নিজের শরীর নিয়ে হীনমন্যতাবোধ যেভাবে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে : -মিচ উইটহ্যাম

আমার বান্ধবী লিয়ানেকে আমি সত্যিই ভালোবাসি। আমি চাই সেও তার নিজের সম্পর্কে একই ভাবে অনুভব করুক। সে খুব মজার একজন মানুষ।
একই সাথে তাঁর নীল চোখ এবং লম্বা চুল তাকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সে তাঁর চুল নানা ধরনের রং করে। বর্তমানে কার চুলে লাল রং করা। তাঁর হাসিও বেশ সুন্দর।
কিন্তু নিজের সম্পর্কে লিয়ানের ধারণা ভিন্ন রকম। সে নিজেকে ঘৃণা করে।
প্রতিদিন সে নিজেকে কয়েকবার কুৎসিত এবং বিরক্তিকর বলে বর্ণনা করে। সে নিজেকে স্থূলকায় মনে করে। আসলে বিষয়টা সে রকম নয়।
২১০৫ সালে টিন্ডারে আমাদের দেখা হয়। আমার বান্ধবী টিন্ডার পছন্দ করে, কারণ টিন্ডারে ছবি নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
প্রথমে যে কয়েকবার আমাদের দেখা হয়েছে তখন তাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। আমি কারো সাথে কখনো এতো দ্রুত সহজ হতে পারিনি।
আমাদের মধ্যে ভালো যোগাযোগ ছিল এবং কয়েকমাসের মধ্যে আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম।
আমাদের সম্পর্কের ছয় মাসের মধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে লিয়ানে তার শারীরিক গঠন নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে।
আমরা যখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়েছি তখন সে হঠাৎ বুঝতে পারলো যে তাঁর চুলের স্প্রে শেষ হয়ে গেছে।
লিয়ানে এবং মিচ গত দেড় বছর যাবত ডেটিং করছে।
তাঁর চুল দেখতে কেমন লাগবে? এ বিষয়টি ভেবে সে কিছুটা মন খারাপ করলো। তখন আমি তার জন্য চুলের স্প্রে কিনতে গেলাম।
বিষয়টিতে সে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। একপর্যায়ে সে জিনিসপত্র লাথি মেরে ফেলে দিতে লাগলো।
আমাদের মধ্যে সাংঘাতিক ঝগড়া হয়ে গেলো। যখন আমরা শান্ত হলাম, তখন আমি বুঝতে পারলাম যে তার ব্যবহার - নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলা - বিষয়টি পুরোপুরি ঠিক নয়।
আমার 'অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার' রয়েছে। এটা আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, কিন্তু এটি আরো জটিল হয়ে উঠেছে।
আমি বুঝতে পারলাম যে আমার বান্ধবীর কিছু ব্যবহারেও একই রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
আমি তাকে চিকিৎসকের কাছে যাবার পরামর্শ দিলাম।
যদিও সে প্রথম দিকে বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত ছিলনা, কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়টা নিয়ে সে কিছুটা স্বস্তি পেল এই ভেবে যে আমরা এনিয়ে আলাপ করেছি।

বডি ডিসমোরফিক ডিসঅর্ডার

চিকিৎসকের কাছে যাবার পর তার বডি ডিসমোরফিক অর্ডার ধরা পড়লো। এর অর্থ হচ্ছে, একজন ব্যক্তি নিজের চেহারা সম্পর্কে নানা খুঁত কল্পনা করে সেগুলো নিয়ে ভাবতে থাকে।
মোট জনসংখ্যার দুই শতাংশের মধ্যে এ ধরণের আচরণ আছে বলে মনে করা হয়। তারা মনে করে সে অন্যদের তুলনায় দেখতে কুৎসিত।
লিয়ানে সম্প্রতি চিকিৎসার অংশ হিসেবে থেরাপি নিতে শুরু করেছে। যদিও তার সমস্যাটি চিহ্নিত হয়েছে, কিন্তু এ ধরণের অবস্থায় বসবাস করা খুব কঠিন।
আমার যদিও এ ধরণের সমস্যা নেই, কিন্তু লিয়ানের সাথে থাকতে গিয়ে এটি আমার জীবনেরও অংশ হয়ে গেছে।
নিজের চেহারা নিয়ে অতি উদ্বেগ লিয়ানের জীবনযাত্রা ব্যহত করছে।
দিনে-দিনে এই সমস্যাটি এমন আকার ধারণ করলো যে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হলাম।
উদাহরণস্বরূপ- আমরা হয়তো হয়তো জুস বারে ঢুকছি এমন সময় আমার বান্ধবী বেঁকে বসলো, সে যাবেনা। কারণ সে মনে করছে যে ভেতরে তার চেয়ে বেশি সুন্দরী একটি মেয়ে বসে আছে।
মাঝেমধ্যে এটি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। লিয়ানে প্রায়ই বলে সে তার মুখমণ্ডল আঁচড়ে ফেলতে চায় এবং তার চুল পুড়িয়ে দিতে চায়। কারণ তার দৃষ্টিতে তার নিজের চেহারা এবং চুল সুন্দর নয়।
একবার সে যখন চুলে আগুন ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করলো। তখন আমি সেখানে ছিলাম। আমি ওর হাত থেকে লাইটার ছিনিয়ে নিলাম।
সবচেয়ে কঠিন বিষয় ছিল, আমরা কখনো অন্তরঙ্গ ছিলাম না। আমার বান্ধবীর পক্ষে আমার সামনে নগ্ন হওয়াটা ছিল ভীষণ কঠিন।
কয়েকমাস আগে আমরা যখন শেষবারের মতো অন্তরঙ্গ হয়েছিলাম, তখন সেটা পুরোপুরি যৌন মিলন ছিল না।
সাধারণত আমি অপেক্ষা করতাম সে যাতে এগিয়ে আসে। সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে কিনা সেটি বুঝতে সুবিধে হতো। কিন্তু সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল, সে চাইতো আমি যাতে এগিয়ে যাই।

অন্তরঙ্গ অবস্থা

আমরা অন্তরঙ্গ হতে শুরু করতাম। কিন্তু একপর্যায়ে সে আত্মবিশ্বাস বোধ করতো না এবং আমরা সেটা থামিয়ে দিতাম।
মাঝে মধ্যে আমার মনে হতো আমি ছুরির ওপরে বসে আছি। যৌন মিলন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় বিষয়।
নিজের চিকিৎসার অংশ হিসেবে আমি পর্ন ব্যবহার করি। একবার লিয়ানে যখন আমার মোবাইল ফোনে পর্ন দেখতে পেল, সে খুব রেগে গেল। সে চাইতো না যে আমি পর্ন দেখি।
আমরা অন্তরঙ্গ হওয়ার বেশ কিছু উপায় চেষ্টা করেছি। আমি তাকে বলতাম যে, সে কতো সুন্দরী এবং তাকে তৈরি হওয়ার জন্য অনেক সময় দিতাম।
কিন্তু সে যদি নিজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করে তাহলে বিষয়টি বেশ কঠিন। সেজন্য আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন পরিকল্পনা করতে পারিনা।
আমাদের দু'জনের বয়স এখন ২৯ বছর। এই বয়সে তার সব বন্ধুরা বিয়ে করছে। আমরাও বিয়ে এবং সন্তান নিয়ে আলাপ করেছি, যেটা আমি খুব পছন্দ করি।
লিয়ানে বলত সে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু তার মন সেটিতে সায় দিতো না। সে মনে করতো সন্তান জন্ম দিলে তার শরীরের ক্ষতি হবে।
মিচ হুইটহ্যাম
আমার বান্ধবী এখন থেরাপি নিচ্ছে এবং তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
একবার আমরা একটি বারে বসেছিলাম। তখন কিছু জুটি আসলো যাদের সাথে মেয়েরা ছিল। বিষয়টিতে লিয়োনে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো।
আমি বুঝতে পারলাম যে, লিয়ানে ভেবেছে মেয়েগুলো তার চেয়ে বেশি সুন্দরী।
আমার উপর রাগান্বিত হয়ে সে ওখান থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল। আমরা গত ১৮ মাস যাবত প্রেম করছি এবং এসব ক্ষুদ্র বিষয় বেড়েই চলেছে।

সাহায্য নেয়া

সে ঘটনার পরে আমি তাকে বললাম যে, বিষয়গুলো বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমি আর এগুলো মানিয়ে নিতে পারছিনা। আমি লিয়ানেকে পরামর্শ দিলাম সে যাতে সাহায্য নেয়।
প্রায়ই মনে হতো লিয়ানের মধ্যে দুটো মানুষ, এর একটি হচ্ছে বডি ডিসমোরফিক ডিসঅর্ডার। এটি তার গভীরে লুকায়িত।
যে যখন বলতো, "আমি সুন্দর না।" তখন আমি সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে ওর হাত ধরতাম কিংবা তাকে জড়িয়ে ধরতাম।
অনেকদিন ধরে আমি আমার পরিবার বা বন্ধুদের বিষয়টি জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি।
কারণ, আমি ভেবেছি এটা লিয়ানের ব্যক্তিগত বিষয়। গত বছর আমি বিষয়টি আমার বাবা-মাকে জানালাম। কারণ, আমার মধ্যে জমে থাকা হতাশা লাঘব করার উপায় খুঁজছিলাম।
আমার বাবা-মা বেশ সহনশীল ছিলেন। আমার মা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতেন। লিয়ানের সমস্যাটি তিনি অনুধাবন করতে পারলেন।
বন্ধুদের বিষয়টি ভিন্ন রকমের। তারা সম্প্রতি বডি ডিসমোরফিক ডিসঅর্ডার সম্পর্কে জানলো।
আমার এবং লিয়ানের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার যে অভাব ছিল, সে বিষয়টি বুঝতে বন্ধুদের খুব বেগ পেতে হচ্ছিল।
আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়েছে, "তুমি এর সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না।"
কিন্তু আমাদের মধ্যে যে ভালোবাসা আছে, সে বিষয়ে আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলাম।
আমরা ভালো মুহূর্তগুলো একত্রে উদযাপন করতাম। আমরা এখনো প্রতিদিন হাসি এবং পরস্পরের কাছে সবকিছু প্রকাশ করি। সে এখনো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
আমি জানি লিয়ানের বডি ডিসমোরফিক ডিসঅর্ডার কখনো দূর হবে না। কিন্তু আমি এমন একটি অবস্থায় পৌঁছতে চাই যেখানে সে তাঁর নিজেরে মধ্যে আত্মবিশ্বাস পায়।
(এই সাক্ষাৎকারটি বিবিসি থ্রি-তে প্রকাশিত হয়েছে।)

No comments

Powered by Blogger.