কারা অভ্যন্তরে দিন কাটে যেভাবে by কাফি কামাল

বন্দি আধিক্যের কারণে অমানবিক এক পরিবেশ বিরাজ করছে দেশের প্রতিটি কারাগারে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে লকআপ অবস্থায় দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে বন্দিদের। সকালের নাস্তার পর কিছুক্ষণের জন্য কারাঅভ্যন্তরের আঙ্গিনায় যাওয়া যায় পর্যায়ক্রমে। ঘণ্টা দুই মুক্ত হাঁটাচলার সুযোগ মেলে পড়ন্ত বিকালে। রাতের খাবার সংগ্রহ করে সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হয় ওয়ার্ডের লকআপে।
৫টার পর সব ওয়ার্ড বন্ধ করে দেয়া হয়। দিনে তিনবার বসতে হয় গুনতি ফাইলে। সন্ধ্যাকালীন ফাইল গুনতির পর দ্রুত খাবার-দাবার সেরে রাত সাড়ে আটটার মধ্যেই বাধ্যতামূলক শুয়ে পড়তে হয় বিছানায়। অন্যথায় হজম করতে হয় কটুকথা বা মারপিট।
এককাত হয়ে ঘুমোতে হয় ইলিশ ফাইলে। বন্দিদের ঝগড়া-বিবাদ, বাল্বের তীব্র আলো আর মশার উৎপাতে ঘুম ভেঙে যায় বারবার। বাথরুমে যাতায়াতের পথে একের পা পড়ে অন্যের শরীরে। কারাগারের দিনগুলো হয় নিয়ন্ত্রিত, রাতগুলো দীর্ঘ। নিম্নমানের খাবার, অপরিচ্ছন্ন বাথরুম, চিকিৎসা ও বিনোদনের অভাব, নতুনদের ওপর পুরনোদের এবং হাজতি-কয়েদিদের সঙ্গে কারারক্ষীদের দুর্ব্যবহার মিলিয়ে অমানবিক এক জগৎ প্রতিটি কারাগার। রাজনৈতিক ও অন্যান্য মামলায় নানা মেয়াদে কারাভোগের পর সম্প্রতি জামিনে মুক্ত বেশ কয়েকজন পুরুষ ও নারী কারাগার সম্পর্কে এমন তথ্য জানিয়েছেন।
ব্যবসা সংক্রান্ত মামলায় কিছুদিন কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পাওয়া এক ব্যবসায়ী জানান, কারাগারের আমদানি ওয়ার্ডেই প্রথম রাত কাটে বন্দিদের। ফলে সব সময় এই ওয়ার্ডে বিরাজ করে অন্যরকম এক অমানবিক পরিবেশ। আমদানি ওয়ার্ডের নেয়ার পর রাতেই সওদা বসে সেখানে। যারা আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান তাদের ভালো থাকা ও ভালো খাওয়ার টোপ দিয়ে মক্কেল ওয়ার্ডে (কারাবন্দিদের ভাষায়) নেয়া হয়। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা যান মেডিকেল বা নির্দিষ্ট সেলে। মক্কেল ওয়ার্ডে সিটের জন্য (সোজা হয়ে শোয়ার জায়গা) প্রথম সপ্তাহে পাঁচ হাজার ও পরে প্রতি সপ্তাহে আড়াই হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে মেডিকেল প্রথম সপ্তাহে ১৫ হাজার ও পরে আলোচনা সাপেক্ষে অর্থ পরিশোধ করতে হয়।
আর যারা সাধারণভাবে কারাকর্তৃপক্ষের মর্জি অনুযায়ী যেকোনো ওয়ার্ডে যায় তাদেরও প্রথমবার সিটের জন্য এক হাজার ও ওয়ার্ড পাস হিসেবে ৫০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। ওই ব্যবসায়ী জানান, কারাকর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সাজাপ্রাপ্ত ও প্রভাবশালী পুরোনো কয়েদি বা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা ওয়ার্ডগুলোর আনুষ্ঠানিক ইজারা নেন। তারপর নির্দিষ্ট সময় ধরে তারা সাধারণ হাজতিদের কাছে এ অর্থ আদায় করেন। যারা নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করতে পারেন না তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়। বাথরুমের আশেপাশে শুতে বাধ্য করার পাশাপাশি তাদের দিয়ে করানো হয় বাথরুম পরিষ্কারসহ নানা ধরনের কায়িক কাজকর্ম।
দেশের নানা কারাগার থেকে মুক্ত কয়েকজন জানান, কারাগারে নারী ও পুরুষ বন্দিদের আলাদা কমপ্লেক্সে রাখা হলেও তাদের ব্যবস্থাপনা ও নিয়মকানুন একইরকম। কারাবন্দিদের প্রতিটি দিন শুরু হয় ভোরবেলা ঘুম ভাঙা চোখে গণনার জন্য ফাইলে বসার মাধ্যমে। কয়েকজন নারী জানান, কারাগারের আমদানি ওয়ার্ডেই কাটে যেকোনো বন্দির প্রথম রাত। সকালে গুনতি শেষে তাদের মামলার তথ্য, রক্ত পরীক্ষা, পিরিয়ডের তারিখসহ নানা শারীরিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তারপর নতুন বন্দিদের নানা ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে যারা সামাজিক ও আর্থিকভাবে প্রভাবশালী প্রথমদিনই তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় পছন্দমতো ওয়ার্ডে বা সেলে। কারাবন্দিদের প্রতিটি দিন শুরু হয় ভোরবেলা ঘুম ভাঙা চোখে গণনার জন্য ফাইলে বসার মাধ্যমে। সবক’টি ওয়ার্ডে গণনা সম্পন্ন হওয়ার পর এক ওয়ার্ড থেকে একবারে ৭-৮ জনের মতো করে পর্যায়ক্রমে আঙ্গিনায় যেতে পারে।
তখন কেউ কেউ মনিং ওয়ার্ক করেন। এরই মধ্যে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আসে সকালের নাস্তা লাল আটার রুটি ও গুড় বা সপ্তাহে একদিন খিচুড়ি। তারপর প্রতিদিনের কর্ম, কারা আঙ্গিনাজুড়ে বন্দিদের হাঁটাচলা, গালগল্প বা সশ্রম দণ্ডপ্রাপ্তদের কাজকর্ম চলে। বেশ আগেভাগেই সংগ্রহ করতে হয় দুপুরের খাবার। বেলা ১২টায় দিনের দ্বিতীয় দফা গুনতি চলে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। এভাবে প্রতিদিন ভোরে, দুপুর ১২টায় এবং সন্ধ্যার পর তিন দফা ফাইলে গুনতি হয় কারাবন্দিদের। সপ্তাহে একবার হয় সুপার ফাইল। শীতকালে লকআপ হয় বিকাল সাড়ে চারটায়। সন্ধ্যা ফাইলের পর আটকে দেয়া হয় ওয়ার্ডের দরোজা। রাত সাড়ে আটটার মধ্যে শুয়ে পড়তে হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডেই বন্দিদের ঘুমাতে হয় তিনটি সারি করে। দুই দেয়ালের দিকে মাথা রেখে দুই সারি এবং মধ্যখানে আরেক সারি। ওয়ার্ডে প্রতিজন বন্দি পান দুইটি কম্বল। সাম্প্রতিক সময়ে কারাবন্দিদের ব্যবহারের জন্য সরবরাহ হচ্ছে একটি করে বালিশ। বন্দিদের গোসলের জন্য রয়েছে দুইটি পানির হাউস। একটি কয়েদিদের, অন্যটি হাজতিদের। পানির অপর্যাপ্ততা নিয়ে ভোগান্তির মধ্যে থাকেন কারাবন্দিরা। দিনে তিন বেলা পানি মেলে। একই পানিতে খাবার, গোসলসহ সবকিছুই সারতে হয়। পানির অপর্যাপ্ততা নিয়ে ভোগান্তির মধ্যে থাকেন কারাবন্দিরা।
রাজনৈতিক মামলায় ৬ মাসের বেশি সময় কারাভোগের পর কয়েকদিন আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন এক নেতা। তিনি জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক একটি ওয়ার্ডে সাধারণত ২০-২৫ জন বন্দি রাখার কথা। বর্তমানে একেকটি ওয়ার্ডে ৬০-৭০ জন বন্দি কারাভোগ করছেন। বিশেষ করে ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে এক অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কারগারে। প্রতিটি ওয়ার্ডে বন্দির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১০০’র বেশি। প্রতিটি ওয়ার্ডের বারান্দাগুলোতে পা ফেলার জায়গা ছিল না। নির্বাচনের ৪-৫ দিন আগে থেকে বন্দি আধিক্যের কারণে রাতে কারা আঙ্গিনায় তাঁবু টাঙানো হয়েছিল। রাতে তাঁবু টাঙানো হতো, দিনে সেসব সরিয়ে নেয়া হতো। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যেখানে সাধারণ ৬ হাজার বন্দি রাখার কথা। কিন্তু নির্বাচনের আগে গণগ্রেপ্তারের কারণে সেখানে প্রায় ১৫ হাজার বন্দি রাখা হয়েছিল।
কাশিমপুর-২ এ নারী বন্দিদের জন্য রয়েছে একটি আলাদা কমপ্লেক্স। সেখানে বর্তমানে বন্দি রয়েছেন প্রায় সাড়ে নয়শ’ নারী। যার মধ্যে মায়ের সঙ্গে ৩৫ জন শিশুবন্দি হিসেবে রয়েছে। যদিও শিশু সন্তানসহ মায়েদের রাখা হয় আলাদা একটি ওয়ার্ডে। প্রতিটি ওয়ার্ডেই বন্দিদের ঘুমোতে হয় তিনটি সারি করে। দুই দেয়ালের দিকে মাথা রেখে দুই সারি এবং মধ্যখানে আরেক সারি। ওয়ার্ডে প্রতিজন বন্দি পান দুইটি কম্বল। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বা কারাঅভ্যন্তরে শাস্তিপ্রাপ্ত সেলের বাসিন্দাদের জীবন আরো কঠিন। দিনে মাত্র এক ঘণ্টা সেলের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ মেলে তাদের। মুক্তি পাওয়া নারীরা জানান, তিনটি জিনিসের ব্যাপক চল রয়েছে কারাগারে। সেগুলো হচ্ছে- ‘ডাইল, ফাইল ও গাইল’। প্রতি বেলায় খাবারে মেলে ডাইল (ডাল)। প্রতিদিন তিনবার এবং সপ্তাহে বিশেষ একবারসহ চারবার বন্দিদের নিজেদের সাজাতে হয় ফাইলে। আর গাইল (গাল) প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তের বিষয়। কে কেমন জোরালোভাবে গাল দিতে পারে তার ওপর নির্ভর করে ওয়ার্ডে তার প্রভাব। প্রাত্যহিক কাজগুলো সশ্রম দণ্ডপ্রাপ্তদের করার কথা থাকলেও হাজতিদের দিয়েই সেগুলো করানো হয়। বিশেষ করে বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ইচ্ছা করেই এমন দুর্ব্যবহার করা হয় যাতে তাদের আত্মসম্মানবোধে লাগে এবং আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে। দুইজন নারী জানিয়েছেন, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই তারা মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন। 
বন্দিজীবন কাটানো কয়েকজন পুরুষ জানান, সব কারাগারেই চিকিৎসা সমস্যা নিয়ে দিন কাটে বন্দিদের। প্রতিটি কারাগারে মেডিকেল ওয়ার্ড থাকলেও সেগুলো দখলে থাকে প্রভাবশালী বন্দিদের। কিছু কিছু অসুস্থ এবং কারাবন্দি পাগলদের বসবাসও হয় সেখানে। কারাগারে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সহজে চিকিৎসকের দেখা মেলে না।
প্রাথমিকভাবে মেডিকেল ওয়ার্ডে চিকিৎসার কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে তেমন কয়েদিরাই হন প্রাথমিক ভরসা। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে দেখা মেলে চিকিৎসকদের। রাতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যথাসময়ে চিকিৎসক ও চিকিৎসা না মেলায় হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ কারাবন্দিদের জীবন সংকটাপন্ন হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে কারাঅভ্যন্তরে মৃত্যুবরণের পর আনুষ্ঠানিকতা সারতে হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রতিবেদনে লেখা হয় হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু। অন্যদিকে একজন নারী জানান, দীর্ঘদিন ধরে কোনো চিকিৎসক নেই কাশিমপুর কারাগারের নারী কমপ্লেক্সে। কারাগারের মহিলা চিকিৎসক বদলি হয়েছেন দীর্ঘদিন হলো। কাশিমপুর কারাগারে কোনো নারী বন্দি অসুস্থ হলে চিকিৎসা দেয়ার কেউ নেই। মেডিকেল বন্দি দুয়েকজন নারী কয়েদিই তাদের ভরসা। মাঝে মধ্যে বাইরে থেকে নিয়ে আসা হয় হাতুড়ে ডাক্তার। বিশেষ করে রাতে কোনো বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসা প্রায় হয় না বলেই চলে।
রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তেত্রিশ দিন কাশিমপুর কারাগারে কাটিয়ে কয়েকদিন আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন একজন নারী নেত্রী। তিনি জানান, কারাগারের খাবারের মান নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই বন্দিদের। দিনে তিন বেলা খাবারই মেলে। সকালে রুটি-গুড় কিংবা খিচুড়ি। অন্য দুই বেলায় তরকারি হিসেবে ডাল-সবজি এবং সপ্তাহে দুইদিন তেলাপিয়া বা পাঙ্গাশ মাছ ও মাংস। যদিও ঝোল-ঝালের মধ্যে মাছ-মাংসের টুকরো খুঁজে পাওয়া কঠিন। সীমিত ও বৈচিত্র্যহীন খাবার খেয়েই দিনযাপন করতে হয় বন্দিদের।
এর বাইরে কেউ বাড়তি বা উন্নত খাবার সংগ্রহ করতে চাইলে রয়েছে পিসি (পুলিশ ক্যান্টিন)। বন্দিদের নামে সেখানে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে বাইরে থেকে আত্মীয়-স্বজন টাকার জোগান দিলে বন্দি নিজের চাহিদা অনুযায়ী কারাঅভ্যন্তরে নিষিদ্ধ জিনিসগুলো সবই সংগ্রহ করতে পারে। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান বন্দিরা কারাগারে যাওয়ার পর প্রথমদিনই নিজের নামে খুলে নেন। পিসি থেকে সংগৃহীত প্রতিটি খাবার বা জিনিসের কয়েকগুণ মূল্য পরিশোধ করতে হয়। জামিনে মুক্ত বন্দিরা জানান, কারাগার ভেদে এ মূল্য সামান্য কমবেশি হয়। তবে পিসি থেকে একটি মুরগি রান্না করে নিলে পরিশোধ করতে হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এক কেজি গরুর মাংসের জন্য চার থেকে পাঁচ হাজার ও এক কেজি মাছের জন্য দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়।
তিনি জানান, কাশিমপুর কারাগার-২ এর নারী কমপ্লেক্সটি চারদিকে ফুলের বাগানসহ গাছপালায় সাজানো গোছানো খুবই দৃষ্টিনন্দন। প্রতি সপ্তাহে একদিন জেলসুপারের পরিদর্শনের দিনে সকালে পরিচ্ছন্নতা অভিযান হওয়ায় ওয়ার্ডের পরিবেশও পরিচ্ছন্ন। সপ্তাহের যেদিন সুপার ফাইল হয় সেদিন সকাল থেকেই নানামুখী তৎপরতা শুরু হয় কারগারে। ওয়ার্ডের সবকিছু পরিষ্কার, ধোয়া মোছার মাধ্যমে ঝকঝকে ও সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা হয়। চারতলাবিশিষ্ট কলমিলতা নামের মূল ভবনটির দোতলা থেকে চারতলা প্রতিটি ফ্লোরেই দুইটি করে ৬টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতেই রয়েছে দুইটি করে কক্ষ এবং বারান্দা। কক্ষে একটি করে অ্যাটাচড বাথরুম। প্রতিটি কক্ষে বসবাস করতে হয় ৬০-৭০ জন। কখনো কখনো এ সংখ্যা একশ’ পেরিয়ে যায়। প্রতিটি ওয়ার্ডের সামনে থাকা একচিলতে বারান্দায়ও রাত কাটাতে হয় শত শত বন্দিকে। গরমের দিনে বারান্দায় ঘুমানো সহজ হলেও শীতের দিন সেটা হয় বাড়তি সাজা। যদিও কারাগারে সরবরাহকৃত কম্বল দিয়ে জানালার গ্রিল আটকে দেয়া হয় কিন্তু তাতে আটকে রাখা যায় না শীতল হাওয়া। তারপরও কম্বলে গুটিসুটি মেরে রাত কাটানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।
একজন করে মেড ও রাইটার (সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দি) প্রতিটি কক্ষের নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি বলেন, কমপ্লেক্সের মূল ভবন ছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি বাংলো। সবচেয়ে বড় বাংলোটি হচ্ছে ভিআইপি ও ভিভিআইপি বন্দিদের। এর বাইরে অন্য বাংলোগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে পিসি, মেডিকেল, টেইলার্স, পার্লার ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে কারাসেল। সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কারামুক্ত কয়েকজন জানান, কারাগারে বড় বড় অপরাধীর জন্য রয়েছে সেল। সামর্থ্যবান বন্দিরা একটি প্রাইভেসি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে থাকার জন্য অর্থের বিনিময়ে সেসব সেলে যান। আবার সাধারণ ওয়ার্ড থেকে নানা অপরাধের জন্য কাউকে কাউকে পাঠানো হয় এসব সেলে। এছাড়া ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরাও থাকেন সেলে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি সেলে কয়েক মাস বন্দি জীবন কাটানো একজন জানান, একটি সেলে এক বা দুইজন থাকার কথা। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে সেলগুলোতে বন্দি রাখা হয়েছিল ৬-৭ জন করে।
রাজনৈতিক মামলায় কয়েক মাস কারাভোগের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত একজন জানান, কারাগারে সবচেয়ে বড় একটি সংকট বিনোদনের অভাব। কারাবন্দিরাও যে মানুষ, তাদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য যে বিনোদনের প্রয়োজন সেটা কর্তৃপক্ষ ভাবেন না। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে টেলিভিশন সেট থাকলেও সেখানে প্রচারিত হয় কেবল বিটিভির অনুষ্ঠান। তাও রাত ৮টা পর্যন্ত। পত্রিকা পাওয়া যায় দুইটি। ফলে বন্দিদের সময় কাটে না। বন্দিদের মধ্যে যারা বিত্তশালী তারা কারাকর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে টিভি সেট নেন। দুয়েকজন ঝুঁকি নিয়ে পেন ড্রাইভের মাধ্যমে নাটক-সিনেমা দেখেন। কিন্তু ধরা পড়লে তাদের আর্থিক জরিমানা (অনানুষ্ঠানিক) ও কারাঅভ্যন্তরে শাস্তি দেয়া হয়। সে শাস্তির মধ্যে রয়েছে অন্য কারাগারে চালান, সেলে স্থানান্তর, হাতকড়া পরানো, মারধরসহ নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
অন্যদিকে রাজনৈতিক মামলায় দুই মাস কারাভোগ করে কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন একজন ছাত্রনেত্রী। তিনি জানান, কারাবন্দিদের বেশির ভাগই টিনেজ ও কমবয়সী। যাদের বেশির ভাগই কারাভোগ করছেন মাদক মামলায়। অনেকেই কারাভোগ করছেন রাজনৈতিক মামলা, খুন, চেক জালিয়াতি, অবৈধ দেহ ব্যবসার অভিযোগে। স্বামী ও কাজের মেয়ে হত্যার অভিযোগে বন্দি রয়েছেন কয়েকজন অভিজাত ঘরের সুন্দরী নারী। তিনি জানান, কারাগারের বন্দিরা নিরাপদ থাকলেও কাউন্সেলিং না থাকায় অপরাধীদের মনে অনুশোচনা নয়, রাগ-ক্ষোভ-হতাশা বাড়ে। কারাগারে যাওয়ার পর অনেক অপরাধী আছে যাদের অন্যান্য অপরাধীদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এবং তাদের অপরাধের জগৎ সম্প্রসারিত হয়।
বিশেষ করে যারা মাদক ও দেহ ব্যবসার অভিযোগে কারাগারে যান তারা জামিনে বের হয়ে ফের পুরনো পেশায় জড়িয়ে পড়েন। ফের গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ফেরত আসেন। ওই ছাত্রনেত্রী জানান, কারাগারে বিনোদনের তেমন ব্যবস্থা নেই। একটিমাত্র টিভি সেট আর একটি লাইব্রেরি। সাজাপ্রাপ্ত পুরনো বন্দি ছাড়া নতুনদের সেখান থেকে বইপত্র সরবরাহ করা হয় না। হ্যান্ডবল-ভলিবলের মতো খেলাধুলা ও শরীর চর্চার কোনো সুযোগ নেই। কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি ডে কেয়ার সেন্টার। তবে তা প্রায়ই বন্ধ থাকে।
কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত একজন জানান, কারাগার এমন একটি জায়গা যেখানে একই সঙ্গে ইবাদত বন্দেগি ও নানারকম অনিয়ম হয়। বন্দিদের একাংশ নিয়মিত নামাজ রোজা করেন। আরেকাংশ সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তাস পেটানো, গালগল্প আর হৈ চৈ ঝগড়া-বিবাদ করে। একজন নারী জানান, কারাবন্দিদের অনেকে এবাদত বন্দেগি বা ছোটখাটো কুটির শিল্পের কাজ করলেও বেশির ভাগের সময় কাটে গালগল্প আর ঝগড়া-বিবাদে। এছাড়া কারাগারে দীর্ঘ নিঃসঙ্গতার কারণে বন্দিদের অনেকেই সমলিঙ্গের প্রতি অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কারাগারে মাঝে মধ্যেই দেখা মেলে তেমন জুটির। ধরা পড়লেই বিচারের মাধ্যমে তাদের সেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.