ধর্মের চেয়ে জাতীয়তাবাদই চরমপন্থাকে বেশি উদ্দীপ্ত করে: ফাতিমা ভুট্টো by ইন্তিফাদা পি বাশির

চরমপন্থা, বিচ্ছিন্নতা ও অ-সার্বজনীনতা হলো ফাতিমা ভুট্টোর নতুন উপন্যাস দি রানওয়েজের প্রধান থিম। উপন্যাসটি অনিতা, মন্টি ও সানি নামের তিন তরুণের জীবনরেখার ওপর ভিত্তি করে এগিয়েছে। তারা ইসলামি স্টেটের অগ্রযাত্রার সময় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ইরাক পাড়ি দিয়েছিলেন।
ফাতিমা ভুট্টো ইতোমধ্যেই একটি কাব্য গ্রন্থ, দুটি নন-ফিকশন (এর মধ্যে তার স্মৃতিকথা সংস অব ব্লাড অ্যান্ড সোর্ডও রয়েছে), দুটি ফিকশন রচনা করেছেন। দি ওয়্যারের সাথে সাক্ষাতকারে তিনি চরমপন্থী দলে যাওয়া তরুণদের কেন এভাবে উপস্থাপন করলেন তা জানান। তিনি মনে করেন, এসব তরুণের ভয়াবহ ভুল পথে যাওয়ার আগে তাদের সাথে সহানুভূতিসূচক আচরণ করা উচিত ছিল।
প্রশ্ন: আপনার গ্রন্থের মূল থিম হলো চরমপন্থা। আইএসআইএসের আকস্মিক উত্থানের কারণেই নাকি পাকিস্তানের ঘরের কাছে এর উত্থান ও অনেক পাকিস্তানি তাতে যোগ দেয়ার কারণে আপনি এই বিষয়টি বেছে নিয়েছেন?
ফাতিমা: এ নিয়ে বেশ ঝামেলার মধ্যে পড়েছি বলেই আমি এ নিয়ে লিখেছি। আমার বয়স এখন ৩৬। ফলে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ আগেকার ঘটনাবলী মনে আছে। ওই সময় আমার পাসপোর্টের রং বা আমার ধর্ম বেশির ভাগ লোকের মধ্যে কোনো ধরনের হুমকি সৃষ্টি করত না। তবে তরুণ প্রজন্ম এই নির্যাতনমূলক ছায়ার যুগকে দেখতে পাচ্ছে।
পাকিস্তান অবশ্যই দুর্ভোগ পুহিয়েছে। এই দেশের মাটির ওপর যেসব তরুণের রক্ত পড়েছে, তাদের মা-বাবাকে কী বলবেন? আইতজাজ হাসানের পরিবারকে কী বলবেন? একটি আত্মঘাতী বোমা হামলা থেকে দুই হাজার ছাত্রকে রক্ষার জন্য মানবঢাল হিসেবে নিজেকে ব্যবহার করে সে প্রাণ দিয়েছে। তরুণ ও নির্দোষ লোকজনের বারবার আত্মত্যাগ করার ঘটনা আমার কাছে হৃদয়বিদারক মনে হয়েছে।
অপাশ্চাত্য দেশের ব্যথা পাশ্চাত্য বুঝতে পারে না। তারা চরমপন্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ মিথ্যা ভাষ্য নির্মাণ করেছে। আর তাই তাদেরকে তাদের যুদ্ধ, তাদের দখলদারিত্বের অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে। অনেক কারণেই উপন্যাস রচনা করা যায়। তবে লিখতে যখন বসেছি, তখন মাত্র কয়েকটি বিষয়ই মাথায় ছিল।
প্রশ্ন: তিন মুখ্যচরিত্র এসেছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট থেকে। আপনি কি বিশ্বাস করেন, আজকের কোনো ধনী মুসলিম কিশোর অনিতার মতো গরিব খ্রিস্টান মেয়ের মতো ইসলামি চরমপন্থী হওয়ার প্রবণতায় থাকবে?
ফাতিমা: আমি একে মোটেই ইসলামি চরমপন্থা বলছি না। আজকের দুনিয়ার দিকে তাকান। চরমপন্থা কোনো এক ধর্মের লোকজনের তালুক নয়। তরুণরা বিশ্বজুড়ে থাকা ক্রোধ ও সহিংসতার কাছে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
যেকোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে জাতীয়তাবাদের মাধ্যমেই চরমপন্থা সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত হয়। গবেষণায় বিষয়টি বারবার দেখা গেছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ২০০০-এর প্রথম দিকের প্রতিটি আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত ছিল তারা, ধর্মীয় নয়। নিউজিল্যান্ডে ২৮ বছরের সন্ত্রাসীর ৫০ জন মুসলিমকে হত্যার ঘটনাটি দেখুন। রাজনীতি ও তার জাতীয়তাবাদের ঘৃণাপূর্ণ ব্যাখ্যাই তাকে এ পথে ঠেলে দিয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম তিন চরিত্রের কাহিনী অনেকটাই ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়া ব্রিটিশ কিশোরী শামিমা বেগমের মতো। ব্রিটেনের অনেকে তার প্রত্যাবর্তনের অধিকারের বিরোধিতা করে বলছে, সে কোনো ধরনের ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। রানওয়েজে সানি তার সিদ্ধান্তের চরম প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে শামিমার পথই বেছে নিয়েছে। আপনি কি মনে করেন, এসব তরুণের ব্যাপারে এটিই সঠিক পথ?
ফাতিমা: দেখুন, শামিমা জন্মগ্রহণ করেছে ব্রিটেনে, শিক্ষাগ্রহণ করেছে ব্রিটেনে, চরমপন্থীও হয়েছে ব্রিটেনে। ব্রিটেন থেকেই সে বিপর্যয়কর সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে গেছে। তাহলে কিভাবে ব্রিটেন তার হাত মুছে ফেলবে। সে নাগরিক, তার অধিকার আছে। সে যদি কোনো অপরাধ করে থাকে, তবে তার বিচার হতে পারে, তাকে পুনর্বাসন করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, ১৫ বছরের একজনকে কিভাবে পাসপোর্ট ছাড়া আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো? কর্তৃপক্ষ কেন জিজ্ঞাসা করেনি, তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে এখন অনুশোচনা করছে, সে তিনটি মাসুম শিশু হারিয়েছে। আমি মনে করি, সে তার সিদ্ধান্তের জন্য অবিশ্বাস্য রকমের যন্ত্রণা ভোগ করেছে।
এসব তরুণ একাকিত্ব ও ক্রোধের কারণে দুনিয়ার বিরুদ্ধেই অবস্থান গ্রহণ করেছ। এসব ভয়াবহ ভুলের আগেই তাদের সাথে সহানুভূতিশীল আচরণ করা উচিত ছিল। রানওয়েজে সানি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি তার প্রথম বিকল্প ছিল না। সে একটা আশ্রয় চেয়েছে। কিন্তু পায়নি। এ কারণেই সে ভয়ঙ্কর পথটি বেছে নিয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি ইরাকের একটি জিহাদি ক্যাম্প বেছে নিয়েছেন কেন? কেন তা বাড়ির আরো কাছে হলো না? আপনি কি পাকিস্তানের সন্ত্রাসী উপস্থিতি এড়াতে এ কাজ করেছেন?
ফাতিমা: আমার উপন্যাস দায়েস সম্পর্কে, পাকিস্তান সম্পর্কে নয়।
প্রশ্ন: নরেন্দ্র মোদি ও ইমরান খানের মতো প্রধানমন্ত্রীদের এ ধরনের চরমপন্থা ও নিঃসঙ্গতা দূর করতে কী ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মনে করেন?
ফাতিমা: যেকোনো নেতার কাজ হলো তার দেশের তরুণদের কাছে একটি ভিশন উপহার দেয়া, এবং তরুণরাও যে ওই ভিশনের অন্তর্ভুক্ত তা নিশ্চিত করা। লোকজন যখন মর্যাদাপূর্ণ কাজ পায়, বাড়ি পায়, সহানুভূতি পায়, তখন তারা মারার জন্য কোথাও যায় না। দেশে যদি তাদের সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়, তবে তারা কোনো অবস্থাতেই অস্ত্র হাতে তুলে নেবে না।
লেখক: দিল্লিভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.