তৃণমূলের ৪২ কত দূর? by অমর সাহা

ভারতের ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনেরই প্রার্থী। যেখানেই ঘাসফুল, সেখানেই তিনি। তাঁর অবস্থান এই জোড়া ফুল আর ঘাসফুল জুড়ে।
এবার ২০১৯ সালে এসে মমতা একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু ৪২ আসন ছাড়ছেন না। ৪২ আসনই তাঁর চাই বলে স্লোগান দিচ্ছেন। মমতা চান, এবার তৃণমূলকে এই ৪২ আসনেই জয়ী হতে হবে। মমতা মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গ মানে মমতার ঘাসফুল বা জোড়া ফুল। তাঁর দলের ৪২ আসনের সঙ্গে কোনো সমঝোতা নেই। আপসও নেই। মমতা নির্দেশও দিয়েছেন, তিনি কোনো অজুহাত শুনবেন না। তাঁর দলকে ৪২ আসনেই জিততে হবে।
লোকসভার নির্বাচন হচ্ছে ৫৪৩টি আসনে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ৪২টি আসন। ২০১৪ সালে মমতা একাই ৩৪টি আসনে জিতেছিলেন। কংগ্রেস নিয়েছিল ৪টি আসন। আর বাম দল ও বিজেপির ভাগ্যে জুটেছিল ২টি করে আসন। এবার মমতা অতীতের সব কথা ভুলে একেবারে নতুনভাবে মাঠে নেমেছেন। দাবি তুলেছেন ৪২–এ ৪২ চাই। তিনি এ কথাও বলেছেন, এই রাজ্যে আর বিরোধী দল থাকতে পারবে না। শুধু তৃণমূল থাকবে। তৃণমূল জিতবে। তাই এবার ৪২ আসনই পাচ্ছেন তিনি।
পাশাপাশি মমতা আরও একটি স্লোগান তুলেছেন। সেটি হলো, ‘মোদি হটাও দেশ বাঁচাও’। মমতার লক্ষ্য, দিল্লির গদি থেকে মোদিকে হটিয়ে নতুন ধর্মনিরপেক্ষ প্রধানমন্ত্রী বসানো। কে হবেন সেই পদের দাবিদার? তা স্পষ্ট করেননি মমতা।
ভারতে তিনটি রাজনৈতিক জোট রয়েছে। এগুলো হলো বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএ, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট বা ইউপিএ এবং কংগ্রেস-বিজেপিবিরোধী ২৩ দলের আরেকটি জোট ইউনাইটেড ইন্ডিয়া। নেতা এখনো ঘোষিত না হলেও মমতা এই জোটের প্রধান হিসেবে রয়েছেন।
কংগ্রেস জোটে (ইউপিএ) রয়েছে ২৮টি রাজনৈতিক দল আর বিজেপি জোটে (এনডিএ) রয়েছে ২৯টি রাজনৈতিক দল। বিজেপি জোট জিতলে প্রধানমন্ত্রী হবেন নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেস জোট জিতলে রাহুল গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। মমতার তৃতীয় শক্তির জোট ইউনাইটেড ইন্ডিয়া জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে জট এখনো কাটেনি। কোনো ঘোষণাও আসেনি। এই জোটের প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে ১ নম্বরে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর রয়েছেন তেলেগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু, বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব প্রমুখ। এই জোটের আরও অনেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। বিজেপি বাদে ইউপিএ এবং ইউনাইটেড ইন্ডিয়া জোট সরকার গড়তে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে।
ভারতের কোনো জনমত সমীক্ষায় এখনো আশার কথা শোনা যায়নি। প্রতিটি জনমত সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বা এনডিএ এবার আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়তে পারছে না। ভারতের লোকসভায় রয়েছে ৫৪৩টি আসন। সরকার গড়তে প্রয়োজন ২৭২টি আসন। সর্বশেষ জনমত সমীক্ষায়ও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, বিজেপি সরকার গড়ার জন্য ৮টি আসন থেকে দূরে থাকছে। পেতে পারে ২৬৪টি আসন। গত সপ্তাহে এবিপি নিউজ এবং সি-ভোরের ওই যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এনডিএ টেনেটুনে সরকার গড়তে সক্ষম হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেস বা মমতার জোটের পৃথকভাবে সরকার গড়ার সম্ভাবনা কম। ইউপিএ পেতে পারে ১৪১টি আসন আর মমতার ইউনাইটেড ইন্ডিয়া পেতে পারে ১৩৮টি আসন। তবে ইউপিএ এবং মমতার ইউনাইটেড ইন্ডিয়া জোট যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের সরকার গড়ার একটা সুযোগ এসে যেতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ৪২ আসনের মধ্যে তৃণমূল পেতে পারে ৩৪টি আসন। ৮টি যেতে পারে বিজেপির ঝুলিতে। কংগ্রেস এবং বাম দলের থলেতে কোনো আসন ঢুকতে না–ও পারে। তবে বাম দল ও কংগ্রেস এই হিসাব মানছে না। তারা বলছে, গতবারের থেকে এবার বেশি আসন পাবে।
এসব হিসাব–নিকাশের মধ্যে বিরোধীরা একটুও হাল ছাড়ছে না। তারা নিশ্চিত, এবার মোদি আর ফিরছেন না। সামনের দিনগুলোতে ভোটের চেহারা আরও বদলাবে। কমে যাবে মোদির ভোট। দেশে আসবে নতুন সরকার, নতুন প্রধানমন্ত্রী। আর এই লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান চষে বেড়াচ্ছে বিজেপিবিরোধীরা।
মমতার লক্ষ্য, পশ্চিমবঙ্গের ৪২–এ ৪২ আসন। মমতা এই রাজ্যের ৪২ আসনে একাই প্রার্থী দিয়েছেন। মমতার ধারণা, নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের পরেই তৃণমূলের শক্তি থাকবে। কারণ, ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশের ৮০ আসনে মায়াবতী, অখিলেশ যাদবরা আসন ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। মহারাষ্ট্র আসনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য। এখানে রয়েছে লোকসভার ৪৮টি আসন। এখানেও আসন রফা হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে শারদ পাওয়ারের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি বা এনসিপির। এরপরের অবস্থান মমতার তৃণমূলের। এই রাজ্যে ৪২টি আসন ভাগ করেননি তিনি। লড়ছেন একাই। চতুর্থ স্থানে আছে বিহার। আসনসংখ্যা ৪০। এখানেও আসন ভাগ হয়েছে বিজেপিবিরোধী দলের মধ্যে। পঞ্চম স্থানে রয়েছে তামিলনাড়ু। এখানে রয়েছে ৩৯টি আসন। এখানেও ডিএমকের সঙ্গে আসন রফা হয়েছে কংগ্রেসের। এরপরেই রয়েছে দেশের অন্যান্য রাজ্য। দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ বাদে অন্যান্য রাজ্যে বিরোধীদের আসন সমঝোতা হলেও সেখানে কংগ্রেস ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলের ৪২ আসন পাওয়ার মতো শক্তি নেই। কারণ, তারা এককভাবে মমতার মতো ৪২টি আসনে প্রার্থীই দিতে পারেনি। ফলে মমতার স্বপ্ন, নির্বাচনে আসনসংখ্যার দিক থেকে তারাই কংগ্রেসের পরে থাকবে। আর ইউনাইটেড ইন্ডিয়া জোটের শীর্ষে থাকবে মমতার তৃণমূল। আর তখন যদি দেখা যায় বিজেপির ভরাডুবি আর সম্মিলিত বিরোধীদের আসনসংখ্যা সরকার গড়ার মতো অবস্থানে রয়েছে, সে ক্ষেত্রে মমতাই হবেন রাহুল গান্ধীর পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার। এসব অঙ্ক কষেই এগোচ্ছেন মমতা। এই লক্ষ্যে কাউকে কোনো একটি আসন না দিয়ে বরং একাই ৪২ আসনে প্রার্থী দিয়ে জয়ের স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখা শুরু করেছেন মমতা।
রাজনৈতিক অঙ্গনে জোরদার হচ্ছে মমতা কি সত্যিই ৪২ আসনেই জিততে পারবেন? বিরোধী দলগুলো কি একটি আসনও পাবে না? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মমতার ৪২ আসনে একতরফাভাবে জয়ের দাবি মানতে পারছেন না। তাঁরাও বলেছেন, এটা মমতার অলীক স্বপ্ন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস। এত দিন ধরে দেশের বিভিন্ন নামীদামি জনমত সংস্থার রিপোর্টে এ কথা এখনো তুলে ধরা হয়নি যে মমতা একাই ৪২ আসন পাচ্ছেন। জনমত সমীক্ষায় সর্বশেষ যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তাতেও বলা হয়েছে, খুব একটা বিপ্লব ঘটে না গেলে মমতার সেই ৩৪ আসনই জিততে হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি জনমত সংস্থা বলেছে, দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসবে বিজেপি। তারাও তৃণমূলের মতো ঘোষণা দিয়ে বসেছে, তারা এবার ২৩টি আসনে জিততে চলেছে। যদিও বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস এখনো ঘোষণা দেয়নি তারা কয়টি আসনে জিততে চলেছে। তাই রাজনৈতিক মহলে এই প্রশ্ন জোরদার হচ্ছে, মমতার ৪২ আসন জেতার পথ কত দূরে? সত্যিই কি মমতা ৪২ আসনে একাই জিততে চলেছেন, নাকি নির্বাচনের প্রচারে চমক দিচ্ছেন মমতা? নাকি মমতা যেভাবেই হোক সব আসনে জেতার ছক নিয়ে এগোচ্ছেন?

No comments

Powered by Blogger.