আমেরিকার সামরিক কৌশল প্রতিহত করতে সক্ষম ইরান' -সাক্ষাৎকারে কমরেড খালেকুজ্জামান

ইরান ও আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনা টানটান অবস্থায়। আমেরিকা নতুন করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এদিকে ইরানের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশের দায়ে আমেরিকার শক্তিশালী ড্রোন ভূপাতিত করেছে ইরান। সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। সেই টানটান উত্তেজনা প্রসঙ্গে আমরা কথা বলেছি বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামানের সাথে।
রেডিও তেহরানকে দেয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইরানের ওপর আমেরিকার গোপন কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে তেহরান।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ
  • ইরানের আকাশসীমায় আমেরিকার ড্রোন পাঠানোর সমর কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে ইরান।
  • আমেরিকা নানা খোঁড়া অজুহাতে ইরানের ওপর হামলার পাঁয়তারা করছে।
  • আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকট কাটানো ও অস্ত্র ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি করছে।
  • আমেরিকার আরেকটি বড় উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ দখল করা।
  • ইরানের ওপর একদিকে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে আমেরিকা অন্যদিকে আলোচনার প্রস্তাবও দিচ্ছে। তাদের এই দ্বিচারিতার কারণে গোটা বিশ্বে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে আমেরিকা।
রেডিও তেহরান: জনাব কমরেড খালেকুজ্জামান, সম্প্রতি ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি আমেরিকার একটি অত্যাধুনিক গোয়েন্দা ড্রোন ভূপাতিত করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করে আসছিলেন, এ ড্রোন কেউ শণাক্ত ও ভূপাতিত করতে পারবে না। কিন্তু ইরান সে বক্তব্য ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। ঘটনাটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
কমরেড খালেকুজ্জামান: দেখুন, এটা আসলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের একটি উসকানিমূলক কাজ। তাছাড়া এসব কাজের মাধ্যমে তারা বুঝতে চায়  যাকে তারা এই মুহূর্তে আঘাত করতে চায় তারা কতখানি সক্ষমতা অর্জন করেছে।  আর আমেরিকার সেই পরীক্ষায় তেহরান একদিকে মার্কিনিদের নতুন সমর কৌশল চিহ্নিত করতে পেরেছে বা সে ব্যাপারে সচেতন হওয়ার ক্ষমতা ইরানের আছে। এ বিষয়টি ইরান প্রমাণ করেছে।
আমেরিকা নতুনভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তার করা এবং ইসরাইলকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনিদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে ফলে তারা নতুন করে কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। তারা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এসব করে তাদের জনসমর্থন হারিয়েছে। এসব দেশে তাদের আগের মতো সেই অবস্থাটা আর নেই। আমেরিকা তাদের সেই অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের এখন প্রধান শক্তি ইরানকে কাবু করতে চায়। তারই অংশ হিসেবে তারা ইরানের সীমায় ড্রোন পাঠিয়েছে।
তবে এ ঘটনায় ইরান তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমেরিকার সামরিক কৌশলকে ধরার ক্ষেত্রে ইরান দেখিয়েছে তারা কতটা সক্ষম। আর পৃথিবীর সামনে ইরান এ বিষয়টি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে যে আমেরিকা ইরানের ওপর তাদের সামরিক কৌশল নতুনভাবে প্রয়োগ করতে চাচ্ছে এবং ইরান তা প্রতিহত করতেও সক্ষম।
দুনিয়ার মানুষ এটি দেখছে যে, একদিকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলার সরকারকে উৎখাত করার জন্য মার্কিনিরা উসকানি দিচ্ছে এবং সামরিক অভিযানের কথা বলছে। আবার জেরুজালেমে ইসরাইলের রাজধানী স্থাপন করার বিষয়টি দিয়ে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। এরমধ্য দিয়ে নতুনভাবে একটা অভিযান চালানোর চেষ্টা করছে। আর সবশেষ ইরানের ওপর হামলা বা আক্রমণ করার একটা পাঁয়তারা করছে। বলা চলে হামলা করার একটা ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করছে।
এ প্রসঙ্গে আমি বলব, আমেরিকা নতুনভাবে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। অস্ত্র ব্যবসা হচ্ছে আমেরিকার প্রধান ব্যবসা। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে বিশ্বের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানী ক্ষেত্র দখল করা। আর অস্ত্র ব্যবসার জন্য যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি করা এবং যুদ্ধ করা ছাড়া তো অন্য কোনো উপায় নেই। আবার মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি খাতকে দখল করতে গিয়ে এ অঞ্চলের জনরোষ ও আর্থিক সংকটে পড়েছে সেখান থেকে তারা উত্তরণ ঘটাতে চায়। কিন্তু এটি তাদের আরও বড় সংকটের দিকে নিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। 
রেডিও তেহরান: জ্বি কমরেড খালেকুজ্জামান আপনি আমেরিকার উসকানির বিষয়টি তুলে আনলেন। তো  ইরানি আকাশসীমায় ড্রোন পাঠানোর ঘটনাকে অনেকেও কিন্তু উসকানিমূলক বলে আখ্যা দিয়েছেন, যেকথাটি আপনিও বললেন। তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে আমেরিকা ইরানকে যুদ্ধে জড়িয়ে দিতে চাই। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
কমরেড খালেকুজ্জামান:  আসলে ইরানের আকাশসীমায় ড্রোন পাঠানোর বিষয়টি শুধু উসকানিমূলক নয় একইসাথে পরীক্ষামূলক। ইরান এটাকে কিভাবে অ্যাড্রেস করবে এবং কিভাবে মোকাবেল করবে বা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে কি না? এর প্রতিক্রিয়া কিরকম হবে। ভবিষ্যতে যদি ইরানের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযানে যায় তাহলে বিশ্ব পরিস্থিতি কিরকম হবে, রাশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য বড় শক্তিগুলোর অবস্থান কি হবে এসব নিয়ে তারা পরীক্ষা নিরিক্ষা চালাচ্ছে। সুতরাং ইরানের আকাশসীমায় ড্রোন পাঠানোর ক্ষেত্রে আমেরিকার যে গোপন উদ্দেশ্য ছিল সেটিকে ইরান ব্যর্থ করে দিয়েছে। 
রেডিও তেহরান:  ইরান-আমেরিকা সংকট ও উত্তেজনায় অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন- ইরান কী আমেরিকার মোকাবেলায় টিকতে পারবে? এ প্রশ্নের জবাবে আপনি কী বলবেন?
কমরেড খালেকুজ্জামান: দেখুন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ভালে একটি প্রশ্ন করেছেন। তবে শুধুমাত্র শক্তি কত বড় আর কত কম এটা দিয়ে পারিমাপ করা যায় না। যদি এভাবে পরিমাপ করা যেত তাহলে ভিয়েতনামের পরিস্থিতি ভিন্ন হতো, কিউবার পরিস্থিতিও ভিন্ন হতো।
দেখুন, বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি, আমেরিকার আভ্যন্তরীণ অবস্থা, তাদের অর্থনৈতিক সংকট এবং মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক অর্থনৈতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবকিছু মিলে বিবেচনা করতে হবে। শুধুমাত্র আমেরিকার যে সামরিক শক্তি আছে সেই শক্তির বিবেচনায় তারা যেকোনো সময় ইরানের মোকাবেল করতে পারে। তবে সামরিক শক্তি দিয়েই সব প্রশ্নের সমাধান করা যায় না। এমনকি সামরিক সাফল্যও নিশ্চিত করা যায় না। ফলে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে শুধুমাত্র আমেরিকার শক্তি ও ইরানের শক্তি- এই সমীকরণ দিয়ে ফলাফল নির্ধারণ করা যাবে না।
রেডিও তেহরান: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একদিকে আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছেন আর অন্যদিকে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছেন। মার্কিন এই পলিসিকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
কমরেড খালেকুজ্জামান: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই পলিসি একদিকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অন্যদিকে সারাবিশ্বে প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তিনি সাধারণ মানুষের তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়েছেন। তাছাড়া বিশ্বে তিনি একটি হাস্যকর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। আমেরিকা বাস্তবে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাধ্যমে বিশ্ববাসী বুঝতে পারছে। এখন নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বা তার অভ্যন্তরীণ শক্তির ভিত্তিতে দেশটির সংকট মোকাবেলার কোনো উপায় যেহেতু তাদের নেই সেজন্য সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে কথিত ইসলামি ওয়ার্ল্ডকে বিভক্ত করা, অস্ত্র বিক্রির বাজার সম্প্রসারিত  করা, যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি করা এবং এসবের মাধ্যমে তাদের সংকট উত্তরণের একটা রাস্তা তৈরি করার উদ্দেশ্য তাদের রয়েছে। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একদিকে আপোশের  কথাও বলে আবার নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও আমরা দেখলাম একদিকে সামরিক ভীতি  ও চাপ প্রদর্শন করা অন্যদিকে আপোশ করার মতো ঘটনা ঘটেছে। আবার তাদের হিসাব নিকাষে দেখছে আগের মতো কোনো দেশে একটি সামরিক অভিযান চালিয়ে তাদের সংকটের উত্তরণ ঘটাতে পারবে সেই পরিস্থিতি বর্তমান বিশ্বে নেই। এটি আমেরিকার অভ্যন্তরেও নেই বিশ্বেও নেই।
রেডিও তেহরান:  ইরান ইস্যুতে আঞ্চলিক দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরবের অবস্থানকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
কমরেড খালেকুজ্জামান: দেখুন, সৌদি আরব অবস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে যে বিষয়টি বলব সেটি হচ্ছে-দেশটি জটিলতর আভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্যে রয়েছে। সৌদি আরব তার রাজতন্ত্রকে ধরে রাখতে এবং আভ্যন্তরীণ বিরোধ মীমাংশা করতে গিয়ে আমেরিকার ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর আমেরিকা সেই সুযোগটি গ্রহণ করেছে। এছাড়া সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের জায়গায় থাকতে চায়। আর তাদের এ কাজে আমেরিকা মদদ জোগাবে এ ধরনের একটা ধারনা দিয়ে বিভক্ত করতে চায়। তাছাড়া কাতারের সঙ্গেও একটা বিরোধ তৈরি হয়েছে। 
এসবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতিটা এমন- মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোকে পরস্পরকে বিভক্ত করো এবং একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দাওয়ার কাজটি আমেরিকা করছে। সৌদি আরব তার নিজের স্বার্থে আমেরিকার ওপর নির্ভর করছে। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি কোনো এক সময় কোনো একটি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করার প্রয়োজন হয় সেটিও তারা করতে পারবে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে আমেরিকার আভ্যন্তরীণ ও অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে। এটি রয়েছে সৌদি আরবের মধ্যেও। এসব সংকট মেটাতে দুটি দেশ পরস্পরের ওপর নির্ভর করছে। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে ধরনের আত্মসচেতনা তৈরি হচ্ছে সে বিষয়টি আমেরিকা ও সৌদি আরব উপলব্ধি করতে পারছে। সেটি তাদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমেরিকা এবং সৌদি আরবের কারণে তাদের মদদে মধ্যপ্রাচ্যে বিভক্তি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে। আর সেই আতঙ্কের মধ্যে ইসরাইলের আধিপত্য আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্য তাদের রয়েছে। আর আমেরিকার এই পরিকল্পনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে এবং আমেরিকার নিজের ভেতরেও তাদের জনসমর্থন কমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমেরিকার আভ্যন্তরীণ বিষয়েও এটি প্রশ্নের মুখে পড়ছে। আর সৌদি আরবকে নিয়ে মুসলিম বিশ্বে নতুনভাবে নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
মার্কিন ড্রোন গ্লোবাল হক


No comments

Powered by Blogger.