বৃষ্টির শেষ কথা... by মরিয়ম চম্পা ও পিয়াস সরকার

গত ২৬শে মার্চ বিবাহবার্ষিকীর দিনে বৃষ্টি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিল লাইফ ইজ বিউটিফুল। মাত্র একদিন মাঝে। ২৮শে মার্চ বৃষ্টির জীবনে এলো কালো অধ্যায়। বনানীর এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ আগুন বৃষ্টির সুন্দর জীবনকে থামিয়ে দিয়েছে। প্রেমিক স্বামী নূরকে দিয়ে গেছে একরাশ যন্ত্রণা। এই নূর আর বৃষ্টি দীর্ঘ ১২ বছর প্রেম-ভালোবাসায় আবদ্ধ ছিল। তারপর ২০১৬ সালে প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটায় বিয়ে করে। পুরো নাম শেখ জারিন তাসনিম বৃষ্টি।
বয়স মাত্র ২৫ বছর। আর তার প্রেমিক স্বামী কাজী সাদ নূর।
নূর ঢাকা রিজেন্সি হোটেলে সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং ম্যানেজার। এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সময় দুপুরে নূরকে ফোন দিয়ে বৃষ্টি বলেন, ‘টাওয়ারে আগুন লেগেছে, আমি ওপরে যাচ্ছি’। এটাই যে তার চিরতরে ওপরে এবং ওপারে চলে যাওয়া সেটা বুঝতে পারেনি নূর। স্ত্রীর চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। শুধু অঝোরে কাঁদছেন।
বৃষ্টি ও নূরের ছোটবেলার বন্ধু জাহিদ বলেন, বৃষ্টির পরিচয় বন্ধুর বউয়ের থেকে আগে হচ্ছে আমাদের ছোট বোন। এরপর হচ্ছে বন্ধুর বউ। আমরা তিনজন একই স্কুল-কলেজে পড়েছি। ২৬শে মার্চ বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাই। এটাই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। ওদের দাম্পত্য কাপলটা আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবার মধ্যে একটি ঈর্ষণীয় ছিল। ওদের দেখে আমরা ঈর্ষা করতাম। টোটালি ইউনিক একটি কাপল ছিল তারা।
বৃষ্টি এতো পরিমাণে মিশুক ছিল যে একটুখানি কথা বলতো সে তার সঙ্গে দ্বিতীয়বার কথা বলতে এবং সম্পর্ক বজায় রাখতে বাধ্য। বৃষ্টি টাওয়ারের ১২ তলায় অবস্থিত ইউআর সার্ভিস বাংলাদেশ লিমিটেড-এ এইচআর এবং অ্যাডমিন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিল। সে এতোটাই উৎসবপ্রিয় ছিল যে প্রত্যেকটি পালাপার্বণে তার বিশেষ প্ল্যান ও পরিকল্পনা থাকতো। সামনে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ইতিমধ্যে তার অনেক পরিকল্পনা ছিল। চাকরির পাশাপাশি বৃষ্টির একটি অনলাইন শপিং বিজনেস ছিল। সেখানে এক্সক্লুসিভ কিছু জিনিসপত্র যা সে নিজেই তৈরি করতো।
চাচাতো ভাই শেখ জিসান ইসলাম বলেন, দুই বোনের মধ্যে বৃষ্টি ছোট। বাবা শেখ মোজাহিদুল ইসলাম একজন ব্যবসায়ী। মা নীনা ইসলাম গৃহিণী। গ্রামের বাড়ি যশোর বেজপাড়া। ঢাকায় স্বামীর সঙ্গে খিলক্ষেত বটতলা ৮৪/১-এর বাসায় থাকতো। উত্তরা ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ এবং ইউআইইউ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করে। জিসানের সঙ্গে সর্বশেষ ২৬ তারিখ কথা হয় বৃষ্টির। বিবাহবার্ষিকীতে বোনকে ফোন দিয়ে জিসান উইস করে বলে খাওয়াবি কবে। এটাই ছিল তার শেষ কথা।
তার স্বামী কাজী সাদ নুর। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশ বুঝে নেন স্বজনরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চাচা শেখ জাহিদুল ইসলাম, দুলাভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন ও বোন শেখ শাহনেওয়াজ ফেরদৌস। সকাল ৭টায় লাশ বুঝে নেবার পর নিয়ে যাওয়া হয় যশোরে। গতকালই যশোরে তার জানাজা সম্পন্ন হয় বিকাল ৫টার দিকে। আর দাফন সম্পন্ন হয় পরপরই।
তার চাচা শেখ জাহিদুল ইসলাম বলেন, খুব হাসি খুশি মেয়ে ছিল। ছিল অনেক ভালো। সবাইকে আপন করে রাখতো। কখনো তার মুখে দুঃখের ছাপ দেখিনি। তার চাচা আরো বলেন, বৃষ্টির শরীরে কোনো পোড়া ছিল না। মূলত অক্সিজেনের অভাবেই ঢলে পড়েছেন মৃত্যুর কোলে। আমাদের লাশ শনাক্ত করতে কোনো সমস্যা হয়নি।
বৃষ্টির পরিচিত সানজিদা আক্তার বলেন, খুব মজার মানুষ ছিল বৃষ্টি। তার সঙ্গে যখনই দেখা হতো- হাসি থাকতোই মুখে। আর খোঁজ খবর নিতেন নিয়মিত। রূপ সচেতন ছিলেন খুব। সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকার চেষ্টা করতেন।
বৃষ্টির এই অকাল মৃত্যুতে পরিবারের ওপর নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাবা যেন কাঁদতে ভুলে গেছেন। আর মায়ের কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে চারপাশ। আদরের মেয়ে চলে গেলেন তাদের আগে এটা মেনে নেয়া অনেক কষ্টের। আর ভালোবাসার মানুষটিও হয়ে পড়েছেন নির্বিকার। তিনি বলেন, বৃষ্টির সঙ্গে শেষ কথা হয়, সে তখন বলছিল আগুন আর ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমি তাকে বলি, দৌড়ে উপরের দিকে চলে যাও। ১৮ তলায় অবস্থানকালে সে জানায়, ধোঁয়ার কারণে আর যেতে পারছে না। এ সময় পাশ থেকে তার সহকর্মীরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল যে, তারা পাশেই আছে।’ এটাই বৃষ্টির সঙ্গে শেষ কথা। এরপর অসহায়ের মতো ছুটে বেরিয়েছেন বনানীর এফ আর টাওয়ারের সামনে। কুর্মিটোলা হাসপাতালে ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অবশেষে দেখা পান প্রিয়ার। অক্ষত শরীরে। তবে শুধু শ্বাসটাই ছিল না।

No comments

Powered by Blogger.