সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কলকাতার বিখ্যাত আনন্দবাজার পত্রিকা: ভবিষ্যৎ ভালো হওয়ার সম্ভাবনাও চোখে পড়ছে না

কলকাতা-ভিত্তিক আনন্দবাজার পত্রিকা (এবিপি) গ্রুপ তাদের মোটামুটি নতুন ট্যাবলয়েড পত্রিকা এবেলা বন্ধ করে দেয়ার মাস দুই পরে কোম্পানির সাংবাদিক অসাংবাদিক চাকরিজীবীরা দাঁত কামড়ে অপেক্ষা করছিল, কখন তাদেরকে গোলাপি স্লিপ ধরিয়ে দেয়া হবে। গত বছরের দুর্গাপূজার সময় এবেলা যখন প্রথম আঘাতটা পেলো, তখন সেখানে শ’য়ের কিছু বেশি কর্মরত চাকুরেদেরকে আনন্দবাজার গ্রুপের অন্যত্র চাকরিতে নিয়ে নেয়া হয়, তবে কিছু মানুষ বাদ পড়ে যায়।
যে সাংবাদিকরা গ্রুপটির প্রধান বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারে জায়গা পায়নি, তারা কলকাতার অন্য কোন জায়গাতেও এখনও কাজ খুঁজে পায়নি। কলকাতা ভারতের সেই জায়গাগুলোর একটি যেখানে বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশনা কোম্পানি হয় দোকান বন্ধ করে দিয়েছে, না হলে জনবল ছাটাই করেছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে নরেন্দ্র মোদির সরকার সে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী রুপির নোট তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটার ধাক্কা সামলাতেই পত্রিকা কোম্পানিগুলোকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
এবিপি গ্রুপের সমস্যার শুরু হয় ২০১৬ সালে। ২০১৬ সালের পশ্চিম বঙ্গের অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের পর সে সময়কার এডিটর-ইন-চিফ অভিক সরকারকে কোম্পানির সংবাদ ও অর্থ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে সরিয়ে দেয় তার ভাই অরূপ। নির্বাচনের আগে পাঁচ বছর, অভিক সরকার মমতা ব্যানার্জির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এ বিষয়টির প্রকাশ ঘটতো আনন্দবাজার পত্রিকা এবং দ্য টেলিগ্রাফ – উভয়ের সম্পাদকীয়তে।
এবিপির ব্যবস্থাপনা সূত্রের মতে, মমতাবিরোধী সম্পাদকীয় অবস্থানের কারণে পত্রিকাটির উপর আর্থিক বোঝা বাড়তে থাকে এবং সরকারী বিজ্ঞাপন কমতে শুরু করে, যেটা ছিল কোম্পানির আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। অরূপ সরকার এটা পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর যে সব পদক্ষেপ নেন তিনি, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘বাড়তি’ জনবল ছেটে ফেলা, যাদের মধ্যে সাংবাদিকরাও রয়েছেন।
বরখাস্তের প্রক্রিয়া শুরুর আগে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যে, গ্রুপটি তাদের জনবল ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কাটছাট করবে। চাকুরেদের অনানুষ্ঠানিকভাবে এটা জানানো হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে কোম্পানি একটি নোটিশ ইস্যু করে যে, সকল সাংবাদিককে ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট অ্যাক্টের অধীনে আনা হবে এবং ওয়েজ বোর্ড নির্ধারিত বেতন দেয়া হবে। একটি অনলাইন সংবাদ ওয়েবসাইটে জানানো হয় যে, “নোটিশে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ওয়েজ বোর্ডের অধীন সমস্ত সাংবাদিককে কোম্পানির প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে এবং ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হবে”।
প্রস্তাবে বলা হয়, “যে সব সাংবাদিক ওয়েজ বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন নেবে, তারা বর্তমান রেট অনুযায়ী বেসিক বেতন পেতে থাকবে”। ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ প্রস্তাবের বহু আগ থেকেই ছাটাইয়ের পরিকল্পনা নিয়ে রাখা হয়েছিল। এবিপি গ্রুপ যখন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক হেই কনসালটেন্সি লিমিটেডকে ভাড়া করেছিল, তখন প্রতিষ্ঠানটি সুপারিশ করেছিলো কিভাবে কোম্পানি তাদের ব্যয় কমিয়ে আনতে পারে, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও টেলিভিশন চ্যানেলসহ বিভিন্ন পণ্যকে কিভারে ঢেলে সাজিয়ে সেগুলোকে আর্থিকভাবে লাভজনক করা যায়। হেই কনসালটেন্সি তাদের অনুসন্ধানে দেখতে পায় যে, কোম্পানিতে প্রায় ৪৭.৫ শতাংশ অতিরিক্ত জনবল রয়েছে। এর আগে, বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে যখন ভয়াবহ আগুনে সেন্ট্রাল কলকাতার প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আনন্দবাজার পত্রিকার বিখ্যাত ভবনটি আগুনে পুড়ে যায়, তখন এবিপি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা কমিটি ম্যাকিনসেকে ভাড়া করেছিল, যাতে তারা প্রতিষ্ঠানটির বিশাল জনবল কমিয়ে আনার জন্য পথ বাতলে দিতে পারে। সে সময় শতাধিক স্টাফকে অতিরিক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং ধীরে ধীরে তাদেরকে সরিয়ে দেয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত ছাটাইয়ের কুড়াল যখন পড়লো, তখন সাংবাদিক অসাংবাদিক সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। অধিকাংশই ছেড়ে দেয় চাকরি, অন্যদের দূর দূরান্তে বদলি করে পাঠানো হয়, যাতে তারা নিজ থেকেই পদত্যাগপত্র দিয়ে দেয়। কিছু লোক বদলির সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকার করে এবং লড়াই করে টিকে যায়। কিছু সাংবাদিক ছিলেন এতটাই সিনিয়র যে, তারা অন্য কোন জায়গায় কাজ খুঁজে পাননি। কারণ সার্বিকভাবে রাজস্ব কমছিল এবং অন্যান্য প্রকাশনাগুলোরও বিক্রি ও সার্কুলেশানে এর প্রভাব পড়ছিল।
এবিপির কর্মরত বা অবসর নেয়া কোন সাংবাদিকই কোম্পানির জনবল ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে অন-রেকর্ড কথা বলতে রাজি হননি। আনন্দবাজার পত্রিকার সাবেক এক সাংবাদিক বলেন যে, “ছাটাইয়ের প্রক্রিয়াটা এখন ঠেকানোর উপায় নেই এবং এর এখন দ্বৈত প্রভাব পড়ছে – একদিকে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে অন্যদিকে প্রগতিশীল সাংবাদিকতাও হারিয়ে যাচ্ছে”। গত এক দশক বা এ রকম সময়ে ‘দুর্বল ব্যবস্থাপনা’ এবং ‘সাংবাদিকতার মানের কারণে’ পত্রিকার সার্কুলেশান পড়ে গেছে।
অডিট ব্যুরো অব সার্কুলেশানের (এবিসি) ২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুসারে আনন্দবাজার পত্রিকার পুরো সার্কুলেশান ছিল প্রায় ১.১ মিলিয়ন। এবিসি’র রেকর্ড অনুযায়ী ২০১৬ সালের জানুয়ারি এবং জুলাই মাসে বাংলা দৈনিকটির সার্কুলেশান ছিল ১,১১৫,৩৫৪ কপি, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সেটা কমে আসে ১,১০২,৯৫৫ কপিতে। গড়ে পত্রিকাটির সার্কুলেশান নেমে আসে ১,০৮০,৪৭৮ কপিতে। কলকাতা-ভিত্তিক অন্যান্য প্রকাশনারও সার্কুলেশান কমে আসে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনের ব্যয় কমিয়ে আনে। তবে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় আসে এবিপি গ্রুপের উপর যারা আগে বেশ কিছু জনপ্রিয় পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে সানন্দা (যেটা কলকাতার বাইরে ঢাকাতেও জনপ্রিয় ছিল), এবং সানডেসহ সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাগুলো। বিজ্ঞাপনের আয় কমে যাওয়ার আর্থিক চাপটা টের পাচ্ছিলো তারা। এক সময় বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনায় সমাদৃত দেশ পত্রিকাটি এখনও প্রকাশিত হচ্ছে বটে, তবে সেটাও ধুঁকে ধুঁকে চলছে।
২০০৩ সালে এবিপি ব্যবস্থাপনা কমিটি কোম্পানিকে ‘কর্পোরেটে’ রূপ দেয়ার চেষ্টা করে এবং কর্মকাণ্ডে ‘অধিক স্বচ্ছতা’ আনার উদ্দেশ্যে ‘ভুল-ভ্রান্তি’ এড়ানোর জন্য ‘প্রডাকশান সেল’ গঠন করে। এই সব পদক্ষেপের ফলে মুদ্রণ খরচ ২ কোটি রুপি পর্যন্ত বেঁচে যায়। সাংবাদিকদের বেতনের উন্নতি হয়। তৎকালিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিরুদ্ধ লাহিড়ি চলে যাওয়ার পর থেকে কোম্পানির আবারও পতন শুরু হয়, বিশেষ করে বাম রাজত্বের শেষ সময়টাতে। ২০১১ সালে নিম্নমুখী পতন আরও ত্বরান্বিত হয়। ওই সময়টাতে এবিপি নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক সিস্টেম চালু করেছিল।
সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার মধ্যে এ সময় অবনতির আরেকটা বড় কারণ ছিল সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’। কিছু কিছু বিবাদ সে সময় অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। ব্যবস্থাপনায় থাকা ব্যক্তিরা তখন রহস্যজনক কারণে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, যদিও এ কারণে পত্রিকার বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। যেটা সবার নজরে এসেছিল, সেটা হলো আনন্দবাজারের কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে কলকাতা-ভিত্তিক কিছু ব্যবসায়ীর সম্পর্ক, যেটার কারণে সিনিয়র পর্যায়ে ‘সঙ্ঘাত’ আর ‘শত্রুতা’ দেখা দেয়। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলোর মতে, ‘সাংবাদিকতার মূল্যবোধের অবক্ষয়ের’ একটা উদাহরণ হলো তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া, যিনি ভুল কারণে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। ২০০৫ সালে চট্টোপাধ্যায় কি কারণে চলে যান সেটা ব্যবস্থাপনা কমিটিই ভালো জানেন। তবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কথিত চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে যখন সিবিআই গ্রেফতার করলো, তখন বোঝা গেলো তার বিরুদ্ধে আগের ‘দুর্নীতির’ অভিযোগের কিছু ভিত্তি ছিল। চট্টোপাধ্যায় যখন গ্রেফতার হন, তখন তিনি বাংলা দৈনিক এই সময়ের সম্পাদক। টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রকাশ করে যে বেনেট কোলম্যান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, তাদেরই প্রকাশনা এটা।
২০১৬ সালে অরূপ সরকার যখন দায়িত্ব নেন, তখন তিনি সবকিছু লাইনে আনার চেষ্টা করেন, যদিও তৃণমূল কংগ্রেস ওই বছরেই নির্বাচনে জেতার পর মমতা ব্যানার্জির সরকার আরও শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয় এবং এবিপি গ্রুপের সাথে ‘বিবাদ মিটিয়ে’ ফেলার চেষ্টা করে। দুই বছর রাজ্য সরকার বিজ্ঞাপন ইস্যু না করে তাদের স্ক্রু টাইট দেয়। ফলে ব্যবস্থাপনা কমিটিকে টিএমসি নেতৃবৃন্দের সাথে একটা সমঝোতায় আসতে হয়, যেটার কারণে পত্রিকাটি যে ‘সরকার-বিরোধী’ অবস্থানের বিভ্রম তৈরি করেছিল, সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত কয়েক মাস ধরে কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিককে নিরবে অফিস ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে।
এমনকি সবকিছুতে কাটছাট করা হলেও, এবিপি গ্রুপের জন্য সবকিছু ততটা ভালো হয়নি। ১ ফেব্রুয়ারি, এক ফেসবুক পোস্টে আনন্দবাজার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক অনির্বান চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে, “যারা আতঙ্কের মধ্যে থাকে, তারা তাদের সেরা কাজটা করতে পারে না… কোম্পানিগুলো যদি তাদের উৎপাদন বাড়াতে চায় এবং আশা করে যে তাদের কর্মীবাহিনী সেই ধরনের সৃজনশীল চিন্তায় মগ্ন থাকবে, যেখান থেকে অসাধারণ আইডিয়া উঠে আসবে, তাহলে প্রথমে তাদেরকে নিরাপদ বোধ করতে দিতে হবে। প্রশিক্ষণে আরও বেশি ব্যয় করুন। বেতনের কিছুটা উন্নত করুন। স্বাস্থ্য সেবা সুবিধা ও চাকরির নিরাপত্তা দিন। যে কোন সময় চাকরি চলে যেতে পারে, এই ভয় দূর করুন। কিন্তু বহু কোম্পানি ঠিক তার উল্টোটাই করছে”।
এই পোস্টে রাখঢাকের কিছু নেই, কিন্তু আনন্দবাজারের সাবেক একজন নির্বাহী সম্পাদক যেমনটা বলেছেন, “একটা সময় ছিল যখন এই পত্রিকাটি জরুরি পরিস্থিতিতে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিল। অতীতেও কঠিন সময় গেছে তাদের উপর দিয়ে, কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, সেটা পশ্চিম বঙ্গের সাংবাদিকতা নিয়ে একটা দুঃখজনক ধারাভাষ্য চলছে যেন”।

No comments

Powered by Blogger.