কাশ্মিরে নাবালক আর বৃদ্ধদের আটকে রাখা হয়েছে কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তি দিয়ে by উমর মনজুর শাহ

জম্মু ও কাশ্মিরে কঠোর পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট (পিএসএ)-এর আওতায় আটক শত শত লোকের মধ্যে রয়েছেন ৭৫ বয়স্ক মোহাম্মদ সোবহান ওয়ানি ও ১৪ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ ইব্রাহিম দার।
কাশ্মিরবিষয়ক গ্রন্থ লেখক ও ইতিহাসবিদ আশিক হোসাইন ভাট সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, পিএসএ প্রবর্তন করেছিলেন ওই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের (এনসি) প্রতিষ্ঠাতা শেখ আবদুল্লাহ, ১৯৭৮ সালের ২ এপ্রিলে।
ভাট বলেন, ‘পাক-মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ’ প্রতিরোধের নামে বিরোধীদের দমনের জন্য অ্যাক্টটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
এই অ্যাক্টের বলে সরকার কোনো কারণ না দেখিয়েই যেকোনো ব্যক্তিকে দুই বছর পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। আটকের মেয়াদ আবার দুই বছরের বেশিও বাড়ানো সম্ভব।
১৯৯০ সালে কাশ্মিরকে মুক্তির জন্য জঙ্গিরা আন্দোলন শুরুর পর থেকে সরকার পিএসএ’র ব্যাপক ব্যবহার করছে।
কেবল ২০১৮ সালেই এই আইনের আওতায় ৫ শতাধিক লোককে আটক করা হয়। ২০১৭ সালে সংখ্যাটি ছিল ৪১০, আর আধুনিক ইতিহাসে কাশ্মিরের সবচেয়ে প্রাণঘাতী বেসামরিক উত্তেজনার বছর ২০১৬ সালে কারাগারে পাঠানো হয় ২৩০ জনকে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে জঙ্গি নেতা বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর ২০১৬ সালের জুলাই মাসে কাশ্মিরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনার পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৩০ বিক্ষোভকারী নিহত হয়। এরপরের ছয় মাসের আন্দোলনে যায় ৯০টি প্রাণ, আহত হয় ১১ হাজার।
একই সময় সরকারি বাহিনী আপেল বাগান আর ধান ক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত উত্তর কাশ্মিরের সপোরে যায় ৭৫ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ সোবহান ওয়ানির জন্য।
সাবেক সরকারি কর্মী ওয়ানি স্বাধীনতাকামী একটি সংগঠনের সাথে জড়িত। তার সংগঠন কাশ্মিরের পাকিস্তানের সাথে একীভূত চায়।
বৃদ্ধ বয়সের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ওয়ানিকে কয়েক দিন স্থানীয় থানায় আটকে রাখার পর জম্মুর কুথুয়া জেলায় নিক্ষেপ করা হয়। উল্লেখ্য, গ্রীষ্মকালে এখানকার তাপমাত্র ৫০ ডিগ্রি হয়ে যায়।
পরের বছরের মে মাসে ওই বৃদ্ধ লোকটি কারাগারে এক তরুণ সঙ্গী পান। তার নাম মোহাম্মদ ইব্রাহিম দার। ওই অ্যাক্টের বলে আটক বালকটির বয়স তখন ছিল ১৪ বছর। তার বিরুদ্ধে পাথর নিক্ষেপের অভিযোগ আনা হয়েছিল। শিশু হিসেবে তার মুক্তির জন্য তার মা-বাবার বারংবারের অনুরোধ সত্ত্বেও পুলিশ তাকে আটকে রেখেছে, তারা তার বয়স ২২ বলে রেকর্ড করেছে। তার প্রকৃত বয়স হিসেবে স্কুল থেকে যে সার্টিফিকেট দিয়েছিল, পুলিশ তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
আটকের পর থেকে ওয়ানির ওপর পিএসএ আরোপ করা হয়েছে চারবার। তার ছেলে ফারুক আহমদ ওয়ানির মতে, আদালত তার বাবাকে তিনবার মুক্তির নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই তার বিরুদ্ধে আরেকটি পিএসএ মামলা দায়ের করে আটকাদেশ অব্যাহত রাখা হয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১১ সালে পিএসএকে ‘আইনহীন আইন’ হিসেবে অভিহিত করে। কার্যত এটি জম্মু ও কাশ্মিরের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার পরিপূরক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
চলতি বছর আরেকটি বিস্তারিত প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি জানায় যে জম্মু ও কাশ্মিরের কর্তৃপক্ষ পিএসএকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহার করছে। দায়মুক্তি দিয়ে শিশুদের আটক রাখা হচ্ছে। যথাযথ অবস্থা ও সুরক্ষা ছাড়াই পিএসএ নির্দেশ প্রদান করা হয়। এই আইনের ফলে বন্দীরা জামিনে মুক্তিলাভ করতে পারে না। ফলে এই আইন ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে ক্ষুণ্ন করছে।
অ্যামনেস্টি জানায়, বন্দীদের প্রায়ই তাদের আটক-সংক্রান্ত সামগ্রী দেয়া হয় না, উপদেষ্টা বোর্ডের মধ্যে লুকোচুরি থাকে। অন্যায় আটকাদেশ ও নির্যাতন এবং খারাপ আচরণও অব্যাহত থাকে।
বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজ্যের হাই কোর্ট নিয়মিতভাবে আটকাদেশ বাতিল করে। কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যে দায়মুক্তি সুবিধা ভোগ করে, তাতে আদালতের করার আছে সামান্যই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই ব্যাপক ভীতি সৃষ্টি করেছে। জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন প্রয়োজন আস্থা পুনঃগঠনে।
শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট পারভেজ ইমরোজ বলেন, আঞ্চলিক আদালতগুলো নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। পুলিশও বিচারিক নির্দেশকে গুরুত্ব দিয়ে নেয় না।
আইনজীবী ইমরোজের উদ্ধৃতি দিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, আমার একটি মামলার কথাও জানা নেই, যেখানে আটককারী কর্তৃপক্ষকে অবৈধ নির্দেশের জন্য প্রশ্ন করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নাবালক, অক্ষম বা সহিংসতার সাথে বলতে গেলে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়, এমন ব্যক্তিদেরও আটক করা স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে অনেক মামলা গেলেও আটকের জন্য জরিমানার একটি ঘটনাও ঘটেনি।
ইমরোজ আরো বলেন, জবাবদিহিতা না থাকায় আটককারী কর্তৃপক্ষ প্রক্রিয়াগত রক্ষাকবচগুলো লঙ্ঘন করে থাকে। এখানে কেবল সশস্ত্র বাহিনীই দায়মুক্তি পায় না, বরং আমলারাও পেয়ে থাকে। আদালতগুলো পুরোপুরি চোখ বন্ধ করে রাখে।
ভারত বলে আসছে যে কাশ্মির হলো তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ১৯৭১ সালের পর ভারত এমনকি জাতিসংঘ সামরিক পর্যবেক্ষকদেরও কাশ্মিরে প্রবেশ করার সুযোগ দিচ্ছে না।
কাশ্মির নিয়ে সঙ্ঘাতের সূচনা ১৯৪৭ সালে। এই সময় ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। উভয় দেশই কাশ্মিরকে পূর্ণভাবে দাবি করে আসছে, তারা এ নিয়ে তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ ও অনেক ছোটখাট সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
তিন দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলা ও সামরিক দমনের ফলে জঙ্গি, নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক মিলিয়ে এক লাখ লোকের জীবন গেছে।

No comments

Powered by Blogger.