পাশ্চাত্য পিছু হটায় মিয়ানমারে চীনের উত্থান by বার্তিল লিন্টনার

মিয়ানমারের জাতিগত গোলযোগ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে পাশ্চাত্যের বিনিয়োগকারী ও পর্যটকদের দূরে সরিয়ে রাখছে, আর রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সঙ্কট আরো একবার ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দেশটিকে অচ্ছ্যুত করে রেখেছে।

আর একইসময় চীন আবির্ভূত হয়েছে দেশটির বৃহত্তম বিনিয়োগকারী হিসেবে। দেশটির বাণিজ্যিক কেন্দ্র ইয়াঙ্গুন ২০১৮-১৯ সময়কাল বিদেশী বিনিয়োগকৃত যে ১১৩টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে তার মধ্যে চীনের রয়েছে ৬৫টি।

বেইজিংয়ের ট্যুর গ্রুপগুলোর নিয়ন্ত্রিত চীনা পর্যটকদের মিয়ানমারে যাওয়াও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তাছাড়া চীনা সফরকারীদের জন্য মিয়ানমারের নতুন শিথিল ভিসা নিয়মের কারণেও পর্যটক বাড়ছে। এতে করে ২০১৮ সালে চীনারা ছিল দেশটির বৃহত্তম জাতীয় গ্রুপ।

গত ২৬ জুলাই ইরাবতীতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন চীনা বিনিয়োগকারীরা ইয়াঙ্গুনকেন্দ্রিক হলেও অন্যান্য অংশেও তারা যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন গভীর সমুদ্রবন্দর, নতুন নতুন নগরী, শিল্প পার্ক, সীমান্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোন, উচ্চগতির রেলরোড ইত্যাদি প্রকল্পে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।

নভেম্বরে চীনের সাথে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের (সিএমইসি) সমঝোতা স্মারকে সই করে মিয়ানমার। এই পরিবহন প্রকল্পটি চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম ইউনান প্রদেশকে সংযুক্ত করবে বঙ্গোপসাগরের সাথে। এর ফলে চীনের পক্ষে ব্যস্ত মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে বাণিজ্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি ২০১৬ সালের মার্চে সরকার গঠনের পর আশা করা হয়েছিল যে গণতন্ত্রের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়বে। কিন্তু সার্বিকভাবে তা হ্রাস পেয়েছে।

এনএলডি সরকার গঠনের আগের বছর তথা ২০১৫-১৬ সময়কালে বিদেশী প্রতিশ্রুতি ছিল ৯.৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০১৭-১৮ সময়কালে তা হ্রাস পেয়ে হয় ৫.৬ বিলিয়ন ডলার।

নতুন যে চিত্র সামনে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে মিয়ানমারে পাশ্চাত্য পিছু হঠছে, আর চীন দ্রুত গতিতে ওঠে আসছে।

চীন ও ভারত মহাসাগরের মাঝে কৌশলগত অবস্থানে হওয়ায় মিয়ানমার বেইজিংয়ের ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বিআরআই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

একইসাথে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে পাশ্চাত্যের কাছে পরিত্যক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ ঘাটতি পুষিয়ে নিতে ক্রমবর্ধমান হারে চীনের দিকে ঝুঁকছে মিয়ানমার।

বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রী থাঙ তুন গত জানুয়ারিতে এক আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সেমিনারে বলেন, মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে মিয়ানমার রয়েছে বিআরআইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে। মেরিটাইম সিল্ক রোড অবশ্যই মিয়ানমারের ওপর দিয়ে যেতে হবে।

তিনি আরো বলেন, চীনের উত্থানকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, বাধা হিসেবে নয়।

সাবেক সেনাবাহিনীর জেনারেল থিন সিনের আমলে চীনা বিনিয়োগ হ্রাস পেলেও এনএলডি ক্ষমতা গ্রহণের পর তা লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে।

বড় বড় প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে চীনা সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের মান্দালয় নগরী পর্যন্ত উচ্চগতির রেললাইন স্থাপন, রাখাইন রাজ্যের অবাধ বাণিজ্য জোনের কাছে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, পুরনো রাজধানী ইয়াঙ্গুনের অদূরে একটি নতুন আধুনিক নগরী নির্মাণ।

চীনা বিনিয়োগকারীরা পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেও আগ্রহ প্রকাশ করছে। তারা এখন ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের মাইস্টোন ড্যাম প্রকল্পটি আবার চালু করার কথা ভাবছে। পরিবেশগত কারণে আগের সরকার এটি স্থগিত করেছিল।

চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক এখন পূর্ণ অবয়ব গ্রহণ করেছে। অবশ্য পুরোটাই কেবল প্রশংসিতই হচ্ছে, এমন নয়। চীনা বিনিয়োগ ঋণের ফাঁদ কিনা সে বিতর্কও ওঠেছে। আবার ২০১৮ সালে মিয়ানমারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬.৩৫ বিলিয়ন ডলার, আর মোট জাতীয় ঋণ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীনের কাছেই ছিল ৪ বিলিয়ন ডলার।

আর বিআরআইয়ের আরো প্রকল্প মানে আরো ঋণ এবং চীনের উপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়া।

এদিকে মিয়ানমারে চীনা পর্যটক আসাও ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। জানুয়ারিতে প্রায় ৪২ হাজার চীনা পর্যটক গেছে মিয়ানমারে। তা ২০১৮ সালের একই সময়ের চীনা পর্যটকের (২০,৭১৭) দ্বিগুণেরও বেশি। গত বছর মিয়ানমার সফর করেছিল মোট ৩.৫৫ মিলিয়ন পর্যটক, এদের মধ্যে চীনারা ছিল ২,৯৭৪০০ জন।

আর ২০১৮ সালে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের পর্যটক ছিল যথাক্রমে ১২.৬৬ ও ২৩.৩৫ ভাগ। রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণেই মূলত পাশ্চাত্যের পর্যটকেরা মিয়ানমার থেকে সরে থাকছে।

No comments

Powered by Blogger.