হানজায় তাঁবু খাটিয়ে নাস্তার আয়োজন করতে নগরী ছেড়েছেন যে দম্পতি

কলেজ গ্রাজুয়েটিংয়ের পর যদি আপনার লক্ষ্য ছিলো পিঠে ঝোলা নিয়ে ইউরোপে ঘুরে বেড়ানো, তবে বিষয়টি নিয়ে আবার ভাবুন।
ইউরোপে যাওয়া যায় সহজেই (এমনকি পাকিস্তান থেকেও)। সুবিধামতো ফ্লাইট ধরে গেলেই চলে। হোটেল আর এয়ারবিএনবি বিকল্প আছে অনেক। তাছাড়া বিভিন্ন দেশ আর নগরীকে সংযুক্তকারী অসংখ্য ট্রেন আছে। কয়েক ঘন্টা পরপরই ছাড়ে। এগুলোর প্রায় সবই পর্যটকবান্ধব। আর কিছু মৌলিক শর্ত যদি মেনে চলেন, তবে ভিসা পাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। ফলে আইফেল টাওয়ার কিংবা সুইস আলপসের সামনে দাঁড়ানো খুব কঠিন কাজ নয়।

কিন্তু পাকিস্তানের উত্তরাংশে গিয়ে নতুন কিছু জানার অভিযান শুরু করা সত্যিই সাহসের ব্যাপার। ফ্লাইট প্রায়ই দেরি করে, রাস্তাগুলো দীর্ঘ আর অস্বস্তিকর। থাকা-খাওয়ার বিকল্প আছে সামান্য। আর ভালো যেগুলো, সেগুলো বিশ্বের অন্যান্য স্থানের তুলনায় খুবই ব্যয়বহুল।

এই কারণেই উত্তরে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি সাহসের দরকার হয়। আর যাদের এমন সাহস আছে তাদের দুজন হলেন আহমদ ও বানিন।

আহমদ ও বানিনের মাথা থেকেই এসেছে খানাবাদোশ বৈঠকের ধারণাটি। এটি আর কিছু নয়, স্রেফ একটি তাঁবু এবং নাস্তা নিয়ে শিগার ভ্যালি থেকে শুরু হয় এর যাত্রা। তারা পরের তিন বছর হানজার গুলকিনে থাকার জন্য নগরী ছাড়েন।
বানিন (বাঁয়ে) ও আহমদ, খানাবাদোশ বৈঠকের সহপ্রতিষ্ঠাতা
এই দম্পতি জানান, বৈঠক হলো খানাবাদোশ কলেকটিভের একটি অপেক্ষাকৃত বড় ভিশন। তবে সূচনা হয়েছিল অন্যভাবে। কয়েকজন বন্ধু প্রায়ই একটি স্থানে মিলিত হতেন। চা পানের ফাঁকে ফাঁকে তারা নানা বিষয়ে আলাপ করতেন, আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করতেন, বোঝার কথা স্বীকার করতেন। এ ধরনের এক বৈঠকে খানাবাদোশের নানা মত ও পথের লোকদের জন্য লাইটহাউস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ধীরে ধীরে এটি ইঞ্জিনিয়ার, থিয়েটার শিল্পী, ডিজাইনার, লেখক, সঙ্গীতজ্ঞ ইত্যাদি নানা ধরনের লোকের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়।

এই দম্পতি জানান, বৈঠক লোকালয়, শব্দ আর মাত্রাতিরিক্ত নগরজীবন থেকে দূরে বসবাসের প্রয়োজন থেকেই উদ্ভব ঘটে। আমরা সমাজের সফলতার সংজ্ঞা থেকে সরে যেতে চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ, সৃষ্টিশীল, অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করতে।

আহমদ বলেন, এই কাজে সাহসটাই ছিল আসল। তবে আরো সুদূরপ্রসারী ছিল এই যে আহমদ ও বানিন সফরে বের হয়ে পড়েন।

তাদের তাঁবু আর নাস্তার কল্যাণে সমগ্র পাকিস্তান থেকে লোকজন আসতে পারে খানাবাদোশ বৈঠকে। এখানে কেবল সাশ্রয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে না, সেইসাথে স্থানীয়ভাবে পাওয়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার চেয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা উপহার দেয়।

বানিন বলেন, তারা একটি ধারণার জন্ম দিয়েছেন। তিনি জানান, সফর আমাদের অনেক মাধ্যমের একটি মাত্র।
তাঁবু থেকে বাইরের দৃশ্য
আহমদ ব্যাখ্যা করেন বলেন, তারা বাণিজ্যিক দিকটি নিয়ে ভাবেন না। তারা পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে প্রতিযোগিতাও করছেন না। তিনি বলেন, নির্মাণ, যানবাহন, বর্জ্য, স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আসলে আমরা উদ্বেগে থাকি।

দুজনই জোর দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের ভ্রমণ শিল্পটি সম্প্রসারণ করার আগে পরিবেশগত চাহিদার বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে।

তবে এ ধরনের আইডিয়া জীবনে বাস্তবায়ন করাটা চ্যালেঞ্জিং ও আতঙ্কজনক। তবে দুজনের মনেই খানাবাদোশ গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকায় সেটাই রহমত হিসেবে দেখা দেয়।

তারা জানান যে সমসাময়িক শহরে জীবনযাত্রা ও পুঁজিবাদ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। সেইসাথে আছে সংস্কৃতি ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ।

খানাবাদোশ বৈঠকের মূল কথা হলো, এটি পর্যটকদের জন্য নয়। পর্যটকেরা তাদের সাথে থাকবে, এজন্য তারা এই কর্মসূচি প্রণয়ন করেননি। সেটা তো অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। তারা নতুন জীবনের সন্ধান দিতে চান।

এই দম্পতি জানান, তারা মন্থরতা আর সময়কে উপভোগ করার বিলাসিতাকে গুরুত্ব দেন। তারা বলেন, আরো বেশি হাঁটুন, টাটকা খান, যতটা সম্ভব স্থানীয়দের সাথে মিশুন। এটা পর্যটকদের জন্য নয়, বরং সংস্কৃতি, সমাজ আর জীবনযাত্রার সন্ধানে থাকা মুসাফিরদের জন্য।
শিগারের হেমন্তকাল
যারা তারকাখচিত আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করতে চান, তাদের জন্য আছে অবারিত সুযোগ।

আবার চা আর খাবার ছাড়া যেহেতু বৈঠক অসম্পূর্ণ থাকে, তাই খানাবাদোশ বৈঠকে একটি ছোট রান্নাঘর আছে, আছে নিজস্ব ফুড ল্যাবও।

মজার ব্যাপার হলো, নিয়মিত মেন্যুর মধ্যে আছে কেবল চা, কফি আর কিছু মৌলিক স্ন্যাকস। তবে এতে আপনার হতাশ হলে চলবে না। আরো অনেক কিছুই আছে। তবে তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। একদিন হয়তো নাস্তায় পাবেন ছোট্ট প্যানকেক, অন্যদি হয়তো উপভোগ করবেন শাকশুকা।

খাদ্য তালিকায় যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াজাত খাবার রাখা হয় ন্যূনতম মাত্রায়। আর স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত উপাদানের দিকে নজর দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। আহমদ আর বানিন বলেন, আমাদের ফুড ল্যাব আমাদের এবং আমাদের অতিথিদের প্রতিদিনই চমকে দেয়।

খাবার পরিবেশনের পদ্ধতিটিও অভিনব। সবাইকে একসাথে খাবার গ্রহণ করতে হয় একই টেবিলে বসে। সবাই সবার সাথে পরিচিত হয়, সবাই কথা বলতে বলতেই খাবার গ্রহণ করেন। একসাথে বসে খাবার গ্রহণ কেবল সৌন্দর্যমণ্ডিতই নয়, এটা খাবারের স্বাদই বদলে দেয়, এমনকি আরো বেশি স্মরণীয় করে তোলে।

আবার বানিন ও আহমদ অতিথিদের বাইরে ক্যাফে কিংবা স্থানীয়দের খাবার গ্রহণকে উৎসাহিত করেন। স্থানীয়রাও সুস্বাদু খাবার তৈরি করেন। এই খাবারের মাধ্যমেই ওই এলাকাকে তারা চিনতে পারেন।
শিগারে নাস্তার জন্য ক্রিপেস
বৈঠক অনেকের কাছে বাড়ির মতো মনে হলেও নানা জনের অভিজ্ঞতা নানা রকম।

গত বছর সুপরিচিত আর্কিটেক, ডিজাইনার ও শিক্ষাবিদ জাইন মুস্তাফা শিগারে খানাবাদোশ বৈঠকে শিক্ষা সফর করেন। এতে অংশগ্রহণকারীরা স্থানীয় খানকাগুলো দেখার অবারিত সুযোগ পান।

তারা ইতিহাস জানেন। তারা সমসাময়িক অবস্থা বুঝতে পারেন।

এবার খানাবাদোশ কালেকটি গুলকিনের শিশুদের জন্য একটি থিয়েটার ওয়ার্কশপের আয়োজন করে।

চলতি গ্রীষ্মে করাচির লেখক নাতাশা জাপানওয়ালা খানাবাদোশ বৈঠকের সহযোগিতায় একটি লেখক শিবিরের ব্যবস্থা করেন।

সম্প্রতি বৈঠক শাহ জো রাগ মেলার আয়োজন করে। এতে শাহ আবদুল লতিফ ভাটাইয়ের ফকিরেরা অংশ নেন। তারা কালাম প্রচারের জন্য সিন্ধু থেকে আগমন করেন।

অংশগ্রহণকারীরা অভিনব এসব উপস্থাপনায় বেশ তৃপ্ত। মনেপ্রাণে যাযাবর আদনা নাসির বৈঠকের সাথে পরিচিত হন কাকতালীয়ভাবেই।
পাহাড়ের উপর যোগ ক্লাস
তিনি বলেন, আমি বানিন আপি আর আহমদ ভাইয়ের প্রথম সাক্ষাত পাই ইসলামাবাদের একটি ক্যাফেতে। মাত্র কয়েক মিনিটের আলাপেই আমি বুঝতে পারলাম, তাদের বৈঠকে যোগ দেয়া আমার দরকার।

তিনি জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তার তিন দিন বেশি থাকতে হয় বৈঠকে। কিন্তু এ জন্য তার কাছ থেকে অতিরিক্ত কোনো পয়সা গ্রহণ করা হয়নি।

তবে আহমদ আর বানিন সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চান তা হলো নিজ দেশকে মূল্যায়ন করা।

বানিন বলেন, দুবাই, থাইল্যান্ড বা সুইজারল্যান্ডে ব্যয়বহুল সফরের মতোই দেশকে জানার জন্য খোলা মনে চিন্তা করাও গুরুত্বপূর্ণ।

আহমদ অতিথিদের অপেক্ষাকৃত কম জানা স্থানগুলোকে চেনার ওপর গুরুত্ব দেন।

তিনি বলেন, বালুচিস্তান, থর কিংবা হানজা বা বাল্টিস্তান- সবখানেই যাবেন আপনারা। তবে সবসময় স্থানীয় লোকজন ও তাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাভাজন থাকবেন। তাদের এলাকার প্রতি স্পর্শকাতর থাকতে হবে আপনাকে।
>>>ডন

No comments

Powered by Blogger.