একজন ডাকাতের বয়ান: এসব টাকা আমার কোনো কাজে আসেনি by রুদ্র মিজান

পরনে পুলিশের পোশাক। পদবি সাব ইন্সপেক্টর। সঙ্গী দু’জন কথায় কথায় ‘স্যার স্যার’ বলে সন্বোধন করেন। তাদের একজনের সাদা পোশাক, অন্যজনের পোশাক কনস্টেবলের। প্রায় রাতেই এভাবেই ডিউটিতে বের হতেন আলী হোসেন। না, সরকারি কোনো ডিউটি। তারা পুলিশের কোনো সদস্য না। পুলিশে কর্মরত বলেই পরিচয় দিয়ে থাকেন।
গাজীপুর, টঙ্গী ও উত্তরা এলাকায় দেখা মিলতো তাদের। কাজ ছিল পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি। ডাকাতি তার পেশা। কিশোর বয়স থেকেই মিশে গেছেন ডাকাত দলের সঙ্গে। শুরুতে ডাকাতি শিখতে হয়েছে তাকে। ডাকাতিও শেখার বিষয় বলেই মনে করেন আলী হোসেন। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ডাকাতি করেছেন, বারবার কারাভোগ করেছেন তিনি। অনেক টাকাও পেয়েছেন। কিন্তু কাজে লাগাতে পারেন নি। খারাপ কাজের টাকা হাতে থাকে না, কাজে লাগে না বলে বিশ্বাস করেন। তাই এখন ডাকাতি ছেড়ে দিয়েছেন। তবু ডাকাত হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে রাজি না তিনি। তার ছেলে-মেয়েদের কেউ ডাকাতের বাচ্চা বলুক এটি চান না এই পিতা।
সম্প্রতি আলী হোসেনের ডাকাত জীবন নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, গ্রামের বাড়ি পদ্মার তীরবর্তী এলাকায়। ছোটবেলায় মা মারা যান। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। একে তো বাবার দ্বিতীয় সংসার, তারমধ্যে ছিল অভাব। গ্রামে থাকতেই ছোটখাটো চুরি করতেন। তবে, গ্রামে চোর হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেনি। একপর্যায়ে মা-বাবাকে না জানিয়েই পা দেন ঢাকায়। এখানে সদরঘাটে, কমলাপুরে থেকেছেন দীর্ঘদিন। শিখেছেন গাড়ি চালানো। প্রাইভেট কার চালাতেন। গাড়ি চালাতে গিয়েই পরিচয় হয় গাজীপুরের এক ছিনতাইকারীর সঙ্গে। সময়টা ২০০০ সাল।
যোগ দেন এ চক্রে। আলী হোসেনের কাজ ছিল, যততত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানো। গাড়িতে আগেই কয়েক যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী বসে থাকতো। কখনো কখনো রাস্তা থেকে যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীদের তোলা হতো। প্রথম কাজেই প্রায় ৩০ হাজার টাকায় পেয়েছিল তাদের দল। একেক দিন একক এলাকা টার্গেট করতো তারা। কখনো ফার্মগেট, কখনো মতিঝিল। গণপরিবহনের জন্য মানুষ সড়কে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অতিষ্ঠ হয়ে যেত। তখন প্রাইভেট কার নিয়ে ডাকলে সহজেই যাত্রী মিলতো। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানান, রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফামর্গেট থেকে এক পুরুষ ও এক নারীকে গাড়িতে তোলেন। তারা যাবেন মিরপুর-১১তে। গাড়িতে আগে থেকেই তার দু’জন লোক ছিল। খামার বাড়ি থেকে নেন আরো দু’জনকে। এই চারজনই তাদের দলের সদস্য। গাড়িতে খেলনা পিস্তল আর ধালালো অস্ত্র ছিল।
গাড়িটি সংসদ ভবন এলাকা পেরিয়ে যেতেই ভেতরে দুই যাত্রীকে জিম্মি করা হয়। পুরুষ লোকটি চিৎকার করার চেষ্টা করলে তার মুখ চেপে হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তাদের এক সদস্য। রক্ত দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে যায় ওই লোকের স্ত্রী। এরমধ্যেই ওই নারীর পরনে থাকা স্বর্ণালঙ্কার ও পুরুষ লোকটির মানিব্যাগ রেখে আগাওগাঁও এলাকায় ফেলে চলে যায় তারা। এভাবেই একের পর এক ডাকাতি-ছিনতাই করছিল এই চক্র। একপর্যায়ে তারা খোঁজ পান পুলিশের পোশাক কিনতে পাওয়া যায়। অন্য একটি গ্রুপের মাধ্যমে ঢাকার একটি মার্কেট থেকে তিন সেট পুলিশের পোশাক ক্রয় করেন। আলী হোসেন জানান, গাড়ি চালাতে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সখ্যতা হয়েছিল তার। মাঝে-মধ্যে তার গাড়ি রিকুইজিশন করতো তারা। সেখান থেকেই পুলিশের ব্যাজ সম্পর্কে ধারণা পান। সেই অনুসারেই এএসআই ও কনস্টেবলের পোশাক কেনেন। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটেন। ডাকাতির প্রস্তুতি থেকে ডাকাতির সময় পর্যন্ত র‌্যাঙ্ক অনুসারেই ‘স্যার’ সম্বোধন করে কথা বলতো তারা। আশপাশের কেউ দেখে বুঝতেই পারবে না তারা পুলিশের সদস্য না। এমনকি কনস্টেবলের কোমরে থাকতো হ্যান্ডকাপ।
ডাকাতির কৌশল সম্পর্কে তিনি আরো জানান, পুলিশের পোশাক পরে গাড়ি ছিনতাই শুরু করেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা দেখে হাত ইশারায় ডেকে থামাতেন। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত তিনজন অংশ নিতো। সঙ্গে রাখতো নেশা জাতীয় ওষুধ মিশ্রিত খাবার। পুলিশের পোশাক পরিহিত দেখে বিশ্বাস করে সহজেই তাদের দেয়া খাবার খায়। এ ছাড়া যেকোনো নির্জন স্থানে থামাতে বললে থামাতে আপত্তি করে না। এমনকি কিছু কেনার অজুহাতে চালককে গাড়ি থেকে নামিয়ে পাশের দোকানে পাঠিয়ে নির্বিঘ্নে গাড়ি চুরি করা যেত বলে জানান আলী হোসেন। এরকম নানা কৌশল খাটিয়ে চুরি-ছিনতাই করা গাড়িগুলো বিক্রি করতো আরেক পার্টি। গাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতো। এমনকি গাড়ির চেসিস নম্বর পরিবর্তনসহ ভুয়া কাগজপত্র তৈরির কাজটিও করতো তারা। পাঞ্চ মেশিনের গাড়ির চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বর পরিবর্তন করে বিআরটিএ’র মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে গাড়ি বিক্রি করতো এই চক্র। তবে, তাদের সবাইকে চিনতেন না বলে জানান আলী হোসেন। দু’এক জনের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। তাদের মাধ্যমেই এই কাজগুলো করানো হতো। আলী হোসেন বলেন, এই লাইনে কেউ নিজের আসল পরিচয় দেয় না। গোপন রাখে। আমরা একে অন্যের বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত জানতাম না।
নেশা জাতীয় ওষুধ মেশানো সম্পর্কে তিনি জানান, ওষুধ গুঁড়া করে ঢুকানো হতো ডিমের ভেতরে। এ জন্য কাঁচা ডিমের কিছু অংশ ভেঙে জুস পানের পাইপের মাধ্যমে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। পরবর্তীতে ডিমটি ভাত রান্নার সময় উপরে রেখে সিদ্ধ করে ডিমের ভাঙা অংশে আটা দিয়ে খোসা লাগানো হতো। তখন  বোঝার উপায় থাকে না এই ডিমটি ভেঙে ওষুধ ঢোকানো হয়েছে। তারপর ওষুধ মেশানো ডিমটি দেয়া হতো নির্ধারিত ডিম বিক্রেতার কাছে। চক্রের সদস্যরা চালককে নিয়ে ডিম খেতে গেলে ওষুধ মেশানো ডিমটি বের করে দেয় বিক্রেতা। এভাবেই চালককে অজ্ঞান করে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যেত তারা। এ ছাড়াও মাস্টার কিউ ব্যবহার করে গাড়ি নিয়ে যেত চক্রের সদস্যরা। আলী হোসেন জানান, গত বছরের মে মাসে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারপর দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়েছেন তিনি। আলী হোসেন বলেন, এসব টাকা আমার কোনো কাজে আসেনি। শুধু বদনাম হয়েছে। তাই এই পথ ছেড়ে দিয়েছি। এখন নিজের পাপের জন্য মাফ চাই। নামাজ পড়ি। এখন গাড়ি চালক হিসেবে সৎভাবে বাকিটা জীবন কাটাতে চান বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.