সড়কে যে কারণে মৃত্যুর মিছিল

এ মিছিলের কোনো শেষ নেই। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। সড়কে কেন এই মৃত্যুর মিছিল। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো যদি আমরা খুঁজে বের করতে পারি তাহলে এর সমাধান করাটা খুব সহজ হবে। প্রথম কথা হচ্ছে, একটি আদর্শ সড়কে  বিজ্ঞানসম্মতভাবে যে ৬টি উপাদান থাকা দরকার সেটা এখনো আমরা তৈরি করতে পারিনি। প্রথমত পর্যাপ্ত লেন থাকতে হবে। রাস্তায় ডিভাইডার থাকতে হবে। যাতে মুখোমুখি সংঘর্ষ না ঘটে।
রাস্তার পাশে একটি সোল্ডার থাকতে হবে। একটি সফট পার্ট থাকতে হবে যেখান দিয়ে মানুষ হাঁটা চলা করতে পারবে।
কিন্তু আমাদের অধিকাংশ সড়কগুলো হচ্ছে টু ওয়ে ও টু লেন সড়ক। একদিক দিয়ে গাড়ি যায় আরেক দিক দিয়ে আসে। কোনো ডিভাইডার নেই। ফলে মুখোমুখি সংঘর্ষ অহরহ ঘটে। রাস্তার সোল্ডার যেটা আছে সেটা অনেক ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত। আবার অনেক ক্ষেত্রে থাকে না। আবার থাকলেও ভাঙাচুরা বা গুল্ম লতাপাতায় মোড়ানো ব্যবহার অনুপোযোগী। ফলে মানুষ কিন্তু বাধ্য হয়ে মূল সড়কেই চলে আসে। আবার সড়কে পর্যাপ্ত সাইনের অভাব রয়েছে। অথচ সাইন হচ্ছে রাস্তার ভাষা। রাতের বেলা রাস্তার বেরিয়ার লাইন কিন্তু সাহায্য করে গাড়ি কতটুকু যেতে পারবে অথবা পারবে না। ফলে অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে গাড়ি ব্যালেন্স করতে না পেরে উল্টে পড়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া রাস্তায় একটি গাইড পোস্ট থাকতে হবে। সামনে স্কুল-কলেজ বা কোনো বাজার আছে কি না এ বিষয়ে গাইড পোস্ট অনেকক্ষেত্রে থাকে না। থাকলেও ভাঙা থাকে। যেটাকে লাল কালো রং দিয়ে কালার করতে হয়। যেটায় রাতের বেলা আলো পড়লে জ্বলে। ব্রিজের ক্ষেত্রে গার্ড রেলিং দিয়ে এটার বেষ্টনী তৈরি করতে হয়। না হলে গাড়ি ১০ ফিটের জায়গা থেকে ৮ ফিটের ব্রিজে যখন চলে আসে তখন গাড়ি হয় ব্রিজের রেলিংয়ে বাড়ি লাগে অথবা ব্রিজ থেকে উল্টে খাদে পড়ে যায়। এক্ষেত্রে গার্ড রেল বা রেলিং না থাকলে ব্রিজে দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। ডিভাইডার না থাকলে মহাসড়কে মুখোমুখি সংঘর্ষগুলো বেশি হয়। রাস্তায় মার্কিং না থাকলে গাড়ি উল্টে পড়ে যায় অথবা পার্শ্ববর্তী গাছের সঙ্গে বাড়ি খায়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের মহাসড়কের সঙ্গে প্রচুর ইন্টার সেকশন বা আন্তঃসংযোগ রয়েছে। ফলে এসব জায়গাগুলোতে প্রচুর হাটবাজার গড়ে ওঠে। অথচ ভূমি আইন বা ল্যান্ড রুল অনুযায়ী মহাসড়কের পাশে অন্তত ৪০ ফিট বাই ৪০ ফিট দূরে বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ হওয়া উচিত। অথচ এগুলো আমরা মহাসড়কের খুব পাশেই করি। ফলে এসব জায়গায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ এসব পথে মানুষের আনাগোনা বেশি হয়ে থাকে। এসব স্থানে বাজার তৈরি করতে হলে বাজারের মুখ দিতে হবে রাস্তার ঠিক উল্টা পাশে। রাস্তার দিকে নয়। রাস্তার এই কিছু কিছু বিষয়গুলো সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
এ ছাড়া সড়ক ব্যবহারকারী অর্থাৎ চালক এবং পথচারী এদের কারণেও বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আমাদের চালকরা মানসিকভাবে খুব চাপের মধ্যে থাকে। কারণ চালককে সকালে বাসা থেকে কয়েকটি টেনশন নিয়ে বের হতে হয়। প্রথমত তার গাড়িটি হচ্ছে মালিকের। যাত্রী পাক বা না পাক প্রত্যেকদিন গাড়ির মালিককে চালকের ২ হাজার টাকা জমা দিতেই হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে চালকের রাস্তার কিছু খরচ আছে। তাকে প্রতিদিন অবৈধ কিছু চাঁদা দিতে হয়। এই মানসিক প্রেসার নিয়ে যখন চালক গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে বেপরোয়া হয়ে গতি বাড়িয়ে আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে সামনের যাত্রীকে নিতে চায়। গাড়ির গতি বাড়ায়। জ্যামের ফলে আটকে থাকায় জ্যাম ছাড়লে ৪ ঘণ্টার পথ দু ঘণ্টায় যাওয়ার চেষ্টা করে। এবং দুর্ঘটনা ঘটায়। কারণ চালক জানে যে এটা না করলে দিন শেষে হয়তো সে ২শ’ টাকা নিয়েও বাসায় ফিরতে পারবে না। অর্থাৎ চালকদের এখন পর্যন্ত আমরা ট্রিপ বেইস ইনকামে রেখে দিয়েছি। তাকে ২০ দিনের টাকা দিয়ে ৩০ দিন চলতে হয়। সুতরাং এই সিস্টেমটিকে যদি আমরা বদলাতে না পারি এবং সমস্যার মূলে যদি হাত না দেই তাহলে শুধু চালকদের ধরে লাভ নেই। এটা কোনো সমাধান নয়। কারণ তাদেরকে আমরা একটি বেতন কাঠামোয় বা সুস্থ সিস্টেমে আনতে পারিনি।
এ ছাড়া চালকদের তৈরি করারও একটি বিষয় থাকে। গাড়ি চালানো এমন একটি বিষয় যেখানে খুব ঠাণ্ডা মেজাজে থাকতে হয়। আমরা জানি বিমান ও লঞ্চ চালানো সহজ। কারণ এক্ষেত্রে অনেক দূরের এরিয়া নিয়ে তারা দেখতে পায়। এবং তাদের প্রতিযোগী নেই। আর গাড়ি হচ্ছে প্রতি নিয়ত প্রতিযোগিতা করতে হয়। পথচারী, অন্য গাড়ি, ট্রেন, রিকশা ইত্যাদির সঙ্গে চালককে প্রতিযোগিতা করতে হয়। অথচ আমাদের চালকরা একদম না শিখেই চলে আসে। কারণ তাদের যে ড্রাইভিং স্কুল সেখানে শিখতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে চালক আসলেই মালিকরা তাকে নিয়ে নিচ্ছে। আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনাটা অসুস্থ। প্রথমত চালকদের কোনো নিয়োগ পত্র বা পদ্ধতি নেই। আজ যে গাড়ি চালাচ্ছে কাল সে গাড়ি চালক পাবে কি না সে বিষয়টি সে জানে না। মালিক অন্য কাউকেও দিতে পারে। অতএব তারা আজকের দিনে যা কামাতে পারি এই মানসিকতায় থাকে। চালকের নিয়োগপত্র ও রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে ঢাকা শহরে অনেকেই একটি মাত্র বাস নিয়ে একজন মালিক হয়ে থাকেন। এটা না করে একজন মাত্র মালিক বা কোম্পানির অধীনে সকল বাসকে নিয়ে আসতে পারলে তখন সুস্থ এবং শিক্ষিত মানুষ ব্যবসা করতে আসবে। এখন হচ্ছে অনেক মালিক এবং অনেক চালক। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের প্রতিযোগিতা। অথচ আমরা একটি রুটে একটি ভালো কোম্পানি বা বড় কোম্পানিকে আনতে পারি। যারা কি না ৫টি কোম্পানির ১শ’ কিংবা ২শ’ বাসকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ৫টি মিলিয়ে ১টি কোম্পানি করে তারা কিন্তু গাড়ির একই কালার করে এক টিকিটে একই সিস্টেমে চালাতে পারে। এতে যাত্রী পাওয়া নিয়ে কোনো শঙ্কা থাকবে না। কারণ যাত্রীরা যে গাড়িতে উঠুক দিন শেষে টোটাল মুনাফা যা হোক না কেন প্রত্যেকেই পেয়ে যাবে। কারণ এতদিন ১টি গাড়ির মুনাফা পেলেও এখন সেটা গড়ে পাবে।
এ ছাড়া আমরা ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যাল দিয়ে থামাটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি না। আমরা ইচ্ছামতো রাস্তা পার হতে চাই। হাত দিয়ে গাড়ি থামাতে চাই। নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে পার হই না। একেকজন একেক জায়গা দিয়ে পার হই। পথচারীরাও যেমন ঠিকমতো রাস্তা পার হই না। একইভাবে যেকোনো জায়গা দিয়ে উঠতে চাই এবং নামতে চাই। এ ছাড়া আমাদের নির্দিষ্ট বাস স্টপিসও নেই। আর থাকলেও নির্দিষ্ট স্থানে থামে না।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে চালকের ড্রাইভিং স্কুল, লাইসেন্স, বয়সসীমা ৩৫ বছর ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ একজন শিক্ষিত চালক নিয়োগ দিতে হবে। ড্রাইভিং স্কুল থেকে আসছে কি না একজন চালক সেটা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে আমাদের পথচারী যাত্রীরা একেবারেই অসচেতন। আমরা রাস্তার সব জায়গা দিয়ে পার হতে চাই। একমাত্র রেল আর প্লেন ছাড়া সব কিছুকেই হাত দিয়ে থামাতে চাই। ট্রেন পারি না ভয় লাগে। অনেক বড়। আর প্লেন পারি না কারণ এটা অনেক ওপর দিয়ে যায়। না হলে যাত্রীরা এগুলোও থামাতেন। আর বাকি সবগুলো কিন্তু হাত দিয়ে থামায়। কথায় আছে যে, ‘আইনের হাত অনেক লম্বা, তার চেয়ে লম্বা পথচারীর হাত’। ৭০ থেকে ১শ’ কিলোমিটার বেগে চলা গাড়িটিকে যদি হঠাৎ করে থামাতে চাই ওই মুহূর্তে চালক বুঝে উঠতে না পারার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। কাজেই একজন পথচারীর বোঝা উচিত রাস্তা পারাপারের নিয়মটা কি হবে। ফুট (ওভারব্রিজ), আন্ডার পাস এগুলো দিয়ে পার হবে।
এগুলো যদি না থাকে তাহলে অপেক্ষা করবে সিগন্যালের জন্য। কাজেই যাত্রীদের উচিত যেখানে সেখানে না ওঠা এবং না নামা। এবং পুলিশের করণীয় হচ্ছে যে ইন্টার সেকশন বা বাস স্টপিস ছাড়া যেন কোনো গাড়ি না দাঁড়ায় এটা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত চালক যেন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে যাত্রী না ওঠায় এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রত্যেকটি রাস্তায় সেফটি অডিট সম্পন্ন করতে হবে। চালকদের নিয়োগপত্রের আওতায় নিয়ে আসা। একই কোম্পানির অধীনে সব গাড়িকে নিয়ে আসতে হবে। বাস বে রাখতে হবে। পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাথ ক্লিয়ার রাখতে হবে। পর্যাপ্ত জেব্রাক্রোসিং ও আন্ডারপাস রাখতে হবে। এতে করে সড়ক দুর্ঘটনা কমার পাশাপাশি যানজটও কমতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.