চা-চিত্র: লঙ্কা চায়ের মানবীয় ভূগোল by ফ্রান্সিস বুলাতসিঙ্ঘালা

শ্রীলংকা ২০১৮ সালের জুলাই মাসে চা প্রবর্তনের ১৫১তম বার্ষিকী উদযাপন করবে। পাতা-মরা রোগে প্রথম অর্থকরী ফসল হিসেবে কফির পরীক্ষা ব্যর্থ হওয়ার পর ব্রিটিশ নাগরিক জেমস টেলর চা নিয়ে মাঠে নামেন। ১৮৬৭ সালে ক্যান্ডির লুকান্দুরা প্লান্টেশনে প্রথম চা চাষ করা হয়। ভারতের আসাম থেকে চারা নিয়ে লাগানো হয়েছিল সেখানে।
শ্রীলংকা চায়ের গল্প আসলে মানুষেরই গল্প। এর আনসাঙ হিরোরা হলো শ্রীলংকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাগান-কর্মীরা। এসব নারী-পুরুষকে ১৮৩০-১৮৮০ সময়কালে তালাইমানারের নর্থ ওয়েস্টারমসি বন্দরে জাহাজযোগে আনা হয়েছিল। সেখান থেকে তারা ঘন জঙ্গল দিয়ে পায়ে হেঁটে সদ্য বন কেটে ক্যান্ডি, নওয়ারা ইলিয়া ও তালাওয়াকেলের মতো স্থানে তৈরি করা বাগানে পৌঁছেছিল। অনেক শ্রমিক পথেই মারা পড়েছিল। অন্যরা প্রাণ হারিয়েছিল ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য সংক্রমণ রোগে।
বর্তমানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সব বাগান-কর্মীকে শ্রীলংকার নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা দ্বীপদেশটির বহুমুখী সামাজিক আবরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সংগ্রহ করা চায়ের পাতা জমা দিচ্ছে শ্রমিকরা
শ্রীলংকার চা শিল্পের ইতিহাসের সাথে দ্বীপটির উপনিবেশ আমলের ইতিহাসও ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন।
চা-বাগান ১৯৯০-এর দশক থেকে পুরোপুরি স্থানীয় মালিকানায় চলে এলেও বাগানের সাথে জড়িত দাস-শ্রমিকদের উপনিবেশ সম্পৃক্ততা এখনো রয়ে গেছে। আবার চা তোলার কাজ প্রায় পুরোপুরি নারীদের হাতে থাকায় এটি নারীদের সংগ্রামের কাহিনীও।
স্বাদে ও গন্ধে শ্রীলংকার চা অতুলনীয়। এ চা ভারতীয় ও কেনিয়ান চায়ের সাথে পাল্লা দেয়। অবশ্য বর্তমানে শ্রমিক সঙ্কট ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় শ্রীলংকার চায়ের সেই সুনাম হুমকির মুখে পড়েছে।
তাদের না-বলা কাহিনী ভাসে চাপের কাপে
চল্লিশ বছরের রানি। ক্ষিপ্র পায়ে চা-বাগান দিয়ে হাঁটছেন। দূর থেকে মনে হবে, তিনি সবুজ কার্পেটের উপর দিয়ে চলছেন। সকালের রোদে চা-পাতা ভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই পাতাই তার জীবিকা ছিল। কেবল তার নয়, তার পূর্বপুরুষদেরও রুটি-রুজির উৎস ছিল এই চা পাতা। এখন অবশ্য আয়া হিসেবে কাজ করেন।
বয়স যখন ছিল ১৮, তখন থেকেই তিনি চা-বাগানে কাজ করেন। কোনো রকমে নাম লিখতে পারেন তিনি। আসলে তাদের পড়াশোনা করার মতো কোনো ব্যবস্থাও তার শৈশবে ছিল না। ফলে পড়াশোনা অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠিন ব্যাপারেও পরিণত হয়েছিল।
তবে নিজে পড়াশোনা করতে না পারলেও তিনি তার সন্তানদের পড়াচ্ছেন। তিনি চান তার সন্তানরা যেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হন। এখন অবশ্য তার আয় বাড়ায় তিনি সন্তানদের পড়াশোনার ব্যয় মেটাতে পারছেন। তার সময়ে তেমনটি করা সম্ভব ছিল না।
তবে তা কেবল তার একার আয় দিয়ে হচ্ছে না। তার স্বামী কাজ করেন কলম্বোতে একটি দোকান সহকারী হিসেবে। এতেই তার পক্ষে অনেক কাজ সহজ হয়ে গিয়েছে।
নতুন একটি সড়কে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছেন রানি
তিনি অবশ্য অনেক কিছু থেকে এখনো বঞ্চিত। তিনি জানান, ‘আমার চাকরি খণ্ডকালীন। মুখের কথাতেই হয়তো একদিন চাকরিটি চলে যাবে। তখন আবার তাকে হয়তো চা-বাগানে ফিরে যেতে হবে।
তিনি জানান, আয়ার কাজে তিনি মাসে অন্তত ২০ হাজার টাকা আয় করেন। পরিশ্রমও খুব নয়। চা-শ্রমিক হিসেবেও তার আয় প্রায় একই ছিল। তবে তা ছিল অনেক বেশি পরিশ্রমের। তখন তাকে পোকামাকড়ের কামড় খেতে হতো, জোঁক ধরত, ঠাণ্ডায় ভুগতে হতো। ছুটিছাটাও তেমন পাওয়া যেত না। তাছাড়া থাকতে হতো ঘিঞ্চি মেসে। মালিকদের সাথে চা-শ্রমিকদের সম্পর্কও সবসময় মধুর থাকে না।
দুনিয়া যে ছোট নয়, সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি চা-বাগান থেকে সরে গেছেন। তার মেয়ে পড়াশোনা করছে কাছের একটি চার্চে। ইংরেজিতেই হয় পড়াশোনা। এ নিয়ে তার গর্বও কম নয়।
এই রানিই বলে দিচ্ছে, চা-শ্রমিকদের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা চা শিল্পে নিয়োজিত থাকলেও পরবর্তী প্রজন্ম সম্ভবত এই পেশায় থাকবে না। তাহলে চা-শিল্পের কী হবে? শ্রমিক না থাকলেও তো চা-বাগানও থাকবে না। এ নিয়ে চা-শ্রমিকরা কী ভাবছে?
রানিই জানালেন, চা-পাতা কে তুলবে, তা আমার কাজ নয়। আমাদের সবার দিন-রাতের ভাবনা হলো, আমাদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করা। বাগানে বন্দি থাকার নিয়তি আমরা মেনে নিতে পারি না। তারা আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না, আমরা কেন তাদের দিকে তাকাব।
তার প্রকাশভঙ্গি ও স্বরই বলে দিচ্ছে, তারা এখন নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ভাবছেন।
চা-বাগানটির কাছাকাছি থাকা ছোট একটি গির্জায় দুই তরুণ নানকে দেখা গেল। তারাও এখন পড়াশোনার কথাই ভাবছে। তাদের মাথায় ভর করে আছে বিজ্ঞান, গণিত আর ইংরেজি।
সবুজ দিগন্ত
তবে চা বাগানের মালিকদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। ক্যান্ডি জেলার গালাসার একটি চা-বাগানের কথাই ধরা যাক। সেখানকার বেশির ভাগ শ্রমিকের বয়স ৫০ বছরের বেশি। নতুন শ্রমিক পাওয়া কঠিন। এমনকি স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাগানে কাজ করবে এমন কাউকেও পাওয়া যায় না।
বাগান-মালিক জানান, ১০ বছর পর চা তুলবে কে? তবে তিনি যতটা হতাশ, তার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী তার মেয়ে ততটা নন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করলে ব্যাপক পরিবর্তন আনবেন বলে পরিকল্পনা করছেন। তিনি একদিকে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন। তাছাড়া শ্রমিকদের জুতার মতো সামগ্রীও দেওয়ার কথা ভাবছেন। ফলে কম শ্রমিকেও বেশি উৎপাদন হবে।
কিন্তু তাতে তো খরচ বেড়ে যাবে অনেক। এখনই দামের কারণে চা-শিল্প বেশ সঙ্কটে পড়েছে। দাম আরো বেড়ে গেলে বাজার পাওয়া কঠিন হবে বৈকি।
তবে তারা পরিবর্তন আনুন বা না আনুন, শ্রীলংকার চা-শিল্পে ইতোমধ্যেই পরিবর্তনের ঢেউ লেগে গেছে। অবশ্য তা হচ্ছে ধীরে ধীরে।

চা-বাগানেও একটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। বাগানের আকার ও মালিকানায় নতুনত্ব আসছে। অনেক চা-শ্রমিক পর্যন্ত এখন যৌথভাবে বাগান কিনছে। অবশ্য এসবের আয়তন বেশ ছোট। এমন একটি উদাহরণ হলো ৩৫ বছরের রাতনাভেলি। তিনি পূর্বসুরীদের থেকে পাওয়া তার বিশাল বাগানের একটি অংশ বেশ কম দামে শ্রমিদের কাছে বিক্রি করেছেন। তারা এখন যৌথভাবে এটি পরিচালনা করছে। নিজের জমিতে কাজ করতে হওয়ায় এসব শ্রমিক পারিশ্রমিক নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামান না।
ছোট চা-বাগান মালিক-শ্রমিকদের বিষয়টি তদারকির জন্য গড়ে ওঠেছে টি স্মল হোল্ডার্স অথোরিটি। এসব বাগান যাতে লাভজনক হয়, তা-ই দেখা এই সংগঠনের অন্যতম দায়িত্ব। রাতনাভেলি একসময় শিক্ষকতা করতেন কাছের একটি স্কুলে। এখন তিনি চা নিয়ে কাজ করছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে জানান, যে ফসলটিকে একসময় দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করা হতো, তা এখন মুক্তির বার্তা বয়ে আনছে।

No comments

Powered by Blogger.