দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সামরিক প্রশিক্ষণকে কীভাবে চিরতরে বদলে দিয়েছিল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যেখানে ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সাত কোটিরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল, ওই যুদ্ধের পর মার্কিন সামরিক বাহিনী একটি আশ্চর্যজনক উপসংহারে আসে। আর তা হল: যথেষ্ট হত্যাকাণ্ড হয়নি। অথবা আরও ভালভাবে বলতে গেলে: মার্কিন সেনারা হত্যাকাণ্ডে যথেষ্টভাবে অংশ নেয়নি।
সেনাদের অভিজ্ঞতা যেমনই থাকুক, অথবা শত্রুরা তাদের জীবনের জন্য যতোটাই হুমকি হয়ে থাকুক- ওই যুদ্ধে ১০ জন পুরুষের স্কোয়াডে, লড়াইয়ের সময় গুলি চালিয়েছিল গড়ে প্রায় তিনজনেরও কম সেনা।
মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক এবং ইতিহাসবিদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্যামুয়েল লিম্যান অ্যাটউড মার্শাল, যিনি এস.এল.এ. মার্শাল বা 'স্ল্যাম' নামে বেশি পরিচিত, তার কয়েকটি লেখা থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর মার্কিন মেরিন সদস্যরা পতাকা উত্তোলন করছে।
তিনি সামরিক জার্নালে এমন বেশ কয়েকটি নিবন্ধ লেখেন, যা দিয়ে পরবর্তীতে তাঁর বই, 'মেন এগেইনস্ট ফায়ার' বের করা হয়।
তার কাজ তখন থেকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে - অনেকে তার বিরুদ্ধে সরাসরি জালিয়াতির অভিযোগও আনে- তবে তার এই লেখা সে সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে বিপ্লব ঘটিয়েছিল।

হত্যার অনুপাত

মার্শাল লিখেছেন, "পদাতিক বাহিনীর একজন কমান্ডারের প্রতি নির্দেশ ছিল, যেন তিনি মাথায় রাখেন যে তার সৈন্য সংখ্যার তুলনায় যদি শত্রু পক্ষের সেনা সংখ্যা এক চতুর্থাংশ বা তার কম থাকে, তাহলে সেই যুদ্ধে তার সেনারা বড়ধরনের কোন আঘাত হানতে পারবেন না,"
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনা ট্রিগার-চাপতে কি লজ্জা পেতেন?
"আনুমানিক ২৫% শত্রুও যদি, ভালভাবে প্রশিক্ষিত হয় এবং অভিজ্ঞ সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়, তাহলেও ওই ৭৫% সেনা, তাদের শত্রু এবং শত্রুদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে গুলি চালাতে পারবে না। এই সেনারা বিপদের মুখোমুখি হলেও তারা লড়াই করবে না, " তিনি বলেন।
মার্শাল পরে এই সংখ্যাটি গড়ে ৭৫% থেকে ৮৫%-এ উন্নীত করেন।
ইউরোপীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন পদাতিক বাহিনী চরম বিপদের মুখোমুখি হয়েও কেন অস্ত্র চালাতে চান না?
মার্শাল ভাবতেন এর পেছনে কারণ দুটি - প্রথমত সংখ্যাগরিষ্ঠরা সবসময় সংখ্যালঘুদের লড়াইয়ের সব কাজ করতে দেবে এবং দ্বিতীয়ত, বর্তমান সভ্যতা আমেরিকানদের "আগ্রাসনের ভয়" দেখিয়েছে যা তাদের লড়াই করতে বাধা দেয়।
যুদ্ধে সৈন্যদের কোন কিছু চিন্তা না করে বা আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে সহজে গুলি চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে হয়।
মার্শালের গবেষণা সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করার পদ্ধতি পরিবর্তন করেছিল।
তাঁর মতে, সাধারণ আমেরিকানরা সহজাতভাবে খুব শান্ত ছিল। এ কারণে হত্যার প্রবণতা তৈরি করার জন্য নতুন কৌশল বের করা হয়েছিল। যেন সেনাদের ভেতর থেকে মমতাময় মানুষটাকে বের করে দেয়া যায়।
বিশিষ্ট ব্রিটিশ সামরিক ইতিহাসবিদ স্যার জন কিগান বিশ্বাস করেছিলেন যে "মার্শালের লেখার আসল উদ্দেশ্য নিছক বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করা ছিল না ...বরং আমেরিকান সেনাবাহিনীকে এটা বোঝানোর জন্য ছিল যে তারা যুদ্ধগুলোয় ভুলভাবে লড়াই করছে"।
তিনি আরও যোগ করেন: "মার্শালের যুক্তিগুলো কাজের ছিল। ইতিহাসবিদ হিসেবে তার অভিজ্ঞতাও ছিল সবার চেয়ে আলাদা। কেননা তাঁর এই বার্তা যে শুধু তাঁর নিজের জীবনে জায়গা পেয়েছিল তা-ই না। বরং সামরিক অনুশীলনের জন্য অনুবাদ করাও হয়েছিল।
মার্শাল নিজেই দাবি করেন যে তাঁর গবেষণায় সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে সাড়া দিয়েছে এবং তার "রেশিও অব ফায়ার" তত্ত্বকে আরও উন্নত করেছে।
গবেষণা দাবি করেছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সেনারা তাদের অস্ত্র বেশি ব্যবহার করেছে।
এখানে রেশিও অব ফায়ার বলতে দুই পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে গুলি করার অনুপাতকে বোঝানো হয়েছে।
কোরিয়ান যুদ্ধে মিস্টার মার্শাল তার কাজ অব্যাহত রাখেন এবং রিপোর্ট করেন যে রেশিও অব ফায়ার বা দু পক্ষের মধ্যে গুলির অনুপাত আগের চাইতে ৫৫% বেড়েছে।
ভিয়েতনামে এই অনুপাত আরও বেশি বেড়েছিল। এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে ৯০% মার্কিন সেনা শত্রুপক্ষের ওপর তাদের অস্ত্র থেকে গুলি ছুঁড়েছে।

মেথোডলজি

মার্শাল পরে "দ্য ইউনিট ইন্টার্ভিউ আফটার কমব্যাট" নামে একটি অভিযান শুরু করেন। অর্থাৎ যুদ্ধের পর পুরো বাহিনীর সাক্ষাতকার নিতে শুরু করেন তিনি।
তিনি রণাঙ্গনে সৈনিকদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন - তিনি দাবি করেন যে যুদ্ধের পরপরই তিনি মোট চারশো'র বেশি সেনার সঙ্গে কথা বলেছেন যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
সেনারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুদ্ধের সময় তারা এবং তাদের সহকর্মীরা কী করেছিল তা বর্ণনা করেন এবং মার্শাল সেগুলোর নোট নেন- যদিও মার্শালের সমালোচকরা বলছেন যে এর মধ্যে খুব কম নোটবুক পাওয়া গেছে।
কিছু মার্কিন সেনা মার্শালের সাথে তাদের সাক্ষাৎকারের কিছু বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
আরও লক্ষ্য করার বিষয় হল, মার্শাল কখনই আহত হওয়া সেনাদের, অথবা যারা মারা গিয়েছেন তাদের সাক্ষাৎকার নেননি।
মার্শাল তাঁর তত্ত্বটি তৈরির পর দাবি করেন যে জার্মান ও জাপানি উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় মার্কিন সেনাদের সিংহভাগ, শত্রুর বিরুদ্ধে গুলি চালাতে খুব ভয় পেয়েছিল।
তারা মরার জন্য ভয় পায় নি, বরং হত্যা করার ব্যাপারে ভয় পেয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ওয়াশিংটনে ফিরে, জেনারেলরা এসব কথা শোনেন।

প্রশিক্ষণ কৌশল

মার্কিন রাইফেলম্যানরা প্রাথমিক প্রশিক্ষণে সাধারণত দূর পাল্লার "বুলস আই" ধরণের লক্ষ্যমাত্রা ব্যবহার করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্শালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে
তবে প্রকৃত যুদ্ধ পরিস্থিতির সাথে এই প্রশিক্ষণের মিল ছিল সামান্যই। এবং প্রকৃত মানুষের উপর গুলি চালানোর জন্য সৈন্যদের প্রস্তুত করা হয়নি।
এ কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, সেনাবাহিনী মানুষের অবয়বকে লক্ষ্যবস্তু করে তা প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার শুরু করে।
আশা করা হয়েছিল, এটি আগ্রাসনের ভয়কে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
এখন লক্ষ্যবস্তু বিভিন্ন দূরত্বে "পপ-আপ" করে, অর্থাৎ হঠাৎ হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং তা দেখার সাথে সাথে রাইফেলম্যানকে দ্রুত গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়। যাতে সহজাতভাবে শত্রুকে দ্রুত মোকাবেলা করা যায়।

বিতর্ক

মার্শালের গবেষণাকে পুরো সামরিক বাহিনী সমর্থন করেনি।
তার এই গবেষণা এক পর্যায়ে তার খ্যাতির ওপর মারাত্মক আঘাত হানে।
কেননা কয়েকজন সৈনিক যারা মার্শালকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন পরে তারা জানান যে, তারা যুদ্ধে গুলি ছুঁড়েছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে মার্শাল তাদের কিছু জিজ্ঞাসাই করেননি। পাশাপাশি তার নোট নেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
১৯৪০-এর দশকে মার্কিন সেনারা বুলস আই-এর মতো সাধারণ টার্গেট ব্যবহার করত
এছাড়া, কিসের ভিত্তিতে মার্শাল এমন ব্যাখ্যায় এসে পৌঁছেছেন সেটা প্রমাণ করাতে তিনি তাঁর পরিসংখ্যানগুলোর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারেননি।
ক্যানাডিয়ান লেখক রবার্ট এঞ্জেনের মতে: " মার্শাল তার যুদ্ধ নিয়ে পূর্ব-কল্পিত ধারণার ভিত্তিতে তার ঐ বিখ্যাত রেশিও অব ফায়ারস বা গুলি চালানোর আনুপাতিক হিসাবে তৈরি করেছিলেন এমন সম্ভাবনা রয়েছে।"
"এই সূক্ষ্ম ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য - মার্শাল 'স্কলারলি মায়োপিয়ায়' ভুগছিলেন। যাকে বলা হয় পণ্ডিতদের দৃষ্টিক্ষীণতার সমস্যা। এ কারণে তিনি শুধু তাই দেখেছেন, যা তিনি দেখতে চেয়েছেন।"
তবে তাঁর অন্যান্য কিছু দাবি রয়েছে যার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল - তিনি বলেছিলেন যে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং পুরো আমেরিকান এক্সপেডিশনারি বাহিনীর সবচেয়ে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন - যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।
মার্শালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশিরভাগ গবেষণা সন্দেহজনক।
তিনি কেবল একজন অফিসার হিসাবে ১৯১৯ সালে কমিশন লাভ করেন এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক পরে ইউরোপে তিনি কেবল সৈন্যদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁর বক্তব্যগুলো প্রবীণ যোদ্ধাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে মার্শালের কারণে তাদের খ্যাতি কলঙ্কিত হয়েছে।
এক পুরানো কোম্পানির সার্জেন্ট মার্শালের তত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন, "এসওবি কি ভেবেছিল যে আমরা সংঘবদ্ধভাবে জার্মানদের মেরে ফেলেছিলাম?"
মার্শাল ১৫% থেকে ২০% এর যে হিসাবটি দিয়েছিলেন, তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এখনও অনেক বিশিষ্ট সূত্র প্রায়শই তা উদ্ধৃত করে থাকে।
তবে মার্শালের কাজ যে সেনা প্রশিক্ষণে অনেক প্রভাব ফেলেছে, এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এটি বিশ্বের সেনাদের অনেক বেশি দক্ষ হত্যা-যন্ত্রে পরিণত হতে সহায়তা করেছে।
আগ্রাসী বেয়নেট আক্রমণ এখনও মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষণে শেখানো হয়

No comments

Powered by Blogger.