শহুরে কল্পকথা by আফিয়া আসলাম

আমার মাথাটা একটা আবর্জনার ভাঁগাড়ের মতো। আবর্জনা একটু নাড়াচাড়া করলে চালু একটা টোস্টারও পেয়ে যেতে পারো।‘ এই ঘোষণা দিয়েছেন আবদুল্লা কে। তিনি হলেন এইচ এম নাকভির দি সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব আবদুল্লাহ দি কোসাকের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
নাকভির বহুল প্রতীক্ষিত দ্বিতীয় উপন্যাস প্রমাণ করেছে যে আবদুল্লাহ কের আত্ম-মূল্যায়ন ঠিক ছিল এবং সেজন্যই এটি পড়তে ভালো লাগে। তিনি তার কথার সত্যতা প্রমাণ করে আলতা-ফালতু কাজ করেন, বোকার মতো কথা বলেন। তার এসব কাণ্ডকারখানা একদিকে যেমন মজাদার, আবার বিজ্ঞ পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যও। আমরা টোস্টার না পেলেও এই রচনা থেকে দারুণ কিছু পেয়ে যাই।
আব্দুল্লাহ কে (আকা দি কোসাক) এক ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য। তবে তাদের মা-বাবার মৃত্যুর পর পরিবারটির সদস্যরা আলাদা হয়ে যায়। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। স্বজনেরা তাকেই তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে করতেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তিনি কুঁড়ের বাদশাহ হিসেবে সানসেট লজে দিন গুজরান করতেন। সেখানে তার সাথে থাকতেন তার ধার্মিক রক্ষণশীল ছোট ভাই ও একেবারেই সাদামাটা ওই ভাইয়ের স্ত্রী বাবু ও নার্গিস।
আবদুল্লাহ কের নির্বাচিত রচনাবলী আসলে একটি আত্মজীবনী। তিনি তার ৭০তম জন্মদিনে তিনি তার জীবনে ঘটা নানা কথা লিখতে শুরু করেছিলেন। বইটি তারই ধারাবাহিকতা।
অন্যান্য বই থেকে তার গ্রন্থটিকে যে বিষয়টি আলাদা করেছে তা হলো তিনি সারা জীবনে ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম ও শিল্পকলা নিয়ে যে জ্ঞান সঞ্চয় করেছিলেন, তাই তিনি পরিণত বয়সে নিজের বিশ্লেষণে উপস্থাপন করেছন। এটিই বইটিকে আকর্ষণীয় করেছে। তিনি নিজেকে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সামনে আনতে পেরেছেন।
বর্তমান ইংরেজিতে লেখালেখি করেন, এমন দুই বিখ্যাত পাকিস্তানি লেখকের একজন হলেন নাকভি। অপর জন হলেন মোহসিন হামিদ। তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে, অর্থ খাতে। পরে তিনি পাকিস্তানে থিতু হন, লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। তার লেখালেখির উপর ৯/১১-পরবর্তী ঘটনাবলীর প্রভাব রয়েছে। হামিদের দি রেলাকট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। আর নাকভি ওই বছরই দেশে ফিরে আসেন। দুই বছর পর তার প্রথম উপন্যাস হোম বয় প্রকাশিত হয়। নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমবিরোধী যে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়েছিল, তাই তিনি তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে।
তবে দেশেও তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। ওয়ার অন টেররের কারণে তিনি করাচিতেও সহিংসতা আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন।
করাচির এই দুরাবস্থার কথা কেবল তিনি নন, আরো অনেকের লেখাতেই ফুটে ওঠছে। মোহাম্মদ হানিফের ২০১১ সালের আওয়ার লেডি অব অ্যালিস ভাট্টি, বিলাল তানবিরের ২০১৪ সালের দি স্কটার হেয়ার ইজ টু গ্রেট, শানদানা মিনহাজের ২০১৬ সালের ড্যাডিস বয়েস ওইসব দিনের কথাই তুলে ধরেছে।
নাকভির হোম বয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পাকিস্তানি অভিবাসীদের ওপরই জোর দেয়া হয়েছে। তবে সমসাময়িক অন্যান্য পাকিস্তানি লেখক কিন্তু করাচির বাস্তবতা তুলে ধরার দিকে মনোযোগী হয়েছেন। হোম বয়ে করাচির ভূমিকা খুব বেশি বিস্তৃত নয়, তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি ২০০৯ সালে ফর্বেস ম্যাগাজিনে স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, তিনি তার বন্ধুদের নিয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে করাচিতে কিভাবে গিয়েছিলেন। একই ধরনের সফর করা হয়েছে দি সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব আবদুল্লাহ দি কোসাকে। এই সফর জিন্নাহর সমাধি থেকে শুরু হয়ে একটি হিন্দু মন্দিরে শেষ হয়েছে। তার বইয়ের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো করাচির সাংস্কৃতিক জীবন।
তার বইটির সফলতা তাকে করাচির সাহিত্যিক সমাজে স্থায়ী আসন নিশ্চিত করে। এরপর থেকে তিনি বার্ষিক করাচি লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে (কেএলএফ) নিয়মিত সদস্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সেখানে অনেকেই তার সাথে সাক্ষাত করতে বেশ আগ্রহী থাকে। তাছাড়া সন্ধ্যায় এই প্রিয় লেখকের সন্ধান অনেকেই পেয়ে থাকেন রোডসাইড ক্যাফেতে।
সময়ের পরিক্রমায় তার লেখার বিষয়বস্তুও পাল্টে যাওয়ার বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই দৃষ্টিগোচর হয়। তার হোম বয় ছিল ৯/১১-এর উপন্যাস। আর দি সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব আবদুল্লাহ দি কোসাকে ছিল চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরকে কেন্দ্র করে।
অবশ্য তার লেখার ধারাটি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে, তিনি একটু জটিলভাবেই লেখালেখি করছেন। আবার ধর্ম, রাজনীতি, খাবার ইত্যাদি নিয়ে তিনি বেশি গুরুত্ব দেয়ায় অনেকেই ধৈর্যচ্যুতির শিকার হয়েছেন।
কিন্তু তারপরও নাকভির রচনা কাছে টানবেই। সময়ের পরিক্রমায় করাচির সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে যে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, তিনি সে দিকে নজর দিয়েছেন ভালোমতোই। পাঠককে এই পরিবর্তনকে ভালোভাবেই দেখিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। তিনি বৃদ্ধ, ধনী ও হেরে যাওয়া লোক। রোদের সময় বাইরে বের হলে তিনি সঙ্গে ছাতা নেন। তিনি শিশুদের ভালোবাসেন। তিনি সঙ্ঘাত এড়িয়ে চলেন, ব্যবসায়ের সিদ্ধান্তও নিজে নিতে যান না। অন্য কথায় বলা যায়, তিনি কারো প্রতি, এমনকি পাঠকের প্রতিও কোনো ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেন না। আর সেটাই বোঝা যায় বাবু আর নার্গিসকে কিভাবে তিনি কাছে টেনে নিয়েছেন তা দেখে।
লেখক: সাবেক সম্পাদক, পেপারকাটস ম্যাগাজিন, সহ-প্রতিষ্ঠাতা, দেশি রাইটার্স লঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.