ইরানের সার্বিক উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা

১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব দেশটিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে। দেশের সম্পদ রাজতন্ত্রীয় অধিকার থেকে রাষ্ট্রের অধিকারে চলে আসে। বিপ্লবের পর ইরান দ্রুততার সাথে এগিয়ে যেতে থাকে। ইরানের নারী সমাজও এর সুফল ভোগ করা সুযোগ পায়।
ইসলামি বিপ্লবের আগে নারীসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শাহবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। বিপ্লবের পরে এবং ইরাকের বিরুদ্ধে পবিত্র প্রতিরক্ষার যুদ্ধের সময়ও তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সে কারণে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেনী প্রায়ই বলতেন: ‘ইরানি নারীরা পুরুষদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে; আমাদের জাতি সাহসী নারীদের আত্মমনোবলের নিকট ঋণী।’
বিপ্লবী পূর্ববর্তী শাসকরা নারীর সাথে একজন বন্দির মতো আচরণ করত। তাদেরকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করত। নারীদের স্কার্ফ নিষিদ্ধ করে পুলিশকে আদেশ দেয়া হয়েছিল, কোনো মেয়ের মাথায় হিজাব থাকলে তা জোর করে খুলে দিতে। কিন্তু নতুন ইসলামী সরকার মেয়েদের হিসাব বাধ্যতামূলক করে। এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘ইসলামী বিপ্লবের আগে নারী স্বাধীনতার নামে নারীদের শুধু পোশাকহীন করে প্রদর্শনের সামগ্রী বানানোর সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব নারীকে কার্যকর অর্থেই সম্মানের স্থানে উন্নীত করে যাচ্ছে।’
অফিসে ব্যস্ত তিন নারী
নারীদের সাংবিধানিক অধিকার
হিজাব পরেও ইরানি নারীরা দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে দেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করার কারণে। সংবিধানের ৩ নম্বর ধারার ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নারী-পুরুষের সকল অধিকার প্রদান এবং সকলের জন্য আইনগত সুরক্ষার পাশাপাশি সকলের জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত করা ইসলামি সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। আইনের ২১ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামি নীতির ভিত্তিতে সকল নারীর অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে সরকার বাধ্য।

রাষ্ট্রদূত মারজিয়ে আফখাম- ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুমেহ এবতেকার
সরকারে নারীদের অংশগ্রহণ
ইসলামে সরকারের উচ্চতর সোপানে দায়িত্ব পালনে নারীদেরকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীরা নির্বাহী পর্যায়েও দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বর্তমান সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাসুমেহ এবতেকার। ড. হাসান রুহানি ক্ষমতায় আসার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মারজিয়ে আফখাম। তিনি একজন নারী। সম্প্রতি মারজিয়ে আফখামকে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সর্বত্র নারীর ব্যাপক উপস্থিতি
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ছাড়াও ইরানের যেকোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থায় গেলে দেখা যাবে নারীর ব্যাপক উপস্থিতি। ইরানি নারীরা এখন বিমান ও জাহাজ চালনা থেকে শুরু করে বাস, ট্যাক্সিও চালায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, বিমা, রেডিও-টেলিভিশন সব জায়গাতেই নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে গেলে দেখা যাবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি।

নারী ট্যাক্সি চালক
তেহরান ট্যাক্সি সার্ভিসে চালক হিসেবেও বহু নারী কাজ করে থাকেন। আর ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। যেকোনো নারীই পারেন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে গাড়ি চালাতে। শুধু গাড়ি চালানো নয়, তেহরানে যত ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তার বেশির ভাগ জনশক্তি হচ্ছে নারী। তেহরান শহরের টেলিফোন অফিসগুলোতে কিংবা মেট্রো স্টেশনগুলোতে দেখা যাবে নারী জনশক্তিই বেশি। একই চিত্র দেখা যাবে খাবার রেস্টুরেন্ট কিংবা বড় বিপণী বিতান ও সুপার মার্কেটগুলো।
নারীর সামাজিক নিরাপত্তা
কঠোর নিরাপত্তার কারণে ইরানে ধর্ষণ বা ইভটিজিং নেই বললেই চলে। গভীর রাতেও একজন নারী একাকি পথ চললে কেউ কিছু বলে না। তেহরানে যেসব বাস চলাচল করে সেগুলোর মাঝখানে পার্টিশন দেয়া থাকে। সম্মুখভাগে মহিলাদের বসার জায়গা আর পেছনের অংশটা পুরুষদের জন্য। ফলে প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যেও কাউকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় না। মেট্রো রেলেও মহিলাদের জন্য আলাদা বগি রয়েছে। মহিলাদের শরীরচর্চা ও ক্রীড়া কার্যক্রম পুরোপুরিভাবে মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। মূলত পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কারণেই শরীরচর্চা ও ক্রীড়াঙ্গনেও ইরান মেয়েদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

নারী পুলিশ
চাকরিতে নারী
ইরানের সরকারি পদের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগই নারীদের যা অন্যকোনো মুসলিম দেশে চিন্তাও করা যায় না। দেশটির চাকরির বাজারে বিগত তিন বছরে নারীদের উপস্থিতির সংখ্যা বেড়েছে ৪০ ভাগ। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফারসি বছরে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলির বিভিন্ন শাখাতে নারী কর্মচারীদের সংখ্যা বেড়েছে ২৯ ভাগ। অন্যদিকে, বেসরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলিতে বেড়েছে ৩২ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ২০ শতাংশ।
ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের অপর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৫০ শতাংশ ইরানি নারী শিল্পক্ষেত্রে কাজ করছে। দেশজুড়ে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন চাকরি ক্ষেত্রের ১ লাখ কর্মচারীরা ওপর জরিপ পরিচালনা করে এই তথ্য দেওয়া হয়।

বর্ষসেরা ইরানি নাবিক রাহেলে তাহমাসবি
ইরানে তৎপর ৭০০ নারী উদ্যোক্তা
ইরানে অন্তত ৭০০ নারী উদ্যোক্তা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তৎপর রয়েছেন। নারী উদ্যোক্তাদের জন্যে বিশেষ ঋণ দেওয়া হচ্ছে ইরানের শিল্প পার্কে। ক্ষুদ্র শিল্পে নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
ইলেক্ট্রনিক্স, রসায়ন ও সেবাখাতে নারী উদ্যোক্তারা বেশ এগিয়েছেন। এছাড়া খাদ্য ও ধাতব শিল্পেও নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছেন। এমনকি ইরানের নারী উদ্যোক্তারাদের পণ্য রফতানির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্যে ১০ বছর পর্যন্ত করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তাদের জমি দেয়া হচ্ছে মাত্র ৫ ভাগ মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে। এরপর ৬০টি কিস্তিতে জমির মোট মূল্য পরিশোধের সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে কোনো বাণিজ্য মেলায় অংশ নিতে নারী উদ্যোক্তাদের দেয়া হচ্ছে ১২শ’ মার্কিন ডলারের বিশেষ সুবিধা।

শিল্প কারখানায় কর্মরত দুই নারী
শ্রমবাজারে নারী
গত ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইরানের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ। বর্তমানে তা ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেশটির নারীরা আগামী দশবছরে শ্রমবাজারের ৪৫ ভাগ দখল করবে বলে দেশটির সমবায়, শ্রম ও সামাজিক কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। গবেষকরা বলছেন, নারীদের অধিক কর্মক্ষম হয়ে ওঠার প্রবণতাই দেশটির শ্রমবাজারের চেহারা পাল্টে দেবে। অনেক নারী উদ্যোক্তা তাদের কাজ ভালোভাবেই করছেন। শুধু ইরান নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পুরুষের চেয়ে নারীরা অধিক হারে উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসছে।

নারী নির্মাতা নার্গিস অবইয়ার
চলচ্চিত্রে নারী
ইরানে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী। চলতি বছর আন্তর্জাতিক ফজর চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা মুভির পুরস্কার পেয়েছে নারী নির্মাতা নার্গিস অবইয়ারের ‘দ্য নাইট হোয়েন দ্য মুন ওয়াজ ফুল’ (যে রাতে চাঁদ পূর্ণতা পেয়েছিল) ছবিটি। সেরা ছবির পাশাপাশি সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা (হুতান শাকিবা), সেরা অভিনেত্রী (এলনাজ শাকেরদুস্ত), সেরা সহ-অভিনেত্রী (ফেরেশতে সদর ওরাফায়ি), সেরা মেকআপ ও সেরা পোশাক ডিজাইনের পুরস্কারও জিতেছে এটি। উল্লেখ্য, ইরানের এই ছবির ২০ ভাগ শুটিং হয়েছে বাংলাদেশে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ইরানি নারীদের অংশগ্রহণ যে কত বেশি তার একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে। ২০১৭ সালের আগস্টে ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক শাহর চলচ্চিত্র উৎসবের  বিভিন্ন বিভাগে অংশ নেন ইরানের ১৮০ জনের বেশি নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা। তারা ওই আসরের ফিচার, পূর্ণ দৈর্ঘ্য ফিচার, মাঝারি-দৈর্ঘ্য ফিচার, স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি, ডকুমেন্টারি, মাঝারি-দৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি, স্বল্পদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি, অ্যানিমেশন ও নেইবরহুড বিভাগে অংশ নেন।

কিমিয়া আলীজাদেহ জিনোরিন
ক্রীড়াঙ্গনে নারী
অলিম্পিক থেকে শুরু থেকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ইরানি নারীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ফুটবল, ফুটসল, ভলিবল, জুড়ো, তায়কোয়ান্দো, কারাতে, শ্যুটিং, রেসলিং, দাবা প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় ইরানি নারীরা মাঝেমধ্যেই পুরস্কার জেতেন। ২০১৬ সালের রিও ডি জেনেইরো অলিম্পিকে তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় মেয়েদের ৫৭ কেজি ওজনশ্রেণিতে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন ইরানি তরুণী কিমিয়া আলীজাদেহ জিনোরিন। এর মাধ্যমে তিনি অলিম্পিকে প্রথম কোনো ইরানি নারী হিসেবে পদক জেতার গৌরব অর্জন করেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন আর তা হলো যেসব খেলায় ইসলামি ড্রেস কোড অনুসরণ করা সম্ভব ইরানি নারীরা কেবল সেগুলোতেই অংশ নেয়।
এখানে কয়েকটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা করা হলেও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইরানি নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষনীয়। আর এটা সম্ভব হয়েছে বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনীর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তিনি সমাজে নারীর ভূমিকা ও উপস্থিতির প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ইমাম খোমেনী ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সূচনাকালে মহিলাদেরকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং সমাজে মহিলাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সমাজের একটি বৃহৎ মানবীয় সম্পদ হিসেবে তিনি মহিলাদের গতিশীল ভূমিকা সংহত করার ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি নারীকে বিপ্লবের সংকটময় মুহূর্তগুলোতে পুরুষকে ‘সাহস সঞ্চারকারী’ ও ‘প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিতকারী’ হিসেবে পরিচিত করিয়েছিলেন। নারীর কেন্দ্রীয় বা প্রধান ভূমিকার প্রতি নির্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের যা কিছু রয়েছে, তার সবকিছুই নারীর কারণে।’

No comments

Powered by Blogger.