মানব পাচার: বিদেশ থেকে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা এক নারী - 'আমি বেশ্যা, জেল খেটে আসছি, আমার মেয়ের বাপের পরিচয় নাই' by শারমিন রমা

"আমরা ১৫ জন মেয়ে ছিলাম, একবেলা খাবার দিতো, ক্ষুধা-পেটে মদ আর কী কী সব খাওয়ায় দিতো আমাদের! আমি সহ্য করতে পারতাম না, খালি বমি করতাম। রাতে ঘুমাইতে দিতো না, অনেক বেটা-ছেলে আসত ঘরে। ওদের কথা না শুনলে খুব মারধর করত।"
বিবিসিকে যৌন নিপীড়নের বিভীষিকার কথা বলছিলেন লিলি। এটি তার ছদ্মনাম, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থেই এখানে মেয়েটির প্রকৃত নাম ব্যবহার করা হলো না।
ভাল কাজের লোভ দেখিয়ে জর্ডানের একটি পতিতালয়ে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের মেয়ে লিলিকে যখন মাদক খাইয়ে প্রতিদিন চার থেকে ছয় জন পুরুষের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা হতো, তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছরের কিছু বেশি।
প্রতিদিন ধর্ষণ আর নানা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন লিলি।
তারপর একদিন সেই পতিতালয়ে পুলিশের অভিযান হলে সেখান থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
দুই মাস জেল খাটার পর, কয়েক হাত ঘুরে অবশেষে বাংলাদেশে ফেরে ছয় মাসের গর্ভবতী কিশোরীটি।
তবে পরিবার কিংবা সমাজ তাকে আর গ্রহণ করতে চায় না।
মানব পাচারের শিকার হয়ে কিংবা অভিবাসনের পর নানা নির্যাতনের মুখে পড়ে প্রতিদিনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসছে বাংলাদেশের বহু নারী।
"বাবা আমার বাচ্চা নষ্ট করতে চাইছে, কিন্তু ডাক্তার বলছে, ছয় মাস হয়ে গেছে, হবে না এখন," বলছিলেন তিনি।
নিজের দূরবস্হার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লিলি বলছিলেন, "আত্মীয়স্বজন-পাড়ার লোক বলে আমি বেশ্যা, জেল খেটে আসছি, আমার মেয়ের বাপের পরিচয় নাই, তাই বাচ্চাটা বিক্রি করে দিতে চায় আমার বাবা।"
এদিকে অবিবাহিত মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দেশে ফেরার পর থেকেই আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে লিলি'র পরিবার।
"সমাজ আমাগো চাপ দিছে, থাকতে দিবে না, তারা মুখ দেখাইতে পারে না," লিলির মা বিবিসিকে বলছিলেন। সমাজের চাপ ছাড়াও মেয়ে এবং নাতনীর অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে এখন আরও বেশি চিন্তিত তিনি।
অনেকেই তাকে শিশুটিকে বিক্রি করার পরামর্শ দিলেও মেয়েকে বিয়ে দিতে চান তিনি।
তবে তার শঙ্কা, কোনও 'ভাল ছেলে' বাচ্চাসহ বিয়ে করতে চাইবে না লিলিকে।
বাংলাদেশে লিলি'র মতো বিদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে ফিরে আসা নারীদের জীবন-যাপন করাটা বেশ কঠিন হয়ে যায় যখন পরিবার ও সমাজ তাদের সহজে মেনে নিতে পারে না।

রাষ্ট্র কী করছে?

নির্যাতনের শিকার এই নারীদের টিকে থাকার সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধটা শুরু হয় দেশে ফেরার পর।
কারণ বিদেশ থেকে ফেরা এই নারীদের পুনর্বাসনে বেসরকারি কিছু উদ্যোগ থাকলেও সরকারের দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে মনে করছেন, তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বিবিসিকে বলছিলেন, নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরা নারীর প্রতি পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য রাষ্ট্রের অনেকটা দায় থেকে যায়।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ-পরিচালক হালিমা আহমেদ
"অনেক মেয়েই বিমান বন্দরে এসে বলে যে, সে কোথায় যাবে জানে না। সমাজ কিন্তু তাকে বাঁকা চোখে দেখে, পরিবারই কিন্তু তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, সহজে নিতে চাচ্ছে না।"
"পরিবারের এই যে আচরণ, কারণটা হচ্ছে সমাজ, সমাজের এই আচরণ, কারণটা হয়ত রাষ্ট্র।"
মি. হাসানের মতে, যেহেতু বিদেশে যাওয়াটা সরকারের একটি রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের কৌশল, সেহেতু কেউ বিদেশ থেকে নির্যাতিত হয়ে ফিরে এসে বিপদে পড়লে তাদের সাহায্যে দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়াটা খুব জরুরী।
এক্ষেত্রে যথেষ্ট পদক্ষেপ না থাকার বিষয়টা অবশ্য স্বীকার করে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ-পরিচালক হালিমা আহমেদ বিবিসিকে বলেন, তারা এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অন্ততঃ একজন সদস্যকে পুনর্বাসনের একটি প্রস্তাব তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন।
"সত্যিকার অর্থে তাদের দেশে আসার পর আবার একটা কাজের মধ্যে স্টেবল করে দেয়া বা কাজে ট্যাগ করে দেয়া, বড় পরিসরে সেটা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে এখনও শুরু হয়নি," বলছিলেন মিস আহমেদ।

মানব পাচারের ঘটনায় বিচারের চিত্র

বাংলাদেশে মানব পাচারের মামলা নিষ্পত্তি বেশ সময়সাপেক্ষ।
ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বিবিসিকে জানান, এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত আইনে চার হাজার ৬৬৮টি মামলা হয়েছে, কিন্তু নিষ্পত্তি হয়েছে কেবল মাত্র ২৪৫টি মামলা।
এক্ষেত্রে, ২০১২ সালে জারি হওয়া মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকার পরও ট্রাইব্যুনাল গঠন না করা অন্যতম একটি প্রধান কারণ বলে মনে করেন তিনি।

কোথায় পাচার হচ্ছে বাংলাদেশের নারীরা?

বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে নারী ও শিশুদের।
মূলতঃ এসব দেশের বিভিন্ন জায়গায় পতিতালয়ে আটকে রেখে যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদেরকে।

পাচার হওয়া নারীর সংখ্যা কত?

পুলিশের হিসেবে, বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারী পাচারের সংখ্যা ১,৪৩৭ জন।
তবে, নারী পাচারের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলেই মনে করছেন অভিবাসন কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ থেকে বছরে যে পরিমাণ মানব পাচার হয়, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যে নারী ও শিশু, তার ধারণা পাওয়া যায় জাতিসংঘের একটি পরিসংখ্যান থেকে।
সেখানে বলা হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়ে, অর্থাৎ দেড় বছরে এদেশ থেকে পাচার হওয়াদের মধ্যে ৩৬ শতাংশই ছিল নারী আর শিশু ১৫ শতাংশ।

শ্রম অভিবাসনের ওপর প্রভাব

পাচারের শিকার মানুষদের নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের মতে এদেশ থেকে মানব পাচারের চিত্রটা এখন বেশ উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বিবিসিকে বলেন, "মানব পাচারের সংখ্যা আমাদের দিন দিন বাড়ছে এবং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবপাচার বিষয়ক যে প্রতিবেদন, তাতে বাংলাদেশকে তারা টানা তৃতীয়বারের মতো টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে রেখেছে।"
"এই তালিকায় রাখার অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ মানব পাচারের ক্ষেত্রে ন্যুনতম যে মানদণ্ড, সেটাও রাখতে পারেনি। এরপর আমরা হয়ত এমন একটা তালিকার মধ্যে চলে যাব, যেখানে আমাদের স্বাভাবিক শ্রম অভিবাসন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।"
শ্রম অভিবাসন কিংবা পাচার—যেভাবেই এদেশ থেকে নারীরা চলে গিয়ে থাকুক, তারা যখন আবার নিজ দেশে ফিরে আসে, তখন সমাজ তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখে বলেই তারা আরও বেশি সংকটে পড়ে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এক্ষেত্রে পরিস্থিতি বদলাতে পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনই এদের দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নেয়াটা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।
ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বিবিসিকে বলছিলেন, নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরা নারীর প্রতি পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য রাষ্ট্রের অনেকটা দায় থেকে যায়।

No comments

Powered by Blogger.