ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত ভারতের মুসলিমরা -বিবিসির প্রতিবেদন by রাজিনি বিদ্যানাথান

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ঘৃণা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক এই দেশটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অধীনে ক্রমশ ভয়াবহভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। বিবিসিতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন রাজিনি বিদ্যানাথান।
এতে তিনি লিখেছেন, ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট গ্রহণের মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের একজন মুসলিম ব্যবসায়ী তার কাজ শেষে ফিরছিলেন। কিন্তু এ সময় তাকে ঘিরে ধরে দাঙ্গাকারীরা। ওই মুসলিমের নাম শওকত আলী। তাকে একদল দাঙ্গাকারী ঘিরে ধরে কর্দমাক্ত স্থানে হাঁটু গেঁড়ে বসতে বাধ্য করে। এরপর তার ওপর হামলা হয়। তাদের একজন শওকত আলীকে ভারতের নাগরিক কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করেন। জানতে চান- ‘আপনি কি বাংলাদেশী?’ অন্য একজন শওকত আলীর দিকে আঙ্গুল নাচাতে নাচাতে জানতে চান, কেন এখানে গরুর মাংস বিক্রি করেছেন? এ সময় তার চারপাশে অনেক মানুষ সমবেত হয়। তারা শওকত আলীকে সহায়তা করার পরিবর্তে ঘটনা মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করতে শুরু করে।
প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেছে। শওকত আলী এখনও ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না। রাজিনি বিদ্যানাথান লিখেছেন, তিনি যেখানে দোকান চালান সেখান থেকে অল্প দূরেই তার বাড়িতে গেলাম সাক্ষাত করতে। তিনি বিছানায় পা ক্রস করে দিয়ে বসলেন। কথা বলার সময় অশ্রুতে চোখ ভরে যেতে লাগলো। তিনি বর্ণনা করতে লাগলেন কি ঘটেছিল সেদিন। শওকত আলী বলেন, তারা একটি লাঠি দিয়ে আমাকে পিটিয়েছে। মুখে লাথি মেরেছে। এ সময় তিনি তার থুঁতনির নিচে এবং মাথায় ক্ষতের চিহ্ন দেখান।
কয়েক দশক ধরে ছোট্ট একটি দোকান থেকে গরুর মাংস বিক্রি করে তার পরিবার। কিন্তু এর আগে কখনো তাদেরকে এমন বিপত্তিতে পড়তে হয় নি। ভারতের অনেক রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে গরুর মাংস আসামে বিক্রি করা বৈধ। শওকত আলী শুধু শারীরিকভাবে আহত হন নি। একই সঙ্গে তার মানমর্যাদাও যেন কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার ওপর হামলাকারীরা তাকে শূকরের মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য করেছে। তাকে বাধ্য করেছে ওই মাংস চিবাতে এবং তারপর তা গিলে ফেলতে। কান্নায় ভেঙে পড়েন শওকত আলী। তিনি বলেন, আমার এখন বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। আমার ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে তা আমার পুরো ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত।
রাজিনি লিখেছেন, যেদিন আমরা শওকত আলীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেলাম, সেদিন তার বাড়িতে সমবেত হলেন স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। তারা সবাই শওকত আলীর কাহিনী শুনছিলেন। শুনতে শুনতে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলেন। তাদের মধ্যে ভয়, তারাও কি একই রকম বিপর্যয়ের শিকার হবেন!
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের নির্বাচন চলছে ভারতে। কিন্তু প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, কিভাবে দেশটির ১৭ কোটি ২০ লাখ মুসলিমকে কিভাবে সেই যাত্রায় সবার সঙ্গে অঙ্গীভূত করা হচ্ছে তা নিয়ে। গরুর মাংস বিক্রির জন্য অথবা সন্দেহজনকভাবে গরুর মাংস বিক্রির অভিযোগে আক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সর্বশেষ শিকার শওকত আলী। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার এক রিপোর্টে বলে যে, ২০১৫ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতের ১২টি রাজ্যে কমপক্ষে ৪৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ জনই মুসলিম। একই সময়ে ২০টি রাজ্যে শতাধিক হামলায় আহত হয়েছেন প্রায় ২৮০ জন। বার্ষিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেলে ব্যাচেলেট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হয়রানি ও তাদেরকে টার্গেট করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে মুসলিম ও ঐতিহাসিকভাবে যেসব মানুষ পিছিয়ে পড়েছে এবং প্রান্তিক পর্যায়ে আছেন- যেমন দলিত, তারাই এমন আচরণের শিকার হচ্ছেন।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারতে সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সহিংসতা কাঙ্খিত নয়। কিন্তু বাস্তব উদ্বেগের বিষয় হলো, যারাই বর্তমানে ক্ষমতা পান তারাই দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভোট করেন। এর সবচেয়ে শিহরণ সৃষ্টিকারী ঘটনারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে ভয়াবহ সব গণধর্ষণের পরের একটি বিষয়। গত বছর জানুয়ারিতে আট বছর বয়সী একটি মুসলিম মেয়ে তাদের ঘোড়াকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের কাঠুয়া জেলায় তার বাড়ি। সেখান থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। হিন্দুদের একটি মন্দিরে তাকে এক সপ্তাহ জিম্মি রাখা হয়। এ সময়ে তাকে পর্যায়ক্রমে গণধর্ষণ করা হয়। নির্যাতন করা হয়। তারপর তাকে হত্যা করা হয়। এর পরে এ নিয়ে পুলিশ রিপোর্ট দেয়। তাতে বলা হয়, যাযাবর বলে পরিচিত মুসলিম বাকেরওয়াল সম্প্রদায়কে ওই এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ। এ জন্যই তারা ওই অপরাধ ঘটিয়েছে।
এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কাঠুয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় ওই কন্যাশিশুর বাড়ির বাইরে এখন একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে প্রহরা দিচ্ছেন। রাজিনি লিখেছেন, নিহত কন্যার পিতা আমার সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখন তার চোখ দিয়ে যেন অশ্রুর বাঁধ মানছিল না। তিনি বলছিলেন, অভিযুক্তরা বলেছে ও হলো একজন মুসলিম কন্যা। তাকে হত্যা করো। এতে তারা ভয়ে ভীত হয়ে যাবে এবং এ এলাকা থেকে পালিয়ে যাবে।
কিন্তু ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তারা এক সময় যে বাড়িতে বসবাস করতেন তা তারা ছাড়তে পারেন নি। তারা ওই বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। ওই কন্যাশিশুর মা বলেন, আমরা বাড়ির বাইরে যেতে ভয় পাই। ভয় হয় আমাদের জীবনও শেষ করে দিতে পারে। আমরা বাইরে পা বাড়ালেই লোকজন আমাদেরকে প্রহার করার হুমকি দেয়।
আট বছর বয়সী ওই কন্যাশিশুকে হত্যার পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। ওই নৃশংসতায় অভিযুক্ত আটজন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পক্ষেই রয়েছে বেশি মানুষের সমর্থন। তারা নির্যাতনে শিকার হয়ে মারা যাওয়া ওই শিশু ও তার পরিবারের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায় নি। অভিযুক্তদের পক্ষে রাজপথে সমর্থন জানিয়ে যারা বিক্ষোভ করেছে তার মধ্যে রয়েছে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপির দু’জন মন্ত্রী চৌধুরী লাল সিং এবং চন্দর প্রকাশ গঙ্গা। ওই সময় এক র‌্যালিতে লাল সিং বলেছিলেন, একজন মেয়ে মারা গেছে। অনেক তদন্ত হচ্ছে। এখানে তো এরকম অনেক নারীই মারা যান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ঘৃণা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক এই দেশটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অধীনে ক্রমশ ভয়াবহভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। বিবিসিতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন রাজিনি বিদ্যানাথান।
এতে তিনি লিখেছেন, ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট গ্রহণের মাত্র কয়েক দিন আগের ঘটনা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের একজন মুসলিম ব্যবসায়ী তার কাজ শেষে ফিরছিলেন। কিন্তু এ সময় তাকে ঘিরে ধরে দাঙ্গাকারীরা। ওই মুসলিমের নাম শওকত আলী। তাকে একদল দাঙ্গাকারী ঘিরে ধরে কর্দমাক্ত স্থানে হাঁটু গেঁড়ে বসতে বাধ্য করে। এরপর তার ওপর হামলা হয়। তাদের একজন শওকত আলীকে ভারতের নাগরিক কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করেন। জানতে চান- ‘আপনি কি বাংলাদেশি?’ অন্য একজন শওকত আলীর দিকে আঙ্গুল নাচাতে নাচাতে জানতে চান, কেন এখানে গরুর মাংস বিক্রি করেছেন? এ সময় তার চারপাশে অনেক মানুষ সমবেত হয়। তারা শওকত আলীকে সহায়তা করার পরিবর্তে ঘটনা মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করতে শুরু করে। প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেছে।
শওকত আলী এখনও ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না। রাজিনি বিদ্যানাথান লিখেছেন, তিনি যেখানে দোকান চালান সেখান থেকে অল্প দূরেই তার বাড়িতে গেলাম সাক্ষাৎ করতে। তিনি বিছানায় পা ক্রস করে দিয়ে বসলেন। কথা বলার সময় অশ্রুতে চোখ ভরে যেতে লাগলো। তিনি বর্ণনা করতে লাগলেন, কী ঘটেছিল সেদিন। শওকত আলী বলেন, তারা একটি লাঠি দিয়ে আমাকে পিটিয়েছে। মুখে লাথি মেরেছে। এ সময় তিনি তার থুঁতনির নিচে এবং মাথায় ক্ষতের চিহ্ন দেখান।কয়েক দশক ধরে ছোট্ট একটি দোকান থেকে গরুর মাংস বিক্রি করে তার পরিবার। কিন্তু এর আগে কখনো তাদেরকে এমন বিপত্তিতে পড়তে হয়নি। ভারতের অনেক রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে গরুর মাংস আসামে বিক্রি করা বৈধ। শওকত আলী শুধু শারীরিকভাবে আহত হননি। একই সঙ্গে তার মানমর্যাদাও যেন কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার ওপর হামলাকারীরা তাকে শূকরের মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য করেছে। তাকে বাধ্য করেছে ওই মাংস চিবাতে এবং তারপর তা গিলে ফেলতে। কান্নায় ভেঙে পড়েন শওকত আলী। তিনি বলেন, আমার এখন বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। আমার ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে তা আমার পুরো ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত।
রাজিনি লিখেছেন, যেদিন আমরা শওকত আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম, সেদিন তার বাড়িতে সমবেত হলেন স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। তারা সবাই শওকত আলীর কাহিনী শুনছিলেন। শুনতে শুনতে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলেন। তাদের মধ্যে ভয়, তারাও কি একই রকম বিপর্যয়ের শিকার হবেন!
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের নির্বাচন চলছে ভারতে। কিন্তু প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, কীভাবে দেশটির ১৭ কোটি ২০ লাখ মুসলিমকে সেই যাত্রায় সবার সঙ্গে অঙ্গীভূত করা হচ্ছে তা নিয়ে। গরুর মাংস বিক্রির জন্য অথবা সন্দেহজনকভাবে গরুর মাংস বিক্রির অভিযোগে আক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সর্বশেষ শিকার শওকত আলী। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার এক রিপোর্টে বলে যে, ২০১৫ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতের ১২টি রাজ্যে কমপক্ষে ৪৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ জনই মুসলিম। একই সময়ে ২০টি রাজ্যে শতাধিক হামলায় আহত হয়েছেন প্রায় ২৮০ জন। বার্ষিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেলে ব্যাচেলেট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হয়রানি ও তাদেরকে টার্গেট করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে মুসলিম ও ঐতিহাসিকভাবে যেসব মানুষ পিছিয়ে পড়েছে এবং প্রান্তিক পর্যায়ে আছেন- যেমন দলিত, তারাই এমন আচরণের শিকার হচ্ছেন।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারতে সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সহিংসতা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু বাস্তব উদ্বেগের বিষয় হলো, যারাই বর্তমানে ক্ষমতা পান তারাই দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভোট করেন। এর সবচেয়ে শিহরণ সৃষ্টিকারী ঘটনারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে ভয়াবহ সব গণধর্ষণের পরের একটি বিষয়। গত বছর জানুয়ারিতে আট বছর বয়সী একটি মুসলিম মেয়ে তাদের ঘোড়াকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের কাঠুয়া জেলায় তার বাড়ি। সেখান থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। হিন্দুদের একটি মন্দিরে তাকে এক সপ্তাহ জিম্মি রাখা হয়। এ সময়ে তাকে পর্যায়ক্রমে গণধর্ষণ করা হয়। নির্যাতন করা হয়। তারপর তাকে হত্যা করা হয়। এর পরে এ নিয়ে পুলিশ রিপোর্ট দেয়। তাতে বলা হয়, যাযাবর বলে পরিচিত মুসলিম বাকেরওয়াল সম্প্রদায়কে ওই এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ। এ জন্যই তারা ওই অপরাধ ঘটিয়েছে।
এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কাঠুয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় ওই কন্যাশিশুর বাড়ির বাইরে এখন একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে প্রহরা দিচ্ছেন। রাজিনি লিখেছেন, নিহত কন্যার পিতা আমার সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখন তার চোখ দিয়ে যেন অশ্রুর বাঁধ মানছিল না। তিনি বলছিলেন, অভিযুক্তরা বলেছে ও হলো একজন মুসলিম কন্যা। তাকে হত্যা করো। এতে তারা ভয়ে ভীত হয়ে যাবে এবং এ এলাকা থেকে পালিয়ে যাবে।
কিন্তু ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তারা এক সময় যে বাড়িতে বসবাস করতেন তা তারা ছাড়তে পারেননি। তারা ওই বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। ওই কন্যাশিশুর মা বলেন, আমরা বাড়ির বাইরে যেতে ভয় পাই। ভয় হয় আমাদের জীবনও শেষ করে দিতে পারে। আমরা বাইরে পা বাড়ালেই লোকজন আমাদেরকে প্রহার করার হুমকি দেয়।
আট বছর বয়সী ওই কন্যাশিশুকে হত্যার পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। ওই নৃশংসতায় অভিযুক্ত আটজন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পক্ষেই রয়েছে বেশি মানুষের সমর্থন। তারা নির্যাতনে শিকার হয়ে মারা যাওয়া ওই শিশু ও তার পরিবারের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায়নি। অভিযুক্তদের পক্ষে রাজপথে সমর্থন জানিয়ে যারা বিক্ষোভ করেছে তার মধ্যে রয়েছে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপির দুজন মন্ত্রী চৌধুরী লাল সিং এবং চন্দর প্রকাশ গঙ্গা। ওই সময় এক র‌্যালিতে লাল সিং বলেছিলেন, একজন মেয়ে মারা গেছে। অনেক তদন্ত হচ্ছে। এখানে তো এরকম অনেক নারীই মারা যান।
আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র হবে ভারত!! ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত ভারতের মুসলিমরা
কাশ্মিরে ৮ বছর বয়সী মুসলিম এক কন্যাশিশুকে অপহরণ করে ধর্ষণকারীদের পক্ষ অবলম্বন করে র‌্যালি করেছেন সেখানকার বিজেপি দলীয় মন্ত্রী চৌধুরী লাল সিং এবং চন্দ্রর প্রকাশ গঙ্গা। ওই ধর্ষণের নিন্দা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তিনি এই ব্যক্তিদের এমন কর্মের কারণে পদত্যাগ করতে বলেন নি। কিন্তু বেশ কয়েক সপ্তাহের চাপের ফলে তারা পদত্যাগ করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, ধর্ষণে যুক্ত এবং তাদের পক্ষাবলম্বনকারীদের পক্ষে অবস্থান অব্যাহত রাখেন বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব। তিনি বলেন, দল চায় নি মিস্টার গঙ্গা এবং মিস্টার সিং পদত্যাগ করুন। তারা পদত্যাগ করেছেন এ জন্য যে, মিডিয়া একটি আবহ সৃষ্টি করেছিল, যাতে বলা হয়েছিল তারা ধর্ষণকারীদের সমর্থন করছেন। বিবিসিতে দীর্ঘ প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন রাজিনি বিদ্যানাথান।
তিনি আরো লিখেছেন, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি প্রকাশ্যে ধর্মীয় সহিংসতাকারীদের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। যারা মারাত্মকভাবে এসব সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন তাদের প্রতি মারাত্মক অসম্মান দেখানো হয়েছে এর মাধ্যমে। এখানে উল্লেখ্য, বিজিপি ধারণ করে হিন্দু জাতীয়বাদের আদর্শ। দলটির সিনিয়র অনেক কর্মকর্তা ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দাবি তুলেছেন। কিন্তু দলের নেতারা বার বার বলেছেন, তারা সংখ্যালঘুদের বিরোধী নন।
২০১৫ সালে ইট দিয়ে আঘাত করে ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ আখলাককে হত্যা করে একটি গ্রুপ। তাদের অভিযোগ, আখলাক গরু জবাই করেছিলেন। আখলাককে খুনিদের কাউকে কাউকে এবার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের পাশে নির্বাচনী র‌্যালিতে দেখা গেছে। যোগী আদিত্যনাথ প্রচ- ইসলামবিরোধী। এ জন্য গত মাসে তাকে কয়েকদিনের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল ভারতের নির্বাচন কমিশন। বিজেপির এই বিতর্কিত রাজনীতিককে মাঝে মাঝেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাশে দেখা যায় একই মঞ্চে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রীপরিষদের বেসামরিক বিমান চলাচল বিষয়ক মন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা অতি সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, ২০১৭ সালে এক গরু ব্যবসায়ী মুসলিমকে হত্যার জন্য মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে একদল মানুষকে। তাদের আইনগত ফি মিটানোর জন্য তিনি তাদেরকে অর্থ দিয়েছেন। বিবিসি হিন্দি’র জুগাল পুরোহিতের সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাতকারে জয়ন্ত সিনহা বলেছেন, তিনি ওইসব অভিযুক্তদের সহায়তা করছেন। তারা বিজেপির সদস্য। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, অভিযুক্তদের অন্যায়ভাবে দোষী দেখানো হয়েছে।
এ ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসের আউটসোর্সিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন শীর্ষস্থানীয় লেখিকা ও রাজনৈতিক অধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়। তিনি বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচক। অরুন্ধতী যুক্তি দেখান যে, এমন নজরদারীকারী গ্রুপ এসব অপরাধ করতে সক্ষম হচ্ছে। এর কারণ তাদেরকে উপর থেকে সুরক্ষা দেয়া হয়।
তবে বিজেপির মুখপাত্র নলিন কোহলি একথা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, তার দল ঘৃণাপ্রসূত অপরাধে কোনো ভূমিকা রাখে না। তিনি এক্ষেত্রে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলোর রিপোর্টের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি বলেন, তারা এমন সব পরিসংখ্যান উপস্থাপন করছে, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। কোহলি বলেন, মোদি সরকারের অধীনে বিজেপি দিয়েছে সমাজকল্যাণ। তাতে সুবিধা পেয়েছে সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষ। এ দলটি ১৩০ কোটি ভারতীয় নাগরিকের। এ দল ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য করে না।
কিন্তু এবার নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় অনেকেই আশঙ্কা করেছেন, বিজেপি যদি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে তাহলে দেশ একটি আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের খুব কাছাকাছি চলে যাবে।
সারাক্ষণ ভয়ে থাকেন তারা
সব ধর্মের মানুষের প্রতি সমান আচরণ করার কথা বলা হলেও ভারতে বৈষম্যের শিকার মুসলিমরা। এবারের নির্বাচনে বিজেপির ম্যানিফেস্টোর অন্যতম পয়েন্ট ছিল, ভারতে অবৈধভাবে বসবাসকারী কথিত সব বাংলাদেশী অভিবাসী থেকে দেশকে মুক্ত করা হবে। তবে এক্ষেত্রে তারা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, পারসি ও জৈন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছে। বলেছে, এসব সম্প্রদায়ের কোনো বাংলাদেশী অবৈধ উপায়ে ভারতে থাকলে তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া হবে। কিন্তু ব্যতিক্রমভাবে এই সাধারণ ক্ষমার বাইরে রাখা হয় মুসলিমদের। অর্থাৎ অন্য সম্প্রদায় ভারতে থাকতে পারলেও বাংলাদেশী কোনো মুসলিম সেখানে নাগরিকত্ব পাবেন না। আর এ উদ্দেশ্যেই আসামে সম্পন্ন হয়েছে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি। এর উদ্দেশ্য, সেখানে বসবাসকারী (তাদের ভাষায় অবৈধ বাংলাদেশী) মুসলিমদের বের করে দেয়া হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় এসব কথিত অভিবাসীদেরকে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ‘উইপোকা’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ নিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
অনলাইন বিবিসিতে রাজিনি বিদ্যানাথান লিখেছেন, আসামের গোয়ালপাড়ায় একটি গ্রামে একদল মানুষ প্লাস্টিকের চেয়ারে গোল হয়ে বসেছিলেন। তাদের অনেকের হাতে পেপার। তাতে তাদের পরিবারের সদস্যদের ছবি। গত বছর রাজ্যজুড়ে মানুষদের বলা হয় তাদের পারিবারিক ভিত্তি ও তারা যে ভারতীয় এ বিষয়ে প্রমাণ হাজির করতে। এক্ষেত্রে তাদেরকে সময় বেঁধে দেয়া হয়। বলা হয়, যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে আসামে প্রবেশ করেছেন তা তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে।
চার সন্তানের মা উফান। তিনি একটা কাগজের ভাজ খুললেন। এর ওপরে একটি ছবি। এটি তার স্বামীর ছবি। তিনি মারা গেছেন গত বছর। নিচে তার ছোট ছেলেদের ছবি। তার পরিবারের জন্ম ভারতে। কিন্তু তারা কেউই সরকারের নাগরিকপঞ্জিতে নাম নিশ্চিত করাতে পারেন নি। শুধু তারাই নন। ৪০ লাখ অধিবাসী এই তালিকার বাইরে রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই মুসলিম। তাই উফানের মধ্যে আতঙ্ক তাকে যেকোনো সময় দেশ থেকে বের করে দেয়া হতে পারে।
একই রকম পরিণতির মুখে আছেন মোহাম্মদ সামছুল। তিনি বলেছেন, তার পিতা, পিতামহের জন্ম আসামে। তাদের নাম আছে রেজিস্টারে। সামছুলের কাছে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট থাকা সত্ত্বেও তার নামটি তিনি এনআরসিতে নিবন্ধিত করাতে পারেন নি। তিনি বলেন, আমরা অব্যাহতভাবে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছি। আমাদের ভয়, রাতে পুলিশ আসবে। তারপর পুরো পরিবারকে কোনো শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিজেপি শুধু অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়নের মূল লক্ষ্য স্থির করেছে। কিন্তু এই প্রচারণাকে ব্যবহার করা হবে যেকোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে।
বিবিসির প্রতিবেদন by রাজিনি বিদ্যানাথান

No comments

Powered by Blogger.