ না খাওয়ানোজনিত রোগের চিকিত্সায় সরকারের ব্যয় প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার।

বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ানোর দায়িত্ব শুধুমাত্র মায়ের ওপর বর্তায় না। এটি একটি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। বিশ্বব্যাংকের ফ্রেমওয়ার্ক ফর নিউট্রিশন অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী বুকের দুধ খাওয়ানোর হারকে প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্জন করতে হলে ৫.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার কমিউনিটি পর্যায়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাতৃদুগ্ধের প্রসার বাড়াতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নতিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটি একটি মাইলফলক হিসেবে হাতছানি দিবে।

>>>লেখক :শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

No comments

Powered by Blogger.