আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সেই ডন by রুদ্র মিজান

আজিজ মোহাম্মদ ভাই। অপরাধ জগতের পুরনো রাজা। একটা সময় ছিল বাংলাদেশে মাফিয়া ডন বলতে তাকেই বুঝানো হতো। হত্যা, মাদক পাচার, শেয়ার কেলেঙ্কারি-পাপের খতিয়ান দীর্ঘ। ছিলেন পর্দার আড়ালে। অনেকদিন ধরেই দেশছাড়া। থাইল্যান্ডে গড়ে তুলেছেন বসত। সেই আজিজ মোহাম্মদ ভাই নতুন করে আলোচনায় এসেছেন।
তার গুলশানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রীতিমতো তাজ্জব বনে গেছেন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সেখানে খোঁজ মিলেছে বিপুল পরিমাণ মাদকের। ছিল আধুনিক সব ক্যাসিনো সামগ্রী। এ বাড়িতে অবশ্য অনেকদিন পা পড়ে না আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের। থাকেন তার স্বজনরা। মাঝে মাঝে আসতেন আজিজের স্ত্রী।
অপরাধ জগতে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে নানা কাহিনী। ডিসকো, মদ, নারী তার খুব পছন্দের। নাচ আর গানেও পারদর্শী তিনি। ঢাকায় থাকার সময় নাচ-গান জানা বান্ধবীদের নিয়ে প্রায়ই পার্টিতে যেতেন। তার গান শুনে মুগ্ধ হতেন অনেকে। ২৭শে জুলাই ১৯৯৮- প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, এমনি এক পার্টিতে তার বান্ধবী বিয়ার চেয়ে না পাওয়ায় ঘটে যায় তুলকালাম কাণ্ড। চলচ্চিত্র প্রযোজনায় এসে ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে তৈরি হয় নানা স্ক্যান্ডাল। এমনকি ভারতীয় কোনো কোনো অভিনেত্রীও তার ডাকে ছুটে আসতেন ঢাকায়। এরশাদের শাসনামলে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। প্রিন্স আগা খানের সুপারিশে সেসময় তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন এমন আলোচনা আছে। ১৯৯৬ সালে কিংবদন্তির নায়ক সালমান শাহ’র রহস্যময় মৃত্যুর পর তুমুল আলোচনায় আসেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। সালমান শাহকে হত্যার অভিযোগ ওঠে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে। সালমান শাহর মৃত্যুর দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে ঢাকা ক্লাবে খুন হন আরেক চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। এ হত্যাকাণ্ডেও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ১৯৯৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারবাজার  থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই মামলায় গত বছরের ২৯শে আগস্ট তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। তার ভাতিজা আমিন হুদাকে ২০০৭ সালে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
আজিজ মোহাম্মদ ভাই অপরাধ জগতের এক রহস্যময় চরিত্র। ভাই তার পারিবারিক উপাধি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ভারতের কানপুর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন আজিজের বাবা মোহাম্মদ ভাই। পরের বছর থেকে ব্যবসায় নামেন। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্টিল মিল। আজিজের জন্ম আরমানিটোলায়। অল্প বয়সেই পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি নিজেও আলাদা ব্যবসা শুরু করেন। তাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ওয়ান ইলেভেনের একদিন আগেই আজিজ মোহাম্মদ ভাই দেশ ত্যাগ করেন। দুই পুত্র ও তিন কন্যার জনক আজিজ দীর্ঘদিন ধরেই স্ত্রী নওরিনকে নিয়ে থাইল্যান্ডে বসবাস করছেন।
আজিজের গুলশানের বাড়িতে যা হতো
ঢাকায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের হয়ে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য তদারকি করেন তাদের মধ্যে একজন ওমর মোহাম্মদ ভাই। তিনি আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ভাতিজা। নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে বৈধ-অবৈধ বাণিজ্য পরিচালনা করছিলেন দীর্ঘদিন থেকে। শুদ্ধি অভিযানে ক্যাসিনো হোতাদের অনেকে গ্রেপ্তার, অনেকে আত্মগোপনে গেলেও ওমর মোহাম্মদ ভাই ছিলেন বহাল তবিয়তে। গুলশান-২ এলাকায় নিজেদের বাড়িতেই মিনি বার ও ক্যাসিনো পরিচালনা করছিলেন দীর্ঘদিন থেকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে এই বাড়িটি যেন পরিণত হতো ভিন্ন এক জগতে।
রোববার বিকালে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের দুটি বাড়িতে অভিযানের পর গতকাল গুলশান থানায় এ বিষয়ে দুটি মামলা দায়ের করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের টিমের উপস্থিতি টের পেয়ে বাসা থেকে দ্রুত পালিয়ে যান ওমর মোহাম্মদ ভাই। তবে আটক করা হয় তার সহযোগী নবীন মণ্ডল ও মোহাম্মদ পারভেজকে। তারা দুজনেই গুলশানের ওই দুটি বাড়িতে পরিচালিত মাদক, বার ও ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের দেশি-বিদেশি অতিথি, বন্ধু, ঘনিষ্ঠদের জন্যই এই বারটি গড়ে তোলা হয়েছিল। এখানে নিয়মিত আড্ডা দিতেন দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। পরবর্তীতে বারটি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন ওমর মোহাম্মদ। বিদেশ থেকে মদ আমদানি করে মজুত রাখা হতো দুটি বাড়ির দুই ফ্ল্যাটে। পার্টি হতো ৫৭ নম্বর সড়কের ১১/এ নম্বর বাড়ির ছাদে। ওই ছাদেই গড়ে তোলা হয়েছে সুসজ্জিত বার।
সূত্র মতে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই বাড়ির পার্কিংয়ে একের পর এক জড়ো হতো কালো গ্লাসঘেরা বিলাসবহুল গাড়ি। গাড়ির দরজা টেনে বের হতেন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সঙ্গে থাকতেন সুদর্শনা নারী। বাড়ির ষষ্ঠ তলার ছাদের সুসজ্জিত বিশাল কক্ষে তখন ইংরেজি, হিন্দি গানের মিউজিক। পার্টিতে অংশ নিতেন বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষ। ডেকে আনা হতো শিল্পীদেরও। লাইভ কনসার্ট হতো মাঝে-মধ্যে। এমনকি চলচ্চিত্রের নায়িকা, নৃত্যশিল্পী ও মডেলরা অংশ নিতেন পার্টিতে। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বুঁদ হয়ে উপভোগ করতেন স্বল্প বসনা তরুণীদের নাচ, গান। পার্টিতে অংশ গ্রহণকারীদের পছন্দ অনুসারে আমদানি করা হতো বিলাতি মদ। প্রয়োজন অনুসারে মজুত থেকেই বারে মদ আনা হতো।
মদের সঙ্গে টাকা উড়তো ৬তলা এই ভবনের ছাদে। রাত ভর চলতো ক্যাসিনো। এই ক্যাসিনোতে ঢাকার প্রথম শ্রেণির কিছু ব্যবসায়ী এবং বিদেশিরাও অংশ নিতেন। প্রতিরাতেই বিপুল টাকার খেলা হতো এখানে। খেলা হতো ডলারে। বনানী এলাকার প্রভাবশালী এক বাসিন্দা সঙ্গী-সাথী নিয়ে এই আয়োজনে অংশ নিতেন। তবে তিনি ক্যাসিনো খেলতেন না। মূলত মদ ও নারীর আড্ডায় অংশ নিতেন তিনি। শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর ক্যাসিনো বন্ধ রাখা হয়েছিল বলে গ্রেপ্তাররা জানিয়েছে।
ওমর মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের। রাশিয়া, চীন ও থাইল্যান্ড থেকে প্রায়ই আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের রেফারেন্সে বিদেশিরা ওই পার্টিতে যেতেন। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসায় অবৈধভাবে মদ মজুত রেখে বিক্রির বিষয়ে তথ্য পেয়ে রেকি করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি টিম। পরে রোববার বিকালে গুলশানের ৫৭ নম্বর সড়কে একই দেয়াল ঘেরা দুটি বাসায় একসঙ্গে পৃথক দুটি টিমের মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়। ১১/এ বাসায় থাকেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ে ভাই মরহুম রাজা মোহাম্মদ ভাইয়ের পরিবার। তার পুত্র ওমর মোহাম্মদ ভাই ওই বাসার তৃতীয় তলায় মদ মজুত রাখতেন এবং ছাদে পরিচালনা করতেন বার। পাশাপাশি আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ১১/বি নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় বিপুল মদ পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক খুরশিদ আলম জানান, এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গুলশান থানায় দুটি মামলা করেছে। মামলা দুটিতে ওমর মোহাম্মদ ভাইসহ তিন জনকে আসামি করা হয়েছে। বাদী হয়েছেন অধিদপ্তরের পরিদর্শক এসএম শামসুল কবির ও উপ-পরিদর্শক আতাউর রহমান। এ ছাড়াও অভিযানে ক্যাসিনো সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনায় একটি জিডি করা হয়েছে। এই অবৈধ কার্যক্রমে আর কারা জড়িত ছিলেন এ বিষয়ে তথ্য উদ্ধারের জন্য গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। এ জন্য তাদের রিমান্ডের আবেদন করা হবে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.