কাশ্মীর সঙ্কট ভূখণ্ডগত নয়, এটি ইসলামের ওপর হিন্দু বিজয় by কপিল কোমিরেড্ডি

ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীর অস্তিত্বহীনতার পরাবাস্তব জগতে অবস্থান করছে। রাজ্যের মর্যাদা বিলুপ্ত, এর স্বায়ত্বশাসন বাতিল ও দুই অংশে খণ্ডিত করে ফেডারেল-শাসিত ভূখণ্ড করার নিয়ে রাষ্ট্রপতির ডিক্রি জারির পর থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে, সেলুলার নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়েছে, এমনকি ল্যান্ডলাইনও বন্ধ রয়েছে। জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, নাগরিকদের কারফিউয়ের আওতায় রাখা হয়েছে। কোনো কোনো গ্রামে প্রতিটি বাড়ির বাইরে একজন করে সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। দুনিয়া থেকে ৮০ লাখ লোক একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ নেই, বাড়িগুলোতে খাবার বলতে নেই, আহত বিক্ষোভকারীরা হাসপাতালগুলোতে আটকা পড়ে আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়ে বলেছেন যে এসবই করা হয়েছে কাশ্মীরীদের কল্যাণের জন্য। কাশ্মীরের ওপর ভারতের মুষ্ঠি খুব কমই এর চেয়ে কঠোর ছিল। অবশ্য কাশ্মীরের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আর কখনোই এত ভঙ্গুরও হয়নি।

মোদির আকস্মিকভাবে কাশ্মীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণটি অভিন্ন হিন্দু জাতি নিয়ে তার ভিশনের কাছে মুসলিম প্রাধান্যপূর্ণ জনসংখ্যার আত্মসমর্পণ ঘটানো ছিল দীর্ঘ দিন ধরে লালিত আদর্শগত আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন। এর মাধ্যমে অবশিষ্ট ভারতের কাছেও বার্তা দেয়া হলো উপমহাদেশে যে হিন্দু স্বর্গ প্রতিষ্ঠা তিনি করতে চান, তা থেকে কেউই রেহাই পাবে না। কাশ্মীর একদিকে হুঁশিয়ারি, অন্য দিকে মাপদণ্ড। এই ভিশন থেকে বিচ্যুত যেকোনো রাজ্যকেই ‘ঐক্যের’ নামে দিল্লির প্রভাববলয়ে নিয়ে আসা হবে।

যারা বিশ্বাস করে যে এ ধরনের দিন কোনো দিন আসবে না (অর্থাৎ ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ও সংখ্যালঘু সুরক্ষাগুলো প্রতিরোধ করবে), তারা কখনো ভাবেনি যে মোদির মতো কেউ দেশের নেতৃত্বে আসবে।  মোদি একবার উন্মাদ লোক হিসেবে ইতিহাস থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছেন বলেও মনে হয়েছিল। গুজরাটের নবনিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি ২০০২ সালে ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক রক্ষক্ষরণ ঘটিয়েছিলেন। এতে কম করে হলেও ১০০০ মুসলিম কয়েক সপ্তাহ ধরে তার রাজ্যের হিন্দুদের নাঙ্গা তরবারির নিচে প্রাণ দিয়েছেন। অনেকে অভিযোগ করে, তিনিই দাঙ্গাবাজদের মদত দিয়েছেন, কেউ বলে, তিনি চোখ বন্ধ করে ছিলেন। এই রক্তপাত মোদিকে অচ্ছ্যুতে পরিণত করেছিল। উদার ভারতীয়রা তাকে হিটলার হিসেবে অভিহিত করত, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, ব্রিটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাকে বয়কট করেছিল।

কিন্তু মোদি ভারতের হিন্দুদের মধ্যে তার আবেদন সম্প্রসারিত ও সংহত করেছিলেন। ক্ষমতায় ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য তিনি তিনটি শক্তিশালী হাতিয়ার ব্যবহার করেছিলেন। প্রথমটি ছিল ধর্ষকাম। তার অধীনে হিন্দুরা রক্তপিপাসুতে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুলিশ হেফাজতে এক মুসলিমকে হত্যার পর তিনি ২০০৭ সালে এক সমাবেশে স্বপ্নাচ্ছন্নভাবে বলেছিলেন, যদি কারো বাড়িতে একে-৫৭ পাওয়া যায়, তবে কি তাকে আমি হত্যা করব না। জনতা জবাব দিয়েছিল, তাকে হত্যা করো।

দ্বিতীয়টি ছিল অন্যদের কষ্ট দিয়ে আনন্দ লাভ করা। অসহায় সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করে নিদারুণ উল্লাসে মত্ত হন তিনি। ২০০২ সালে এক সমাবেশে তিনি সম্প্রতি গুজরাট দাঙ্গায় বাস্তুচ্যুত মুসলিমদের ভাগ্য নিয়ে কৌতুক করেছিলেন: ‘আমরা কী করতে পারি? তাদের জন্য ত্রাণশিবির খুলব? শিশু উৎপাদন কেন্দ্র খুলব আমরা? তার শ্রোতারা উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। তিনি বলেছিলেন, যারা আশঙ্কাজনক হারে জনসংখ্যা বাড়াচ্ছে, তাদেরকে একটি শিক্ষা দিতে চাই। তিনি এর মাধ্যমে হিন্দুদের নিজেদের পরিস্থিতির শিকার হিসেবে উপলব্ধি করার দিকে চালিত করেন। তিনি পার্লামেন্টে বলেন, ভারতকে এক হাজারের বেশি বছর দাস বানিয়ে রাখা হয়েছিল।

তার প্রধানমন্ত্রিত্বে গোঁড়ামি জোরালো রূপ নিয়েছে। মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তাদেরকে জিহাদি আর হিন্দু রমনীদের ধর্মান্তরকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে এক মুসলিম ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারা আট লোককে মোদির মন্ত্রিসভার এক সদস্য ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন। এই দুনিয়ায় কাশ্মীর কখনো স্বায়ত্বশাসিত থাকতে পারে না, সংখ্যাগরিষ্ঠকে খুশি করার জন্য এখানে সহিংসতার মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষাগুলো চাপিয়ে দেয়ার স্থান এটি।

চলতি বছর মোদির পুনঃনির্বাচন তার সমর্থকদের আরো সাহসী করে তুলেছে। আর তিনি এই সমর্থকদের দক্ষতার সাথেই উস্কে দিতে পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রী খুব কমই সংখ্যালঘুদের খুন হওয়ার কথা স্বীকার করেন। আর এর নিন্দা করা আরো বিরল ঘটনা।

মোদির রাজনৈতিক সচেতনতা ঘটেছে উগ্রডানপন্থী প্যারামিলিটারি গ্রুপ আরএসএসের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোতে। এসব ক্যাম্পে শেখানো হয় মুসলিমরা হলো ভিলেন, তারা বিভিন্ন সময়ে লুটপাট করেছে। আরএসএসের শিক্ষা মোদির মনে এমনভাবেই গেঁথে গিয়েছিল যে তিনি এই সংগঠনকেই পরিবার হিসেবে গ্রহণ করে নেন। তিনি এমনকি তার স্ত্রী ও মাকেও পরিত্যাগ করেন।

কাশ্মীর দখল করার মাধ্যমে মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের সন্ন্যাসীদের তৃপ্ত করেছেন, নিজেকে ‌‘নয়া ভারতের’ পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদের ইচ্ছার তালিকায় কাশ্মীর সবসময়ই ছিল শীর্ষে। এছাড়া আছে অযোধ্যায় একটি মন্দির নির্মাণ। আর তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে সংবিধান নতুন করে রচনা করা।

কিন্তু দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় সমাজে এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে টিকে থাকতে পারবে? ১৯৫১ সালে বিপুলভাবে জনপ্রিয় সমাজবাদী নেতা (তিনিই ভারতে কাশ্মীরকে অন্তর্ভুক্ত করতে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন) শেখ আবদুল্লাহ প্রথমবারের মতো নির্বাচিত পরিষদে উদ্বোধনী বক্তৃতায় কাশ্মীরীদের এই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বরেছিলেন ভারতের সেক্যুলার গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সাম্য। কাশ্মীরের মুসলিমদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়টি তিনি নাকচ করে দেন। তিনি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকে মধ্যযুগীয় চিন্তা হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি আধা ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের নিন্দা করে বলেন, এটি একটি সামন্ততান্ত্রিক দেশ। তিনি পাকিস্তানের নিন্দা করেন এই কারণে যে সেক্যুলারবাদ নিয়ে কোনো ছাড় নেই। তিনি যে কারণে পাকিস্তানের নিন্দা করেছিলেন, সেটিই এখন ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা একসময় ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করত। তখন বলা হতো, ভারতীয় রাষ্ট্রে কাশ্মীরীদের ধর্ম অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। কিন্তু এখন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যুক্তি দিয়ে তাদের দাবিটি সামনে আনতে পারবে। মোদি নিজে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী হওয়ায় তিনি এখন আর অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের কথা বলতে পারবেন না। ভারত যখন তার সেক্যুলার মর্যাদা ত্যাগ করবে, তখন সে কাশ্মীরকে ধরে রাখার যুক্তি হারাবে। বর্তমানে যে শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে, তা আসলে বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকা গভীর ক্রোধ গোপন করে রাখছে। কাশ্মীরকে একীভূত করার যে যুক্তি মোদি উপস্থাপন করছে, তা যদি পরিবর্তন করা না হয়, তবে তাই ভারতের ঐক্যের সমাপ্তির সূচনা করবে।

No comments

Powered by Blogger.