বউডা পোয়াতি, এহন চলুম কেমনে?

আগুন নিভে গেছে তখন। কিন্তু একটি খোলা ভ্যানের ওপর নীরব বসে আছেন আসমা খাতুন। পুড়ে গেছে তার স্বপ্ন। পুড়ে গেছে তার আয়ের উৎস। গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে ছিল তাদের মাছের দোকান। এই দোকানই আয়ের একমাত্র উৎস। স্বামীর সঙ্গে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন ব্যবসা। আগে করতেন মাছ কাটার কাজ।
বিয়ে হয়েছে ৬ বছর আগে। প্রথম সন্তানের বয়স ৪ বছর। আর আসমা খাতুন ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ছোট একটি জায়গা ভাড়া নিয়ে  চালাতেন মাছের দোকান। কষ্টের জীবন পাড়ি দিয়ে দেখতে শুরু করেছিলেন আলোর মুখ। পরিবারে এসেছিলো সচ্ছলতা। এই আলোকে পিছু ফেলে এখন শুধুই অন্ধকার। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদের সংসারের উপার্জন। পুড়ে গেছে সকল মাছ। তার স্বামী সজীব মিয়া। কথা বলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি জানান, ৬০ হাজার টাকার মাছ নিয়ে এসেছেন শুক্রবার। এই টাকার মধ্যে ৪০ হাজার টাকাই ধার করে নেয়া। একটা মাছও বিক্রি হয়নি। তিনি বলেন, বউডা পোয়াতি। এহন চলুম কেমনে?
১৬ লাখ টাকার মাছ এনেছেন রাতে, সকালে ছাই
চট্টগ্রাম থেকে নিয়মিত মাছ আনেন ব্যবসায়ী মো. আবদুুর রাজ্জাক। মাছের মধ্যে রয়েছে কোরাল, শাপলা পাতা, আইড়, চিংড়িসহ নানা ধরনের মাছ। শুক্রবার রাত ২ টার দিকে এই মাছগুলো আনা হয় মার্কেটে। দোকানে থাকা ৮টি ফ্রিজ ভর্তি। এর কয়েক ঘণ্টার মাধ্যেই লাগে আগুন। জ্বলে যায় সব। আবদুুর রাজ্জাক যখন মাছগুলো বের করছিলেন। তার দিকে তাক করে ছিলো বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমকর্মীর ক্যামেরা। তখন তিনি অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, এই নেন ১৬ লাখ টাকার ছাই। এই নেন।
সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে জিসান রহমান। তিনি বলেন, আমরা মূলত চট্টগ্রাম থেকে সামুদ্রিক মাছ কিনে আনি। এরপর খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করি। রাতেই মাছগুলো আনা হয়েছে। আমাদের মোট ৮টা ফ্রিজ। ২টা ফ্রিজ ভর্তি ছিলো। নতুন মাছ আসার জন্য অল্প দামে বিক্রি করে দেয়া হয় আগের মাছগুলো। সব ফ্রিজ ভর্তি ছিলো। সকালে ২০ কেজি মাছের অর্ডারও ছিলো।
তিনি বলেন, রাতে বাবা ৩ টার দিকে বাড়িতে আসে। ঘুমায় ৪টার দিকে। সকালে আগুনের ঘটনা শুনে বাবার সঙ্গে ছুটে আসি। আমরা জানতাম না কি আছে আমাদের ভাগ্যে। এখন দেখি প্রায় সব মাছ পুড়ে গেছে। শুধু একটি ফ্রিজের মাছ ভালো আছে। ওই ফ্রিজটা ছাড়া সকল ফ্রিজও পুড়ে ছাই।
জমি বিক্রির টাকা পুড়ে ছাই
মুদি দোকান, চালান দুই ভাই। এনামুল ইসলাম ও আইনুল ইসলাম। বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গায়। বড় ভাই এনামুল ইসলাম আগে দোকান করতেন কাওরান বাজারে। আর ছোটভাই আইনুল ইসলাম ভাঙ্গায়। এরপর দুইভাই মিলে ৮ মাস হলো ডিএনসিসি মার্কেটে দোকান নেন। ব্যবসা চলছিলো ভালোই। দেখছিলেন আলোর মুখ। বাড়িতে জমিও কিনেছেন এরই মধ্যে। আর গ্রামের বাড়ি থেকে অনেক দূরে ছিলো একটি পুকুর। দূরে হওয়ায় দেখা শুনার সমস্যা। তাই বিক্রি করে দেন পুকুরটি। দাম পান আড়াই লাখ টাকা। এই টাকা এনে রাখেন দোকানে। উদ্দেশ্য নতুন মালামাল নিয়ে আসা। ক্যাশেই ছিলো সেই টাকা।
গতকাল দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করেন টাকা রাখার লকার। চাবিতে যখন খোলে না, তখন ভাঙেন ইট দিয়ে। বের করে দেখতে পান সব টাকা পুড়ে ছাই। তবে টাকা না মিললেও অক্ষত ছিলো কিছু পয়সা।
ভাত গুলাও যদি বিক্রি হতো
চালের দোকান। বস্তায় বস্তায় চাল। আবার ছোট প্যাকেটে ছিলো সুগন্ধি চাল। আগুনের তাপে সেগুলো পরিণত হয়েছে ভাত ও পোলাও-এ। দোকানে দোকানে উদ্ধার কার্যক্রম চললেও এসব দোকানের মালিকদের নেই কোনো তাড়া। কারণ তাদের দোকানের সকল পণ্যই সেদ্ধ।
উজ্জ্বল ঠাকুর। তার দোকানে ছিলো প্রায় ৬৩ মণ চাল। পোলাওর চাল ছিলো আরো ১৫ মণের মতো। তিনি দোকানের সামনে চিৎকার করছিলেন। তার দোকানের সামনে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। ভাতের ভিতর যাচ্ছিল পা ডেবে। বলেন, এই ভাতগুলোও যদি বিক্রি করা যেতো, একটু লোকসান কমতো। আমার সব চাল শেষ। ব্যবসা শেষ। এর আগের আগুনের সময়ও সব চাল পুড়ে গেছিলো। কোনোরকম ব্যবসাটা দাঁড়ালো। আবার সব শেষ হয়ে গেলো।
পুড়লো সঙ্গে চুরিও হলো
দৈনন্দিন ব্যবহার্য প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকান চালাতেন। মিথিলা ফারজানা। দোকানে ছিলো প্লাস্টিকের বালতি, মগ, জগ, চেয়ার, টেবিলসহ নানা পণ্য। আরো ছিলো ব্যবহার্য বিভিন্ন কাপড়ের সামগ্রী। যেমন টেবিল ম্যাট, তোয়ালে, দরজা-জানালার পর্দা ইত্যাদি। তার দোকানটি মার্কেটের মূল মার্কেটের থেকে কয়েক হাত দূরে। তাই এই দোকানে আগুনের ছোঁয়া লেগেছে কম। তবে যেসব পণ্য পোড়েনি, সেসবপণ্য নেই দোকানে। শুধু পুড়ে যাওয়া পণ্যগুলোই সেখানে।
মিথিলা ফারজানা বলেন, এক গাঁট্টিতে ছিলো ৮টা চেয়ার। লাল রংয়ের দু’টা চেয়ার অর্ধেক পোড়া। বাকি চেয়ারগুলো কই। বালতি ছিলো ২০টির মতো এখন আছে ৬টি। বাকিগুলো সব চুরি হয়ে গেছে। আমি যখন প্রথম এখানে আসি। তখন দেখি অল্প কিছু জিনিস পুড়েছে। আর একটা অক্ষত বড় টেবিল ফ্যান ছিলো টেবিলের ওপর। এরপর আমার পাশের দোকানে ধোঁয়া উড়তে দেখে বের হয়ে যাই। এখন এসে দেখি ফ্যান নাই।
পাড়াইয়েন না ভাই, এগুলোই আমার সব
ক্রোকারিজের দোকান চালান চার ভাই। একটি দোকান ঘিরেই এই চার ভাইয়ের স্বপ্ন। সংসার। দোকানে খুঁজে খুঁজে বের করছিলেন ভালো পণ্যগুলো। ছাইয়ের সঙ্গে পানির স্পর্শ পাওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে কালো কাদার। সেই কাদার মধ্যেই হাত দিয়ে খুঁজছিলেন ভাইয়েরা। তাদের দোকানের নাম পাটোয়ারী ট্রেডার্স। টেনে টেনে বের করছেন হাঁড়ি-পাতিল, ফ্রাই পেন, চামচ ইত্যাদি।
বড় ভাই সৌরভ পাটোয়ারী বলেন, এই দোকান দিয়েই চলে আমাদের সংসার। প্রায় দশ লাখ টাকার পণ্য ছিলো। কথা বলার সময় একজন গণমাধ্যমকর্মী তার বাছাই করা পণ্যের ওপর পা দিয়ে ফেলেন। তখন তিনি আকুতির স্বরে বলেন, পাড়াইয়েন না ভাই, এগুলোই আমার সব।
বিয়ের ৭ দিনের মাথায়...
বিকাশ চন্দ্র দাস। হাতে মেহেদীর রং এখনো শুকায়নি। করেন মুরগির ব্যবসা। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। ঘরে বৃদ্ধ মা। বিয়ের কারণে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ ছিলো তার দোকান। শুক্রবার বিয়ের পর প্রথম দোকান খোলেন। তারপরদিনই ব্যবসার সামগ্রী পুড়লো। ছাই হলো ড্রেসিং মেশিন।
কপালে হাত দিয়ে ড্রেসিং মেশিনের সামনে বসে ছিলেন তিনি। আবেগী গলায় বলেন, আমি গরিব মানুষ। এই ড্রেসিং মেশিনটা কিনেছিলাম বছরখানেক আগে। এর ৩০ হাজার টাকা এখনো বাকি। আর বিয়ের সময় করেছি ৩০ হাজার টাকা ধার। আর এই টাকা শোধ দিয়ে দিতাম কিন্তু হায় ড্রেসিং মেশিনটাই পুড়ে গেলো।

No comments

Powered by Blogger.