এক প্রবাসী নারীর জেল অভিজ্ঞতা by মরিয়ম চম্পা

তেজগাঁওয়ের বনেদি পরিবারের মেয়ে তিনি। এক নামে তার বাবাকে অনেকেই চেনেন। বর্তমান তেজগাঁও কলেজ তার বাবার দান করা সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয়েছে বলে জানান তিনি। চল্লিশোর্ধ্ব এই নারীর তিন ছেলেমেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে আমেরিকাতে ছিল সুখের সংসার। আমেরিকায় অবসরে আর্কিটেকচার ও হ্যান্ডিক্রাফটের কাজ করতেন।
২০০৭ সালের দিকে বাংলাদেশে আসেন ব্যবসা করার উদ্দেশে। ব্যবসার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন তার দুই সন্তান ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আমেরিকান প্রবাসী স্বামী। ঢাকায় একটি অফিস কক্ষ ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
বেশ কিছুদিন পর অন্ধ বিশ্বাসে আগাম স্বাক্ষরিত একাধিক চেক অফিসের ম্যানেজারের কাছে গচ্চা রেখে পুনরায় আমেরিকাতে স্বামী-সন্তানের কাছে পাড়ি জমান। এ সুযোগে ম্যানেজার আর অফিসের কয়েকজন কর্মচারী মিলে তার স্বাক্ষরিত চেক দিয়ে আলাদাভাবে ব্যবসা করার উদ্যোগ নেন। ২০১২ ও ২০১৩ সালে সবক’টি চেকের অ্যাকাউন্ট ক্লোজ পেয়ে বিরোধী পক্ষ তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির অভিযোগে ৪টি মামলা করেন। একের পর এক মামলা ও প্রতারণার মুখে একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলেও ছোট দুই ছেলেমেয়ের অনুপ্রেরণায় বেঁচে গেছেন তিনি। বাবা বেঁচে নেই। মা ক্যানসারের রোগী। তারা ৬ ভাইবোন। সবাই অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার স্থায়ী নাগরিক। ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বাবার অগাধ সম্পত্তিই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই উক্ত মামলার রসদ জুগিয়েছিল তার আত্মীয় সম্পর্কিত কয়েকজন বড় ভাই। মামলা হওয়ার কয়েক বছর পর তাকে নোটিশ করা হয়। 
কারাভোগ করা এই নারী জানান, আমার নামে মামলা হলেও সমন জারি হয় কয়েক বছর পর। কাশিমপুর ও ফরিদপুর দুই জেলখানা মিলিয়ে মোট ১৪ থেকে ১৫ দিন বন্দি ছিলেন। জেলখানায় তার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে রীতিমতো শিউরে ওঠেন তিনি। বলেন, ৮শ’ নারী কয়েদির মধ্যে আমিই মনে হয় ব্যতিক্রম ছিলাম। সবাই আমাকে পর্যাপ্ত সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। যে ক’দিন ছিলাম পুরোটা সময় হাসপাতালে কাটিয়েছি। কারাভোগের দিনগুলোতে পানি, মুড়ি ও নানা ধরনের ফল খেয়েই ছিলাম। কারণ প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, আমি যেহেতু কোনো অন্যায় করিনি তাই জেলখানার কোনো খাবার এমনকি ভাতও খাবো না।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা করতাম। এরপর জেলখানার এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ঘুরে বেড়াতাম। অবসরে কবিতা লিখতাম, গান লিখতাম, গল্প লিখতাম। জেলের বাইরে ২৪ ঘণ্টার ২০ ঘণ্টাই ব্যস্ত থাকতাম। জেলে গিয়ে আমার শিল্পচর্চার একটি ভালো সুযোগ হয়েছিল। তখন কেউ বিরক্ত করতো না। জেলের ভেতরে যার টাকা আছে তার সব আছে। এক রুমে এত সংখ্যক মেয়েকে থাকতে দেয়া হতো যে, পা ফেলার জায়গা থাকতো না। শীতের সময় কারা কর্তৃপক্ষের একটি কম্বল আর ঠাণ্ডা মেঝেই মেয়েদের একমাত্র ভরসা। মেয়েদের যেসব ডাল, ভাত ও অন্যান্য তরকারি দেয়া হতো তাতে কয়েক দফা পানি মেশানোর পর খেতে দেয়া হতো। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা বাইরে থেকে মেয়েদের জন্য অসংখ্য সাহায্য সহযোগিতা পাঠালেও মেয়েদের হাতে তা পৌঁছতো না। খাবারের জন্য মেয়েরা প্রতিদিন মারামারি ও ঝগড়া করতেন। আমাকে নরমাল গোসলখানা ব্যবহার করতে দেয়া হলেও অন্য মেয়েদের একত্রে খোলা জায়গায় গোসল করতে হতো। এসময় পুরুষ কর্মচারী বা কারারক্ষীরা চাইলেই মেয়েদের গোসলের দৃশ্য দেখতে পারতেন।
সাধারণত ১ জোড়া প্লাস্টিকের জুতা যেটা বাইরে ৮০ টাকায় বিক্রি হয় সেটা জেলখানায় দেড়’শ থেকে ২শ’ টাকায় বিক্রি হয়। কারারক্ষীরা ২৪ ঘণ্টা ধান্ধায় থাকেন কার কাছে কি বিক্রি করা যায়। বলা হয়ে থাকে জেলখানায় নারী-পুরুষ উভয় কয়েদিদের নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে জেলখানায় তার উল্টোটা ঘটে। জেলখানায় থাকা বেশির ভাগ নারী মাদক মামলার আসামি। কেউ নিশিকন্যা। কেউ ছিঁচকে চোর। তাদের অনেকেই জেলখানাকে ফান করার জায়গা হিসেবে দেখে থাকেন। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনা বোধ বা অনুতাপ কাজ করে না। তারা যে অপরাধ করে কারাগারে এসেছে এটা তাদের মাথাতেই থাকে না। অনেক নারী আছেন যারা কিনা মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার জন্য জামিন পাচ্ছেন না। অনেকের পরিবারও জেলখানায় তাদের মেয়েদের কোনো খোঁজখবর রাখে না।
চেক জালিয়াতি মামলায় জেল থেকে বেরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এই নারী। নিজস্ব উদ্যোগে তেজগাঁওয়ে একটি ফাউন্ডেশন খুলেছেন। যেটার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তিনি। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে হস্তশিল্পসহ নানা কাজ শেখানো হয়। তাদেরকে আর্থিক সহায়তা থেকে শুরু করে তাদের তৈরিকৃত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করেন। জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানো এই নারীর ইচ্ছা জেলখানায় যে সকল নারী মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার জন্য জামিন পাচ্ছে না, মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের নিজ উদ্যোগে মুক্ত করে তার ফাউন্ডেশনে কাজের ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তুলবেন।

No comments

Powered by Blogger.