কূটনৈতিক দাবা by ইন্দ্রানি বাগচি

জৈইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম)-এর প্রধান মাসুদ আজহার ১৯৯৪ সালে একটি পর্তুগিজ পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তখন থেকেই শুরু হয় তার ২৫ বছর মেয়াদী সন্ত্রাসবাদের ক্যারিয়ার। এই ক্যারিয়ারে তার অবস্থান সবচেয়ে নিচে ছিল যখন, অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার তাকে আইসি-১৮ বন্দী বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করে।
এই ২৫ বছরে বহু সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছেন আজহার। অবশেষে চলতি সপ্তাহে তাকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। ঘোষণার পাশাপশি তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তার ওপর জারি হয়েছে ভ্রমণ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। আপাতদৃষ্টিতে এটা ভারতের জন্য একটি ভূতাত্ত্বিক ও কূটনৈতিক জয়। কিন্তু মাটিতে আজহার আগের মতোই সমান দর্পে পাকিস্তানে সক্রিয় রয়েছেন। ঠিক লস্করে তৈয়বার (এলইটি) হাফিজ সাইদের মতো।
তাকেও প্রায় এক দশক আগে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বালাকোট হামলার পর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, তিনি ইসলামাবাদের একটি প্রতিষ্ঠিত ‘সেফ হাউজে’ অবস্থান করছেন।
তথাপি আজহারকে সন্ত্রাসী ঘোষণা দেওয়াও একটি চিত্তচাঞ্চল্যকর ভূতাত্ত্বিক দাবা খেলায় পরিণত হয়েছিল। আর এই খেলা শেষ হয়েছিল ভারতের পশ্চিমা মিত্র যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্স-যুক্তরাজ্য মিলে চীনের বিরোধ ভেঙে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। অবশেষে পহেলা মে চীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১২৬৭ কমিটির ওপর থেকে তাদের বাধা, তা সরিয়ে নিলে সন্ত্রাসী ঘোষিত হয় আজহার।
এই ঘোষণার আগে ভারত অবশ্য ২০০৯ সালে একবার আজহারকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করাতে চেষ্টা চালিয়েছিল। তবে সে চেষ্টায় কোনো সফলতা আসেনি। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে পাঠানকোট, উরি ও নাগরোতায় হামলা চালিয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন আজহার। ভারত পুনরায় আজহারকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তখন থেকে চীন ওই ঘোষণার প্রস্তাবটিতে ‘টেকনিক্যাল হোল্ড’ জারি করে ও তিন মাস পর প্রস্তাবটিতে অবরোধ জারি করে। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স পুনরায় প্রস্তাবটি উত্থাপন করলেও কোন লাভ হয়নি। চীন তাতেও বাধা দেয়।
মূলত পাকিস্তানের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই আজহারকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাবে বাধা বজায় রেখেছিল চীন। এছাড়া, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যেও প্রবেশের চেষ্টা করেছিল দেশটি। একাধিকবার ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করতে আহ্বান জানায় তারা। দুই দেশের মধ্যে সাম্যতা আনার লক্ষ্যেই এই আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ততদিনে পাকিস্তানের সঙ্গে সকল আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে ছেদ করেছিল ভারত। ফলস্বরূপ প্রত্যাখ্যাত হয় চীনের আহ্বান।
ভারতের জন্য আজহারকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার বারংবার চেষ্টাগুলো ছিল চীনকে একজন সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসী-পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রকে রক্ষা না করতে বাধ্য করার সহজ পদ্ধতি। ভারত চাইলে সহজেই চীনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে কেড়ে নিতে পারতো।
তবে ২০১৮ সালে উহান সম্মেলনের পর ১০ মাস ধরে ভারত পৌরাণিক ‘উহান স্পিরিট’ ধরে রাখার চেষ্টা করে। এমনকী জাতিসংঘ থেকে আজহার সম্পর্কিত সকল প্রস্তাব, আবেদনও প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু চলতি বছরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা হামলার পর পুনরায় জাতিসংঘে সেগুলো তুলে ধরে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এর আগে অবশ্য কিছু ঘটনা ঘটার প্রয়োজন ছিল। যেমন, জাতিসংঘের কাছ থেকে হামলাটির বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ। বেশ কয়েকটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর ওই বিবৃতি প্রকাশ পেতে এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। যদিও সাধারণত এত সময় লাগে না।
তুলনা করার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যায় ইরানে- পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীর একই ধরণের একটি হামলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এর নিন্দা জানিয়েছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। কিন্তু ভারতে হামলার নিন্দার বিবৃতিটি বিশেষ কিছু ছিল। এই প্রথম জাতিসংঘ জম্মু ও কাশ্মীরে হওয়া কোনো সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানায়। চীন এখানেও কিছুটা চেষ্টা চালিয়েছিল, তবে সফল হতে পারেনি। তাদের প্রতিরোধ ভেঙে জাতিসংঘ ঘোষণা দেয় এই হামলা চালিয়েছে জেইএম। এতে পিষ্ট হয় চীনের কূটনৈতিক প্রভাব।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন তিন দেশের জোট পুনরায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আজহারকে সন্ত্রাসী ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু চীন পুনরায় তা ১৪ই মার্চ ঠেকিয়ে দেয়। শুরু হয় দাবা খেলা। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স ঘোষণা দেয় এ পদ্ধতিতে কাজ না হলে তারা ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করবে। ফ্রান্স তাদের নিজস্ব উদ্যোগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আজহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে প্রস্তাব উত্থাপন করে। এর আগে আজহারের ওপর জাতীয় পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র জানায় তারা নিষেধাজ্ঞা কমিটিকে অগ্রাহ্য করে পূর্ণ ইউএনএসসি’র কাছে এই প্রস্তাব উত্থাপন করবে। এতে করে চীনকে হয়তো প্রস্তাবটিতে ভেটো দিতে হতো অথবা প্রস্তাবের পক্ষে থাকতে হতো। ভেটো দিলে এমনটা প্রমাণ হতো যে, চীন সন্ত্রাসীদের পক্ষে। বিশ্বের কোনো বৃহৎ শক্তিই নিজেদের এমন ভাবমূর্তি উপস্থাপন করতে চাইবে না।
ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে চীন। বেইজিং, ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্কে কয়েক দফা আলোচনা হয় দুই পক্ষের মধ্যে। চীনকে ২৩ এপ্রিলের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে বলে যুক্তরাষ্ট্র।
চীন চাইছিল ভারত সীমান্তে সংঘাতের হার হ্রাস পাক। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত উন্মুক্ত আলোচনায় বসুক ও পাকিস্তানে হামলা না চালানোর প্রতিশ্রুতি করুক। তবে ভারত চীনের এমন চাওয়ায় সম্মতি দেয়নি।
পুলওয়ামা ও বালাকোট হামলায় দু’টি জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে- এক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হিসেবে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল ও দুই, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেকোনো সামরিক হামলা আত্ম-প্রতিরক্ষা হিসেবে বিবেচিত হবে। 
মধ্য-এপ্রিলের মধ্যে চীন রাজি হয় যে, তারা আজহারকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করার প্রস্তাবের ওপর থেকে বাধা সরিয়ে নেবে। ওয়াশিংটনে ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে সম্মতি নিশ্চিত করতে বলে যুক্তরাষ্ট্র। এই পরামর্শ বাস্তবায়নে কাজে লেগে যায় ভারতীয় কূটনীতিকরা। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্য আজহারকে সন্ত্রাসী ঘোষণার পক্ষে সমর্থন জানায়।
এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল সময়। চীন চাইছিল ১৫ই মে’র মধ্যে ঘোষণা দেওয়া হোক। যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল ২৩শে এপ্রিলের মধ্যে। এই সমস্যার সমাধান করেন ইউএনএসসি’তে নিযুক্ত ইন্দোনেশীয় রাষ্ট্রদূত দিয়ান ত্রিয়ান্সিয়াহ দিজানি। দুই পক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা শেষে তিনি পহেলা মে ঘোষণার তারিখ হিসেবে নির্ধারণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ইউএনএসসি’র ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইন্দোনেশিয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল ভারত।
কিন্তু এ সিদ্ধান্তে চীনের দাবিও কিছুটা মানতেই হয়েছে। কেননা, কূটনীতিকরা যেমনটা বলে থাকেন- সবাই যেন কোন না কোনভাবে লাভবান হয়। আর তাই জাতিসংঘের বিবৃতি থেকে পুলওয়ামা হামলা ইস্যু বাদ পড়ে। ভারতের জন্য মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করাটাই বড় লাভ ছিল। পাশাপাশি চীনের বিরুদ্ধে এটা একটি কূটনৈতিক জয়ও ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা ছিল সকল দিকে জেতার মতো বিষয়। একদিকে  দেশটি ভারতের সমর্থন লাভ করেছে, অপরদিকে চীনকেও পরাজিত দেখেছে। আর রাশিয়ার কাছ থেকে ধীরে ধীরে ইউএনএসসি’তে ভারতের বন্ধুত্ব কেড়ে নিচ্ছে ফ্রান্স।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, মাসুদ আজহার ইস্যুতে ভারত বড় জয়লাভ করেছে। আর এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হচ্ছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
(ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সম্পাদিত ভাবানুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.