আফগানিস্তান কেন আমেরিকার নতুন ভিয়েতনাম by ডেভিড জে বারকুসন

যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানরা গত এক বছর ধরে দোহাতে বেশ কয়েক দফা আলোচনায় মিলিত হয়েছে। আফগানিস্তানে আমেরিকান ও ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধের সমাপ্তি এবং তালেবান এবং ন্যাটো-সমর্থিত কাবুল সরকারের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ তৈরির জন্য এই আলোচনা করা হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওসহ বেশ কিছু পক্ষ আশা করছেন যে, মার্কিন-তালেবান আলোচনা সফলভাবে শেষ হবে। পাকিস্তান – যারা তালেবানদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে – তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে চায়, এবং আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসতে চান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তির প্রধান বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোন গোপনীয়তা নেই। প্রথমত যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো – যাদের প্রায় ২২০০০ সেনা রয়েছে আফগানিস্তানে – তারা অস্ত্রবিরতি করবে এবং পর্যায়ক্রমে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার শুরু করবে। এর মাধ্যমে তালেবানদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে কারণ তারা আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সেনার অপসারণ চেয়েছে। আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য মার্কিন সহায়তা বন্ধ হবে – আফগানরা আর আমেরিকান শক্তি, বিশেষ করে বিমানশক্তির সহায়তা পাবে না, যেটা দিয়ে তারা তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছিল।

এই সবগুলো হওয়ার পর, আফগান জাতীয় সরকার ও তালেবানদের মধ্যে আলোচনা শুরু হবে। এক ধরণের ক্ষমতা ভাগাভাগি এবং ১৮ বছর আগে তালেবানরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে যে সব সামাজিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, সেগুলো যাতে সংরক্ষিত হয়, সে সব নিয়েই মূলত আলোচনা হবে। এই সবকিছুর পর, এটা ধরে নেয়া হচ্ছে যে, পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়া, চীন ও ভারতের মাঝখানে অবস্থানের সুবিধাটাকে কাজে লাগিয়ে আফগানিস্তান তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে এবং জনগণের কল্যাণে তাদের বিশাল সম্পদের ব্যবহার শুরু করবে।

এভাবে সকল হত্যাযজ্ঞ, যুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ, বেসামরিক মানুষের মৃত্যু সবকিছুর একটা রূপকথার মতো ইতি ঘটবে। ২৩০০ বছর আগে আলেক্সান্ডার যে ভূমিকে পুরোপুরি পদানত করতে পারেননি, কিন্তু পরবর্তী সামাজ্যদের জন্য সেখানে অনুপ্রবেশ ও একইভাবে ব্যার্থ হওয়ার পথ খুলে দিয়েছিলেন, সেই দেশ অবশেষে বিপুল রক্তপাতের পর শান্তির দেখা পাবে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সবাই যখন আসন্ন দোহা আলোচনার সম্ভাব্য সাফল্য নিয়ে কথা বলছে, তখন কেউই প্রায় ৫০ বছর আগের ভিয়েতনামের কথা এবং সেখান থেকে কিভাবে আমেরিকা বেরিয়ে এসেছিল সে কথা বলছে না।

১৯৬৮ সালে ক্ষমতায় আসার সময় রিচার্ড নিক্সন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, ভিয়েতনাম থেকে তিনি বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর উদ্দেশ্য পালটে যায় এবং তিনি এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সেখানে যুদ্ধকে আরও দীর্ঘ করেছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে আমেরিকানদের ধারণা যা-ই হোক না কেন, এ ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই যে, নিক্সন আর কিসিঞ্জার উত্তর ভিয়েতনামীজদের সাথে একটা চুক্তি করেছিলেন, যেটা সাইগন সরকার ভালো মনে করেনি। এবং স্বাভাবিকভাবেই সায়গন সরকারের ধারণাটাই ছিল সঠিক।

একটা সময়ে এসে আফগানিস্তানের যুদ্ধের ইতি ঘটতেই হবে। হয়তো সময়টা এখনই। কিন্তু তালেবানরা ধর্মের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত এবং নব্বইয়ের দশকে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে যে সব বিশ্বাস তাদেরকে প্রভাবিত করেছিল, সেগুলো তাদের ত্যাগ করার সম্ভাবনা খুবই কম। তাদেরকে কি বিশ্বাস করা যায়? যেভাবে উত্তর ভিয়েতনামিদের বিশ্বাস করেছিল যুক্তরাষ্ট্র? তালেবানদের শক্তি হলো পশতু জনগোষ্ঠি, যাদের প্রাধান্য রয়েছে দক্ষিণ ও পূর্ব আফগানিস্তানে। কিন্তু আফগানিস্তানে অন্যান্য জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও রয়েছে যারা আরেক দফা পশতু/তালেবান প্রাধান্য ঠেকাতে নিজেদের জীবন দিতেও রাজি।

যুক্তরাষ্ট্র যদি আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য কাবুল সরকারকে ত্যাগ করে, এবং তালেবানরা যদি আবার ক্ষমতা গ্রহণ করে, তাহলে হাজার হাজার মার্কিন ও ন্যাটো সেনা, যাদের মধ্যে ১৫৮ জন কানাডিয় রয়েছেন, আর বহু বহু আফগান নাগরিকদের মৃত্যুগুলো হবে অর্থহীন।

ডেভিড জে বারকুসন কানাডিয়ান গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স ইন্সটিটিউটের ফেলো এবং ইউনিভার্সিটি অব কালগেরির সেন্টার ফর মিলিটারি, সিকিউরিটি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ডিরেক্টর এমেরিটাস।

No comments

Powered by Blogger.