হত্যার ছক ঠিক হয় কারাগারে by রুদ্র মিজান

তিন মিনিটেই  মিশন শেষ করে দুর্বৃত্তরা। মুহূর্তের মধ্যেই আগুনে দগ্ধ হয়ে যায় নুসরাত জাহান রাফি।  মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও নুসরাত ঘাতকদের চোখে চোখ রেখে বলেছেন, মারা গেলেও মামলা তুলে নেব না। আমি অধ্যক্ষ সিরাজের শাস্তি চাই। আর একটুও দেরি করেনি ঘাতকরা। দ্রুত ওড়না দিয়ে তার হাত-মুখ বেঁধে ফেলে। কেরোসিন ঢেলে দেয় শরীরজুড়ে। তারপর আগুন ধরিয়ে ছাদ থেকে সরে যায় তারা। এর মধ্যেই চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামেন নুসরাত।
দাউ দাউ করে শরীরজুড়ে তখন আগুন জ্বলছে। মাদরাসা শিক্ষার্থী ও এক পুলিশ সদস্যের সহযোগিতায় গায়ের আগুন নেভানো হয়। ততক্ষণে ঝলসে গেছে নুসরাতের গোটা শরীর। এই ফাঁকে নির্বিঘ্নে মাদরাসা থেকে পালিয়ে যায় ঘাতকরা। তাদের ধারণা ছিলো ঘটনাস্থলেই আগুনে পুড়ে মারা যাবে নুসরাত। বিষয়টি কেউ টের পাবে না।
সরাসরি কিলিং মিশনে বোরকা পড়ে নেতৃত্ব দেয় শাহাদাত হোসেন শামীম। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকান্ডে এ পর্যন্ত ১৩ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ। এজাহার নামীয় সাত জনকে গ্রেপ্তার করার পর গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই’র প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়ার সময় বোরকা পরা চারজন ছিলো। তাদের চার জনই ছিল মাদরাসার শিক্ষার্থী। এদের একজন ছাত্রী ছিল। নুসরাত জাহান রাফির শরীরে আগুন দেয়ার একদিন আগে ৫ই এপ্রিল বৈঠক করে নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, হাফেজ আব্দুল কাদের, জাবেদ হোসেনসহ পাঁচ জন। ওই দিন সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসার কাছের হোস্টেলের পশ্চিম অংশে এই বৈঠক হয়। সেখানেই নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। বৈঠকে নুর উদ্দিন জানায়, নুসরাতকে শায়েস্তা করার নির্দেশ দিয়েছে মাদরাসা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। সিরাজের নির্দেশেই হত্যা পরিকল্পনা করে তারা। এসময় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার প্রস্তাব দেয় বৈঠকে উপস্থিত শাহাদাত হোসেন শামীম।
পরে তারা আরও পাঁচজনকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানায়। যাদের মধ্যে দু’জন ছিলো ওই মাদরাসার ছাত্রী। তাদের একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয় তিনটি বোরকা ও কেরোসিন সংগ্রহের। পরিকল্পনা অনুযায়ী, পরদিন ৬ই এপ্রিল শাহাদাত হোসেন শামীমের কাছে মাদরাসার সাইক্লোন সেন্টারে তিনটি বোরকা ও পলিথিনে করে কেরোসিন সরবরাহ করে মেয়েটি। ওই দিন সকাল ৯টার আগেই বোরকা পরে শামীমসহ তিন ছাত্র মাদরাসার টয়লেটে লুকিয়ে ছিলো। পরীক্ষা শুরুর কিছু সময় আগে শম্পা বা চম্পা নামের মেয়েটি নুসরাত জাহান রাফিকে ডেকে নেয়। সে রাফিকে জানায়, ছাদে তার বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে। খবর শুনেই রাফি দৌঁড়ে ছাদে যায়। সেখানে যাওয়ার পরই শামীমসহ বোরকাপরা চার শিক্ষার্থী রাফিকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ প্রত্যাহার করতে চাপ দেয়। এতে নুসরাত রাজি না হওয়ায় তার হাত বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।
ঘটনার পর নুসরাত নিজে ছাদ থেকে নামল কীভাবে জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান বলেন, সাইক্লোন সেন্টারের ছাদ ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ওপর থেকে কেউ চিৎকার করলেও নিচে কেউ শুনতে পারবে না। আবার ছাদের দেয়ালের উচ্চতার কারণে কেউ টপকিয়ে নিচে নামতে পারবে না। ছাদ থেকে নামতে চাইলে তাকে একমাত্র সিঁড়ি দিয়েই নামতে হবে। তারা আগুন ধরিয়ে দিয়ে ছাদ থেকে নেমে মাদ্রাসায় অবস্থান করে। গায়ে আগুন লাগানো অবস্থায় নুসরাত সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলে অনেক মানুষ জড়ো হয়। এরপরই ওই চার জন সবার সঙ্গে মিশে যায়।
পরিকল্পনা অনুসারে ওই সময়ে নূর উদ্দিনের নেতৃত্বে হাফেজ আব্দুল কাদেরসহ পাঁচজন ছিলো বাইরে। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, গেট পাহারা ও স্বাভাবিক রাখার কাজ করে। মিশন শেষে অংশগ্রহণকারীরা নিরাপদে যাতে বের হয়ে যেতে পারে এজন্য তৎপর ছিলো তারা।
ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, নুসরাতের চোখে এর আগেও চুন মারা হয়েছিলো। এতে পাহাড়তলির একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল নুসরাত। যে কারণে হত্যাকারীরা মনে করেছিল নুসরাতকে মারাটা কঠিন কোনো বিষয় নয়। ঘটনার পরই পিবিআই ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআইয়ের ছয়টি ইউনিট অংশ নেয়। ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। এরমধ্যে এই মামলার এজহারভুক্ত আট আসামির মধ্যে পরিকল্পনাকারী শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, জোবায়ের আহমেদ, জাবেদ হোসেন ও আফছার উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
একই ঘটনায় আগে শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেপ্তার সিরাজ-উদদৌলাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এজহারভুক্ত অপর আসামি হাফেজ আব্দুল কাদের পলাতক রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে নুর উদ্দিন হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকার করে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে বলে জানান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, নুসরাতকে যৌন হয়রানির অভিযোগে সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তারপর অধ্যক্ষ সিরাজের লোকজন তার মুক্তির জন্য বিভিন্ন জায়গায় স্মারকলিপি দেয়। ৪ঠা এপ্রিল কারাগারে সিরাজের সঙ্গে সাক্ষাত করে নুর উদ্দিন ও শাহাদাতসহ চার জন। সেখানেই কিছু একটা করার নির্দেশনা দেয় সিরাজ। বনজ কুমার মজুমদার জানান, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার তদন্তে জড়িতের সংখ্যা বাড়তে পারে।
ইতিমধ্যে পাঁচজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আরও একজনকে রিমান্ডের জন্য আবেদন করা হবে। একজনের রিমান্ড শেষ হয়েছে। এ ঘটনায় আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মিশনে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন শামীমকে শুক্রবার রাতে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে শাহাদাত হোসেন শামীমকে এখনো আনুষ্ঠানিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। শামীমকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসেন পিবিআই কর্মকর্র্তারা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই সে ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয় স্বীকার করেছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে পিবিআই।
সম্পৃক্ত ১৩ জনের মধ্যে জড়িত অন্য ৬ জনকে গ্রেপ্তারের জন্য শামীমকে নিয়ে পিবিআই টিম অভিযান চালাচ্ছে।  তদন্ত সংশ্লিষ্টরাা জানান, ওই ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে সারাদেশে পিবিআইয়ের জেলা অফিসগুলোতে ছবি পাঠানো হয়েছে। তাদের বিস্তারিত পরিচয় অতীত রেকর্ড সংগ্রহ করে সেগুলো তদন্ত চলছে। ৬ জন গ্রেপ্তার হলে এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে কার কি ভূমিকা ছিলো আরও কেউ জড়িত আছে কি-না তা বেরিয়ে  আসবে। বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এ ঘটনায় জড়িতরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন আইনের আওতায় নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন পিবিআই’র বিশেষ সুপার (ঢাকা মেট্টো) আবুল কালাম আজাদ, এসপি বশির আহমেদ, মিনা মাহমুদা, পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা ও জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল আহছান প্রমুখ।
এজাহারের বাইরে গ্রেপ্তারকৃত ৭ জনও জড়িত: এদিকে নুসরাত হত্যায় যে মামলা হয়েছিলো সেই মামলায় মাদরাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, ছাত্র নুর উদ্দিন, সাহাদাত হোসেন শামিম, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, জোবায়ের আহমেদ, জাবেদ হোসেন, হাফেজ আব্দুল কাদের এবং আফসার উদ্দিনের নাম এজাহারে থাকলেও পুলিশ ঘটনার পর আরো ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে মো. আলাউদ্দিন,  কেফায়েত উল্লাহ জনি, সাইদুল ইসলাম, আরিফুল ইসলাম, উম্মে সুলতানা, নূর হোসেন ওরফে হোনা মিয়া রয়েছে। এই ৬ জনেরও বিভিন্নভাবে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। পিবিআইয়ের ডিআইজি জানান, হত্যা মামলার সঙ্গে শ্লীলতাহানীর মামলার যোগসূত্র থাকায় শ্লীলতাহানীর মামলাটিও তদন্ত করবে পিবিআই। মূলত ম্লীলতাহানীর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নুসরাতকে হত্যা করা হয়।
গত ৬ই এপ্রিল আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে গিয়ে অগ্নি সন্ত্রাসের শিকার হন নুসরাত জাহান রাফি। এর আগেই এই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার হাতে শ্লীলতাহানির শিকার হয়ে মামলা করেছিলেন নুসরাত। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের অনুগতরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরীক্ষার আগে ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। গুরুতর দগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে সোনাগাজী হাসপাতাল ও পরে ফেনী সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় পরে তাকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। গত বুধবার রাত সাড়ে নয়টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। নুসরাতের সব ধরনের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
সম্ভব হলে তাকে বিদেশ নিয়ে যাওয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার নুসরাতকে সোনাগাজীর চরচান্দিয়া গ্রামে দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়। এর আগে সোনাগাজী সাবের মোহাম্মদ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বৃহৎ জানাজায় হাজার হাজার মানুষ নুসরাত হত্যার বিচারের দাবি জানান। এদিকে নুসরাত হত্যাকাণ্ডে দেশব্যাপি প্রতিবাদের ঝড় বইছে। হত্যাকারীদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করছে বিভিন্ন সংগঠন।

No comments

Powered by Blogger.