সাগর-রুনি হত্যার ৭ বছর: এখনো জানা যায়নি তদন্তের ফল by শাহনেওয়াজ বাবলু

ছোট্ট মেঘের বয়স তখন মাত্র সাড়ে পাঁচবছর। হঠাৎই তার জীবনে নেমে আসে কালো মেঘ। ঘাতকরা  একসঙ্গে কেড়ে নেয় বাবা সাগর সরওয়ার আর মা মেহেরুন রুনিকে। এরপর থেকে মা-বাবা হারা মেঘের কেটেছে সাত বছর। এখন সে বুঝতে শিখেছে। প্রতিবছর ১১ই ফ্রেব্রুয়ারি এলেই গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়। প্রতিবছর এটি যেন রুটিন কাজ। কিন্তু ফল কি? কিছুই না।
সাড়ে ১২ বছরের মেঘের কোণে জমাট বেঁধেছে এক কুণ্ডলি অভিমান। তাই এখন আর গণমাধ্যমের সামনে আসতে তার মন চায় না। দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করে। কি হবে কথা বলে? ফিরে আসবে কি তার বাবা-মা। সাতটি বছরে যেখানে জানাই গেলো না কারা হত্যা করেছে মেঘের বাবা-মা’কে। তাই শোকের দিনে আর শোক বাড়াতে চায় না অভিমানী মেঘ। এ অভিমান শুধু মেঘের নয়। সাগর-রুনির পরিবারের, স্বজন আর সহকর্মীদের।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত চলছে সাতবছর ধরে। এখন পর্যন্ত ৬২ বার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য হয়েছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। এখনো কোনো আসামিকেই সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত বা আটক করা যায়নি।
সর্বশেষ গত ২৫শে নভেম্বর মামলায় প্রতিবেদন দেয়ার দিন ধার্য ছিল। তবে মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব’র সহকারী পরিচালক পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহমেদ কোনো প্রতিবেদন দিতে পারেননি।
বাবা-মা’কে হারানো মাহির সরওয়ার মেঘ গুলশানের বিআইটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ইদানীং ক্রিকেটের প্রতি বেশ ঝোঁক মেঘের। রাজধানীর ইন্দিরা রোডসংলগ্ন টিঅ্যান্ডটি মাঠে প্রতিদিন ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে যায় মেঘ। বাবা সাগর সরওয়ার আর মা মেহেরুন রুনির অভাববোধ হয়তো সবসময়ই থাকবে, তবে এর মধ্যেই জীবনের নিয়মে নানা ব্যস্ততায় নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে সে।
গতকাল কথা হয় মেঘের মামা নওশের রোমানের সঙ্গে। হতাশা ঝরে পড়লো সাগর-রুনি হত্যা মামলার এই বাদীর কণ্ঠে।
তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমরা আসলে গত ৭ বছর ধরে মামলা নিয়ে কিছুই জানতে পারিনি। আগে মিডিয়ার মাধ্যমে কিছুটা হলেও জানতে পারতাম। এখন সেখানেও তারা কথা বলছে না। এসব দেখে মনে হয় যে, এখন আর এ মামলার কোনো তদন্তই চলছে না।
এই মামলার তদন্ত করেছে পুলিশ, ডিবি ও র‌্যাব। এরই মধ্যে বদলি হয়েছেন অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তাও। এখন এই মামলার তদন্তে রয়েছে র‌্যাব’র এডি ও পুলিশের এএসপি সহিদার রহমান। গতকাল তিনি মানবজমিনকে বলেন, গত ২৩শে নভেম্বর মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে আমাকে। এর পর আমি মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের রোমানের সঙ্গে এবং সাগরের মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। এছাড়া আগের তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেছি। তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আগামী ১৭ই ফেব্রুয়ারি আদালতে তদন্তের প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। প্রতিবেদন দেয়ার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম মানবজমিনকে বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা মর্মাহত এবং ক্ষুদ্ধ। ৭ বছর পরেও এর কোনো বিচার হয়নি। যা সত্যিই দুঃখজনক। এই ঘটনায় সরকার এবং সাংবাদিকরা কিছুই করতে পারিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই করতে পারেনি। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, আমরা কোথায় যেন আটকে আছি। কোথায় যেন আবদ্ধ হয়ে আছি। আমি এটা শুনতে চাই না যে, মামলার তদন্ত চলছে, হবে, হচ্ছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আর আমি মনে করি রাষ্ট্র যদি চায় তাহলে অবশ্যই এর সুষ্ঠু তদন্ত করা সম্ভব।
এ বিষয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক। আর গত সাতবছরেও এর কোনো বিচার না হওয়াটাও বেদনার। এই ঘটনার জন্য বিগত বছরেও সব সময় আমরা বিভিন্ন প্রতিবাদ ও মানবন্ধন করেছি। আসলে এই ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। সাগর-রুনির সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আগামীকাল সকাল ১১টায় রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এরপর সাংবাদিকদের নিয়ে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করবো। মানববন্ধন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি জমা দেয়া হবে রিপোর্টার্স ইউনিটির পক্ষ থেকে।
২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি নিজ ভাড়া বাসায় খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার সময় বাসায় থাকা তাদের একমাত্র শিশুসন্তান সাড়ে পাঁচবছর বয়সী মাহির সরওয়ার মেঘ বেঁচে যায়।

No comments

Powered by Blogger.