নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে শাস্তি হয়নি কারো by শুভ্র দেব

রাজধানীর নিমতলী এলাকার ৪৩ নম্বর বাড়ি। এই বাড়িতেই ২০১০ সালের ৩রা জুন রাতে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভয়াল এই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি হয় ১২৪ জন নারী-শিশু ও পুরুষের। বর্তমানে ওই বাড়ির নিচতলার একটি গোডাউন ভাড়া নিয়ে ডেকোরেটর্সের ব্যবসা করছেন ৭০ বছর বয়সী হাজী সাদেক খান। প্রায় ৯ বছর আগের অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর সাদেক খান অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, কী হবে এসব শুনে। কেউ কিছু করতে পারব না। কেউ মা হারিয়েছে, কেউ বাবা আবার কেউবা সন্তান।
যার গেছে সেই বুঝে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না।
বাড়ির মালিক, কেমিক্যাল গোডাউনের মালিকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি। এ ঘটনায় আমি নিজেও এক ছেলে এবং এক মেয়েকে হারিয়েছি। প্রতি বছর ৩রা জুন এলে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেক দাবি দাওয়ার কথা তুলে ধরি। কিন্তু কোনও দাবি আর মেনে নেয়া হয়নি।
২০১০ সালের ৩রা জুন থেকে ২০১৯ সালের ১লা মার্চ। কেটে গেছে লম্বা এক সময়। আর তিন মাস পরে নিমতলী ট্র্যাজেডির নয় বছর পূর্ণ হবে। লম্বা এই সময়ে এ ঘটনায় কাউকে দোষী সাব্যস্ত করাতো দূরের কথা থানায় একটি মামলা দায়ের করাও হয়নি। বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাহিদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ওই ঘটনায় নিয়মিত কোনো মামলা হয়নি। একই থানার আগের ওসি আবদুল কুদ্দুস ফকির বলেন, আমার জানামতেও কোনো মামলা হয়নি। শুধুমাত্র ওই সময় একটা জিডি হয়েছিল। নিমতলীর এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা বলছেন, এত মানুষের প্রাণহানির পরেও কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া সরানো হয়নি কেমিক্যালের কারখানা-গুদাম। বরং এখনও গোপনে এই এলাকার কিছু লোভী বাড়ির মালিক বেশি মুনাফার জন্য কেমিক্যাল গুদামের জন্য বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন। ওই এলাকার বাসিন্দা সাদেক খান বলেন, মানুষ থাকার জন্য বাড়ি বাড়া দিলে দুই মাসের অগ্রিম ও মাসে মাসে ৭-৮ হাজার টাকা করে ভাড়া পাওয়া যায়। তাই কিছু কিছু বাড়ির মালিক কেমিক্যালের গুদামের জন্য ভাড়া দিয়ে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা ভাড়া ও কয়েক লাখ টাকা অগ্রিম নিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর সিটি করপোরশেন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল একাধিক তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছিল ওই এলাকায় মোট ২ হাজার ৭৯টি কেমিক্যাল গুদাম ছিল। এর মধ্যে আট শতাধিক বৈধ ছিল। বাকি ১ হাজার ২৭৯টি অবৈধ। ওই সময় তদন্ত কমিটি বৈধ-অবৈধ সব গুদামই কেরানীগঞ্জের আশেপাশে নেয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু সেগুলো এখনও সরানো হয়নি।
এছাড়াও নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করেছিল। মূলত আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে দেয়ার জন্য এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে আরো তিনটি উপকমিটি করা হয়েছিল। কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছিল, কেমিক্যাল গুদাম ও কারখানা করার ক্ষেত্রে যে সব নীতিমালা মানা প্রয়োজন তার কোনোটিই মানা হচ্ছে না। এসব নীতিমালার মধ্যে রয়েছে এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন, এসিড নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, বিস্ফোরকদ্রব্য আইন, পরিবেশ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। ওই সুপারিশে কিভাবে বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ আমদানি, মজুত, বিক্রি ও পরিবহন করা হচ্ছে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আভাস দেয়া হয়েছিল। তারপরও রাসায়নিক  কেমিক্যালের গুদাম ও কারখানা সরানো হয়নি। এছাড়া কারখানা পরিচালনার কোনো নীতিমালাও মানা হয়নি। নিমতলীর মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মতো আর যাতে কোনো ঘটনা না ঘটে সেজন্য নিমতলী নবাব কাটারা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মো. হুমায়ুন গোলা মানবজমিনকে বলেন,  আমিও জানি কোনো মামলা করা হয়নি। কাউকে কোনো শাস্তি দেয়া হয় নাই। এত বড় একটা ঘটনার পর কাউকে দোষী সাব্যস্ত না করা ও শাস্তি না দেয়া খুবই দুঃখজনক। জড়িতদের শাস্তির ব্যাপারে আমরা এখনও দাবি তুলে যাচ্ছি। তিনি বলেন, এতগুলো মানুষের প্রাণহানি কেমিক্যাল কারখানা ও গুদামের জন্যই ঘটেছে। অথচ এখন পর্যন্ত এগুলো সরানো হয়নি। নিমতলীতে এখনও অনেক কেমিক্যালের গুদাম, প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে। এগুলো সরানোর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নাই। আমরা প্রথম প্রথম বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হানা দিয়েছি। অনেক কারখানা অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এক সময় গিয়ে থেমে যায়। তিনি বলেন, শুধু নিমতলীবাসীই নয় পুরো পুরান ঢাকাই ঝুঁকির মধ্যে আছে।
নিমতলীর মায়ের দোয়া লেডিস টেইলার্সের মালিক মো. সেলিম মানবজমিনকে বলেন, অনেক কিছুই বলতে চাই কিন্তু বলে কোনো লাভ নাই। বলতে বলতে এখন ক্লান্ত হয়ে গেছি। তিনি বলেন, চোখের সামনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যে বাড়িতে আগুন লেগেছে। কত মানুষ যে আগুনে পুড়ে মারা গেছে তার হিসাব নাই। আমার দোকানের একজন কর্মচারীও মারা গেছে। অনেকে বলেছেন বিদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ হয়ে এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মূল ঘটনা ঘটেছে কেমিক্যাল থেকে। ঘটনার তদন্তে এমন সত্যতা পাওয়া গেছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও এই এলাকায় এখনও অনেক কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম ও প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে। নিমতলী এলাকার বাসিন্দা রিপন বলেন, সে দিনের অগ্নিকাণ্ডে আমি আমার মা, বোন, ভাগ্নে, মামি, মামাত ভাই, খালাকে হারিয়েছি। তাই এখন আমরা কেমিক্যালের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। এলাকার যেখানেই কেমিক্যালের দোকান দেখছি সবাই মিলে গিয়ে সেটা সরানোর চেষ্টা করছি।

No comments

Powered by Blogger.