বাহা’ই সম্প্রদায়: বাংলাদেশে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ by শফিক রহমান

বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে হেফাজতে ইসলামসহ দেশের আলেম সমাজ যখন আবারো মাঠে নেমেছেন তখন নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাহা’ই ধর্মালম্বীদের যে কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের আগে জানাতে বলেছে দেশটির জাতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সম্প্রতি বাহা’ইদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাহা’ইরা নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে নেই। তারপরও যে কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের আগে জানালে নিরাপত্তা দেয়া হবে।
বাহা’ইদেরও বিশ্বাস- নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে নেই তারা। তা তাদের ধর্মের বাণী প্রচার, অনুষ্ঠান আয়োজন কিংবা অবাধে চলাচল কোনটাতেই নয়। তারপরও সরকারের এ ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসে অনেকটাই নিশ্চিন্ত বাংলাদেশের ক্ষুদ্র সম্প্রদায়।
এদিকে গত ১৬ এপ্রিল বিকেলে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের স্টেডিয়াম মাঠে খতমে নবুওয়াত সংরক্ষণ পরিষদ আয়োজিত সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমেদ শফী কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিসহ ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন।
পঞ্চগড় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাটের সভাপতিত্বে সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শাহ আহমেদ শফী বলেন, ‘তারা মুসলমান নয়, তারা অমুসলিম। তাদের যারা অমুসলিম মনে করে না তারাও অমুসলিম। আহমদিয়ারা আমাদের শেষ নবীকে মানে না, সুতরাং তারা কাফির। যারা তাদের কাফির মানে না তারাও কাফির। আহমদিয়া ছেলেদের সঙ্গে মুসলমানদের কোনও মেয়েকে বিয়ে দেবেন না, আহমদিয়া মেয়েদেরও কোনও মুসলমান ছেলে বিয়ে করবেন না। আল্লামা শফীর পক্ষে লিখিত ওই বক্তব্য পাঠ করেন তার ছেলে আনাস মাদানী।
গোলাম আহমদ কাদিয়ানির অনুসারিরা স্থানীয়ভাবে ‘আহমদিয়া’ বা ‘কাদিয়ানি’ নামে পরিচত। মুসলমান প্রধান বাংলাদেশে এই কাদিয়ানিদের মতো বাহা’ইরাও আরেক সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাসী। এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে- ‘তারা নিভৃতচারীও’। তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি। নামাজ আছে (বিশেষ পদ্ধতিতে), রোজা আছে, রোজার শেষে ঈদের মতো অনুষ্ঠানও আছে। কিন্তু সব আচার অনুষ্ঠান পালন ও আয়োজন সবই হয় নিভৃতে।
বাংলাদেশ অংশের প্রথম যারা এই বাহা’ই ধর্মের বাণী ধারন করেন তারাও ছিলেন মুসলমান। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন স্থানীয় হিন্দু, উপজাতিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির মানুষ। বর্তমানে বাংলাদেশে বাহা’ইদের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৮৪৪ সালে ইরানের বা’ব এবং বাহা’উল্লাহ নিজেদেরকে ঈশ্বরীয় অবতার ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা ইরান সরকার, ধর্মীয় নেতৃবর্গ ও জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। ১৮৫০ সালে তাদের হাতে নিহত হন বা’ব। ১৮৬৩ সালে বাহা’উল্লাহ ইরাকের বাগদাদের রিজওয়ান উদ্যানে ঘোষণা করেন- তিনিই সকল যুগের ‘প্রতিশ্রুত মহাপুরুষ’, যার জন্য শত শত বছর ধরে মানুষ অপেক্ষা করছে।
পরে বাহা’উল্লাহ তার বাণী প্রচারের জন্য সুলেমান খান-তুনুকাবানিকে (জামাল এফেন্দী) ভারতে পাঠান। ১৮৭৬ সালে জামাল এফেন্দী বোম্বে পৌঁছান এবং ভারতীয় উপমহাদেশে তার মাধ্যমে বাহা’ই হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৈয়দ মুস্তফা রুমি। যার জন্ম কারবালায়। কিন্তু তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে ভারতে আসেন এবং মাদ্রাজে কাশ্মীরী উল ও শাল ব্যবসার সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেন। পরে তিন বার্মায় নিযুক্ত হন বাহা’ই ধর্ম প্রচারে। ওখানেই তার হাত ধরে বাহা’ই ধর্মের বাণী ধারন করেন বাংলাদেশ অংশের বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে শুরুর দিকে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে যারা দীক্ষা নেন তারা হলেন, মোহাম্মদ ইসহাক, শেখ আলিমুদ্দিন মিস্ত্রি, মৌলভী সুলতান গাজী, আমিরুল ইসলাম, আব্দুর রহিম, কামাল মিঞা সওদাগর, আব্দুল আলিম, সফদার আহমেদ, সাফিউল ইসলাম খান এবং শাহ আলম চৌধুরী। এদের মধ্যে শুধু মোহাম্মদ ইসহাকের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। বাকিরা চট্টগ্রামের বাসিন্দা। কিন্তু ব্যবসার কাজে ব্যস্ত ছিলেন বার্মায়।
বর্তমানে ঢাকায় রয়েছে বাহা’ইর জাতীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ। এছাড়া বরিশাল, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে রয়েছে ছয়টি আঞ্চলিক আধ্যাত্মিক পরিষদ। এর মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে অধিক সংখ্যক বাহা’ইদের বসবাস।
সম্প্রতি কথা হচ্ছিল বাহা’ইর জাতীয় আধ্যাত্মিক পরিষদের সদস্য টিউলিপ চৌধুরীর সঙ্গে। যিনি রংপুরের বাসিন্দা এবং ১৯৯২ সালে হিন্দু ধর্ম থেকে বাহা’ই ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করেন। বর্তমানে তার গ্রাম এবং আশপাশের গ্রামগুলোতেও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছেন বাহা’ইর অনুসারিরা। টিউলিপ চৌধুরী জানান, পাঁচ ভাই এবং পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি এবং তার ছোট ভাই বাহা’ইর দিক্ষা নিয়েছেন, বাকিরা সবাই হিন্দু ধর্মই পালন করছেন। কিন্তু পরিবার কিংবা সমাজ বা গ্রাম কোন দিক থেকেই তারা বাধার সম্মুখীন হননি। এমনকি নিজের দুই সন্তানের কে কোন ধর্মের বিশ্বাসী হবেন সে বিষয়েও তার কোন কড়াকড়ি নেই। তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি ধর্ম প্রগতশীল। যুগে যুগে আসবে। আমরা আমাদের যুগে বাহা’ই ধর্মের বাণী প্রার্থনায় বিশ্বাস এনেছি।”
টিউলিপ চৌধুরী আরও জানান, তিনি যখন বাহা’ই ধর্মে বিশ্বাস আনেন তখন তিনি মাধ্যমিক স্তর শেষ করে মাত্র কলেজে যাচ্ছেন। ওই সময়ই একদিন তাদের বাড়িতে উপস্থিত হন রাজশাহীর একজন এবং বিদেশি কয়েকজন ট্রাভেল টিচার (ভ্রাম্যমান ধর্ম প্রচারক)। তাদের কথায় মুগ্ধ হয়ে তিনিসহ আশপাশের কয়েকজন বিশ্বাস আনেন।
কিন্তু বর্তমানে বাহা’ইর বাণী প্রচার শ্লথগতিতে চলছে। আশি বা নব্বইয়ের দশকের মতো আসছেন না ট্রাভেল টিচাররা। কার্যক্রমও অনেকটা সীমিত ঘরোয়া কেন্দ্রীক শিশুক্লাস, কিশোর ক্লাস ও প্রাপ্তবয়স্কদের অধ্যায়ন চক্রের মধ্যে। যদিও একসময়ে বাংলাদেশে এসেছেন ইরাক, ইরান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, মৌরিশাস, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, ইটালি ও ভারত থেকে। সবচেয়ে বেশি এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান থেকে।
এদের মধ্যে ইয়েমেনের বাহমান মোগাদ্দাস ইরানী ট্রাভেল টিচার হিসেবে ১৯৬৯ সালে ঢাকায় আসেন। ওই সময় ঢাকায় কোন বাহা’ই কেন্দ্র ছিল না। কয়েকজন ইরানী তরুণ বাহা’ইয়ের বাসভবনই বাহা’ই কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হতো এবং ঢাকাস্থ বাহা’ইদের বসবাস ছিল মূলত মিরপুর ও শান্তি নগরে। ১৯৭১ সালে বাহমান মোগাদ্দাস করাচি গিয়ে সিমিন নামের একজনকে বিয়ে করে ফিরে আসেন এবং ওই সময়ই শান্তিনগরের সার্কিট হাউজ রোডের বর্তমানের জাতীয় বাহাই কেন্দ্রটি কেনা হয়। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় জাতীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েলের আক্কায় বাহা’উল্লাহর কবরকে ভিত্তি ধরে বাহা’ইদের কেবলা ঠিক করা হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশের বাহা’ইদের কেবলা উত্তর-পশ্চিম কোন বরাবর। তিন পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছে প্রার্থনা। যে কোন বাহা’ই যে কোন একটি পদ্ধতি অনুসরন করতে পারেন। আর মাস গুনছেন ১৯ দিনে। তাতে ৩৬১ দিনে ও ১৯ মাসে বছর। বাড়তি চার দিনকে ইন্টার ক্যালারি ডে হিসেবে পালন করা হয়। বাহা’ই ক্যালেন্ডারের বছর শুরু ২১ মার্চ। প্রতি বছর ২ মার্চ থেকে ২০ মার্চ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস পালন করে। ২১ মার্চ ঈদ ও নববর্ষ। যাকে বলা হচ্ছে ‘নওরোজ’। ওই দিন ৩টা থেকে ৩.১৫টার মধ্যে ঈদের ও নওরোজের প্রার্থনা করা হয়।
মাশরিকুল আযকার বা বাহা’ই উপাসনালয়
বর্তমানে উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, বার্মাসহ প্রায় সব দেশেই বাহা’ই অনুসারিরা রয়েছেন। তবে মাত্র ভারতে রয়েছে তাদের উপাসনালয়। যাকে তারা বলছেন ‘মাশরিকুল আযকার’। ১৯৮৬ সালে দেশটির নয়া দিল্লির কাছে বাহাপুরে উপাসনালয়টি নির্মিত হয়। যদিও ১৯৮৩/৮৪ সালের দিকে ঢাকার অদূরে সাভারের কলমা এলাকায় ৮১ শতাংশ জমি কেনা হয়। পরিকল্পনা ছিল ওর আশপাশের সব মিলিয়ে ২০ একর জমি কিনে সেখানে নির্মাণ করা হবে মাশরিকুল আযকার। কিন্তু জমির স্বল্পতার কারণে সেই সিদ্ধান্ত এখনও ঝুলে আছে। জানা গেছে, ২০১৭ সালে ক্যাম্বোডিয়ায় এবং সর্ব শেষ ২০১৮ সালে কলাম্বিয়াতে নির্মিত হয়েছে বাহা’ইদের উপাসনালয় মাশরিকুল আযকার।
গুলিস্তান’ই যাভেদ বা কবরস্থান
পঞ্চগড়ে অনুষ্ঠিত সেদিনের খতমে নবুওয়াত সংরক্ষণ পরিষদের সম্মেলনে শাহ আহমেদ শফী আহমদিয়াদের কোনও প্রকার সাহায্য না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আহমদিয়াদের মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না।’ তবে এ সমস্যা বাহা’ইদের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে, বিশেষ করে ঢাকায় যারা বসবাস করছেন। জানা গেছে, তারা আজিমপুর কবরস্থান ব্যবহার করছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের পরিচয় গোপন রাখতে হয়। এছাড়া সাভারের কমলাতে উপাসনালয়ের জন্য নির্ধারিত জমির পাশেই ৩১ শতাংশ জমি কেনা আছে কবরস্থানর জন্য। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে মোহাম্মদপুরে নবনির্মিত কবরস্থানের পাশে এক খণ্ড জমি চাওয়া হয়েছে বলে জানান টিউলিপ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।
এ ধরনের ছোট খাটো নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির মধ্যেও বাংলাদেশের বাহা’ইরা নিরাপদ ও নিশ্চিন্তেই তাদের আচার অনুষ্ঠানগুলো পালন করে যাচ্ছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো।

No comments

Powered by Blogger.