সার্বভৌমত্ব এবং অপরাধের বিচার সোফা চুক্তির বিতর্কিত ইস্যু by পি কে বালাচন্দ্রন

অর্থমন্ত্রী মাঙ্গালা সামারাবিরা ছাড়া শ্রীলংকার বাকি রাজনীতিবিদদের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট (সোফা) চুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা করছেন। প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এ ধরনের কোন চুক্তি তিনি হতে দিবেন না।
সাধারণ বিশ্বাস এই যে সোফা চুক্তির কারণে শ্রীলংকার সার্বভৌমত্বের বিষয়টি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, অথচ বিশ্বের কোন দেশের পক্ষ থেকে কোন ধরনের হুমকি মধ্যে নেই।
তবে, এখনও সম্ভাবনা রয়েছে যে, চীনকে নিয়ন্ত্রণের অতিরিক্ত উদ্বেগের কারণে যুক্তরাষ্ট্র হয়তে কলম্বোর ক্ষমতাশালীদের এই চুক্তিতে আসার ব্যাপারে চাপ দেবে।
কারণ, শ্রীলংকা অন্তত কিছু জটিল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত হতে বাধ্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এলটিটিই বিরোধী যুদ্ধে শ্রীলংকাকে কৌশলগত দিক থেকে সহায়তা করেছিল। এলটিটিই’র অস্ত্রবাহী জাহাজের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রই শ্রীলংকাকে দিয়েছিল। চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ অ্যাডমিরাল রবিন্দ্র বিজেগুনারত্নে সিসারা টেলিভিশনে পেথিকাদা অনুষ্ঠানে এটা উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র একই সাথে শ্রীলংকার স্মল বোট স্কোয়াড্রনকে প্রশিক্ষণও দিয়েছিল, যারা এলটিটিই’র সি টাইগারদের পরাজিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি একটি কোস্ট গার্ড নৌযান উপহারও দিয়েছে।
সোফার বর্তমান খসড়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করেছে শ্রীলংকার সামরিক বাহিনী। কিন্তু একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কাও তাদের মধ্যে রয়েছে। সামরিক বাহিনী তাই সতর্কতার সাথে দর কষাকষির মাধ্যমে এমনভাবে সোফা চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে যাতে শ্রীলংকার সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না হয় এবং স্থানীয় সামরিক বাহিনীকে যাতে দর্শক হিসেবে বসে থাকতে না হয়।
গ্লোবালসিকিউরিটি ওয়েবসাইটে গতানুগতিক সোফা চুক্তির একটা ধারণা দেয়া হয়েছে। এখন প্রায় শ’ খানেক সোফা চুক্তি রয়েছে, যেখানে ঘাঁটি স্থাপন বা প্রবেশ সুবিধার কোন বিষয় নেই। বরং অন্য দেশে কর্মরত মার্কিন সেনা ও সম্পত্তির সুরক্ষা ও আইনি বিষয়গুলোর বিবরণ রয়েছে সেখানে।
এ ধরনের চুক্তির উদ্দেশ্য হলো ওই দেশে কর্মরত মার্কিন সেনাদের অধিকার ও দায়দায়িত্বগুলো নির্ধারণ করা। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিমিনাল ও সিভিল আইনি প্রক্রিয়া, পোশাক পরিধানের বিধিবিধান, অস্ত্র বহন, কর ও কাস্টমস মওকুফের বিধান, সেনা ও সরঞ্জামের প্রবেশ ও বাহির হওয়ার নিয়মকানুন, এবং ক্ষয়ক্ষতি পূরণের বিধানসমূহ।
সিভিল/ক্রিমিনাল বিচার প্রক্রিয়া
সোফা চুক্তির সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু হলো সিভিল ও ক্রিমিনাল বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়। মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের (ডিওডি) দায়িত্ব হলো “বিদেশে যে সব মার্কিন সেনা অপরাধী আইনে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে বা বিদেশের কারাগারে বন্দি হচ্ছে, তাদের জন্য সর্বোচ্চ সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা”।
সে কারণে সোফা চুক্তি যেটা করছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কোন সেনা অফিসিয়াল কর্মরত থাকাকালে কোন অপরাধে জড়িত হলে তার বিচার করার প্রাথমিক কর্তৃত্ব থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের, সংশ্লিষ্ট দেশের নয়।
যে সব চুক্তির মাধ্যমে কিছু ক্ষেত্রে ওই দেশকে বিচারের প্রাথমিক কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে, সেখানে, মার্কিন ডিওডি সেনাদের ‘ফেয়ার ট্রায়াল গ্যারান্টির’ মাধ্যমে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা পরামর্শের সুযোগ, দোভাষী সুবিধা, বিচার পর্যবেক্ষক এবং কারাগারে সফরের সুবিধা।
ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা
গ্লোবালসিকিউরিটি ওয়েবসাইটে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর অধীনে যারা কর্মরত এবং তারা অন্য দেশে দায়িত্ব পালনকালে সেখানকার কোন আইন লঙ্ঘন করলে তাদের আইনের অধীনে এনে বিচারের দায়িত্ব মার্কিন সামরিক বাহিনীর।
ডিওডি নির্দেশনায় ‘ন্যায় বিচারের’ জন্য ১৪টি সুরক্ষামূলক বিষয় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলো মার্কিন প্রাদেশিক অপরাধ মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যেটা মার্কিন সংবিধানে ১৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে।
এই সুরক্ষামূলক বিধানের মধ্যে রয়েছে অযৌক্তিক বিলম্ব ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করা। একটা পক্ষপাতহীন আদালতে বিচার করা এবং নির্যাতন, হুমকি বা সহিংস উপায়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা থেকে বিরত থাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডিং অফিসাররা যদি মনে করেন যে, তার অধীনস্থ কোন আমেরিকান বিদেশী কোন আইনের অধীনে সেই অধিকার পাচ্ছে না, যেই অধিকার মার্কিন সংবিধানে তাকে দেয়া হয়েছে, তাহলে তারা ওই দেশকে অনুরোধ করবে যাতে সোফা চুক্তির অধীনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ওই দেশের কর্তৃপক্ষ যদি সেই অনুরোধ নাকচ করে দেয়, মার্কিন কমান্ডার সে ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবগত করবে যাতে কূটনৈতিক চ্যানেলে ওই অনুরোধ মানতে চাপ দেয়া হয়। মার্কিন সামরিক কমান্ডাররা হয়তো ওই দেশের আইনি সুরক্ষা ছাড়া অন্যান্য কারণেও ছাড় পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে এবং অধিকাংশ দেশেই তারা নিয়মিত এ ধরনের ছাড় পেয়ে আসছে বলে গ্লোবালসিকিউরিটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে।
জাপানে যে সব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে সোফা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই জাপান যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সামরিক ও রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে চলে আসছে। ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সাথে সোফা চুক্তি স্বাক্ষর করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ওকিনাওয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা অবস্থান করছে। কিন্তু ওকিনাওয়াতাকে কয়েক হাজার মার্কিন সেনার অবস্থান নিয়ে সবসময়ই বিতর্ক চলে এসেছে।
মার্কিন বাহিনীর সদস্য ও আর যারা তাদের হয়ে কাজ করছে, তারা যদি কাজে নিযুক্ত থাকাকালে জাপানের কোন আইন ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের বিচারের কর্তৃত্ব ১৭ অনুচ্ছেদের অধীনে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে দেয়া হয়েছে। পুলিশ এই অনুচ্ছেদ নিয়ে সবসময় সমস্যায় পড়েছে।
জাপানী পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, মার্কিন সামরিক বাহিনীর সাথে জড়িত কেউ মারাত্মক কোন অপরাধে যুক্ত হলে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে সবসময় অসহযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। জাপান টাইমস এক রিপোর্টে এ তথ্য জানিয়েছে।
পত্রিকাটিতে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে সঙ্ঘটিত একটি ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কর্মরত একজন বেসামরিক ব্যক্তি রুফুস জে র‍্যামসি ওকিনাওয়াতে ক্যাম্প ফস্টারে কাজ করছিল। অফিসের কাজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছুটি নিয়ে যখন সে বাড়ি ফিরছিল, তখন ১৯ বছর বয়সী কোকি ইয়োগির সাথে তার গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় এবং এতে কোকি মারা যায়। কিন্তু এরপরও যুক্তরাষ্ট্র তাকে অন-ডিউটি হিসেবে গণ্য করছে এবং ১৭ অনুচ্ছেদকে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে জাপানি আইনে পদক্ষেপ নিতে দিচ্ছে না।
তবে, নভেম্বরে, একটা চুক্তি হয়েছে যাতে বলা হয়েছে যে, কেউ ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার মতো ‘মারাত্মক’ কোন অপরাধে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে জাপানি আইনে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি তার বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ আনতে না চায়, তবেই কেবল সেই ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এই মামলাটি ওকিনাওয়াতে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে এবং ওয়াশিংটন ও টোকিও সোফা চুক্তিটি সংশোধনের জন্য তীব্র চাপের মুখোমুখি হয়েছে।
জাপান টাইমস আরও বলেছে যে, ১৯৯৫ সালে তিন মার্কিন সেনা কর্তৃক ১২ বছর বয়সী এক মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় সোফা চুক্তি এবং সেখানে মার্কিন ঘাঁটির অবস্থান – উভয়ের বিরুদ্ধেই ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম নেয়।
পত্রিকাটি বলেছে, “এক দশক পর যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সরকার মেরিন্স কর্পস এয়ার স্টেশানকে ওকিনাওয়ার আরও কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সরিয়ে নিতে রাজি হয় এবং ৮০০০ মেরিন সেনাকে গুয়ামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই স্থানান্তরের জন্য টোকিওকে ৬ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে”।
মার্কিন আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের আইনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে এবং সে কারণে মার্কিন সেনা সদস্যদেরকে জাপানি পুলিশের হাতে তুলে দেয়াটা সমস্যাজনক। জাপান টাইমস এটা উল্লেখ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর পুলিশ অবশ্যই আটক ব্যক্তিকে তার অধিকারের বিষয়টি উল্লেখ করবে। কিন্তু ফৌজদারি মামলায় জাপানে যারা আটক হয়, তাদের জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো জাপানে কাউকে আটক করা হলে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোন অভিযোগ ছাড়াই তাকে ২৩ দিন পর্যন্ত আটকে রাখার সুযোগ রয়েছে। এ সময়ে তাকে আইনি সহায়তা নিতে দেয়ারও কোন বাধ্যবাধকতা নাই।
জাপান টাইমসকের নিবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সোফা চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, জাপানি কর্তৃপক্ষ সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত বা তাদের সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে অনুসন্ধান, পরিদর্শনের কোন অনুমতি পাবে না।
জাপানি পুলিশ যদি মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর কাউকে বা তাদের সম্পত্তির মধ্যে তল্লাশি, আটক বা পরিদর্শন করতে চায়, তাহলে তাদেরকে অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে এবং এই আবেদন গ্রহণ বা বর্জন হতে পারে।
একটি উদাহরণ দিয়ে জাপান টাইমস বলেছে: ২০০৪ সালের আগস্টে, একটি মার্কিন মেরিন কর্পস সি স্ট্যালিয়ন হেলিকপ্টার ওকিনাওয়া ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়। কেউ এতে নিহত হয়নি বা আহতও হয়নি। কিন্তু বিতর্কের শুরু হয় তখন, যখন নিকটস্থ ফুতেনমা ঘাঁটি থেকে মার্কিন মেরিন সেনারা এসে বিধ্বস্তের জায়গাটি ঘিরে রাখে এবং এমনকি ওকিনাওয়া পুলিশ বা ফায়ার ফাইটারদেরকেও সেখানে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
পরে অনেকটা জোর করে এই পার্থক্য খানিকটা ঘোচানো হয়। কিছুটা প্রবেশের অধিকার দেয়া হয় পুলিশকে। কিন্তু এরপরও ক্ষতিগ্রস্ত হেলিকপ্টারের কিছুই দেখতে পারেনি পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.