সরজমিন কুর্মিটোলা হাসপাতাল: কোনো অভিযোগ নেই by জিয়া চৌধুরী

ঝকঝকে, তকতকে মেঝে, ওয়ার্ড ও কেবিন। কোথাও কোনো দুর্গন্ধ নেই। পরিচ্ছন্ন পুরো হাসপাতাল। সামনের চত্বরে ফুল বাগান আর দৃষ্টিনন্দন শোভাবর্ধনকারী গাছের সারি। আছে বিশাল এক পুকুরও। বনানী থেকে রেডিসন হোটেল হয়ে উত্তরার দিকে যাওয়ার পথে বাঁ দিকেই দেখা মিলবে এমন এক হাসপাতালের। এটি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয়ে পরিচালিত এ হাসপাতালটি একেবারেই ভিন্ন অন্যসব সরকারি হাসপাতালের চেয়ে।
এখানে কোনো দালালের দৌরাত্ম্য নেই।
মাত্র দশ টাকায় নেয়া যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ, ১৫ টাকায় ভর্তি হওয়া যায় হাসপাতালে। সরজমিন ঘুরে রোগীদের থেকে তেমন কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। নানা সেবা আর চিকিৎসায় সন্তুষ্ট দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষজন। গতকাল সরজমিন ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে এ হাসপাতালে। বেলা বারোটার দিকে মেডিসিন   বহির্বিভাগে রোগীদের ভিড় ছিল বেশ। বাড্ডা থেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। হাতে দশ টাকার একটি টিকিট। ডাক্তার দেখানো শেষে কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, অন্য সব হাসপাতালের তুলনায় আউটডোরে সেবা ভালো। তবে, প্যাথলজি বিভাগের সেবা আরো উন্নত করা দরকার। বহির্বিভাগের আরেক রোগী আল-আমিন জানান, মিরপুর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে এসেছেন। অন্যসব হাসপাতাল থেকে এখানকার চিকিৎসকদের আন্তরিক মনে হয়েছে তার কাছে। হাসপাতাল চত্বরে কথা হয় গাইবান্ধার মোহাম্মদ মোজাফফর ভাণ্ডারীর সঙ্গে। থাকেন ঢাকার উত্তরায়। মাত্র সাত মাস বয়সের ফুটফুটে মেয়ে রাফিয়াকে নিয়ে হাসি মুখে হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছেন বাড়ির উদ্দেশে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় প্রতিবেশীদের থেকে তথ্য নিয়ে সাত দিন আগে মেয়েকে নিয়ে আসেন কুর্মিটোলার এ হাসপাতালে। চিকিৎসকদের পরামর্শে ভর্তি করান রাফিয়াকে।
এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে কোনো কষ্ট হয়নি বলে জানান। মেয়ে সুস্থ হওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন চিকিৎসকদের প্রতি। সোমবার দুপুরে হাসপাতালের বার তলা ভবনের সামনে রোদ পোহাচ্ছিলেন নোয়াখালীর হেলাল। পায়ের আঙ্গুলে টিউমার হওয়ায় অপারেশন করতে ১২ দিন আগে ভর্তি হন কুর্মিটোলা হাসপাতালে। অপারেশন হয়েছে ছয় দিন হলো। হাসপাতালের পরিবেশ, চিকিৎসকদের তদারকিতে বেশ সন্তুষ্ট হেলাল। জানান, পায়ের প্লাস্টার খুলতে আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। এরপর বাড়ি ফিরে যাবেন তিনি। হাসপাতালের এমন সুন্দর পরিবেশ এর আগে দেখেননি হেলাল। বলেন, সব সময় হাসপাতালে দেখেছি উৎকট গন্ধ। দম ফেলার উপায় থাকে না সরকারি হাসপাতালগুলোতে। এখানে ঠিক তার উল্টো। হাসপাতালের আশপাশের পরিবেশেও মুগ্ধ তিনি। দিনের বেলা মাঝে মধ্যেই ক্র্যাচে ভর করে হাসপাতালের সামনের চত্বরে যান হেলাল। রোগী হিসেবে কাটানো ১২ দিন সময়ে দালালের উৎপাত দেখেন নি। সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এজন্য কাউকে কোনো টাকাও দিতে হয়নি। হেলালের পাশেই বসেছিল কিশোর রাকিব হোসেন। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের কিশোর রাকিব ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেন। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল হয়ে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন কুর্মিটোলায়। আগের দুই হাসপাতালের সঙ্গে কুর্মিটোলার রাতদিন তফাৎ বলে মানবজমিনকে জানান রাকিব। বলেন, ‘মনডা চাইতেছে আরো কয়ডা দিন থাইকা যাই।’ স্ত্রী মোসাম্মৎ আকলিমা আক্তারকে নিয়ে টঙ্গী থেকে হাসপাতালে এসেছেন স্বামী আব্দুল মান্নান। স্ত্রীর দেখভাল শেষে হাসপাতালের সামনের পুকুর পাড়ে ছেলের সঙ্গে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, এত সুন্দর পরিবেশ, তাই পোলার লগে একটা ছবি তুলে রাখলাম। এমন সময় একটি গাড়ি এসে থামে হাসপাতালের সামনে। মুখে ও পায়ে আঘাত পাওয়া ষাটোর্ধ্ব শুকুরি বেগমকে নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দিকে ছুটছেন তার ছেলে আহমদ আলী। জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। আহমদ আলী জানান, কালাচাঁদপুর এলাকায় প্রতিবেশীদের হামলায় আহত হয়ে নিজে ও মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। এত হাসপাতাল থাকতে কুর্মিটোলায় কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতালটির সুনাম আছে। আর এখানে জরুরি বিভাগে এসেও ভালো ব্যবহার পেয়েছি।
কেবিন বরাদ্দ বিভাগে কথা হয় একজন রোগীর সঙ্গে। হাসপাতালে মশার উপদ্রব আছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। সে অনুপাতে মশারির সংখ্যা কিছুটা কম বলেও জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই রোগী। কিডনি চিকিৎসা নিতে আসা আনিসুর রহমান বলেন, বাস মাঝে মধ্যে থামাতে চায় না, শেওড়া পর্যন্ত চলে যায়। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আহমেদ সামি আল হাসান জানান, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই তিন মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে তিনশ’ রোগী সার্জারি সংক্রান্ত রোগে বহির্বিভাগে আসেন। তবে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে রোগীর সংখ্যা বেড়ে সাড়ে পাঁচশ’র মতো হয়। সব বিভাগ মিলিয়ে গড়ে প্রতিদিন ১২০০-১৫০০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে ভিড় করেন। তবে কোনো কোনো দিন সর্বোচ্চ সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার রোগীও দেখতে হয় চিকিৎসকদের। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের রোগীর সংখ্যাও ছাড়িয়ে যায় তখন।
এত বিশাল সংখ্যক রোগী দেখতে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়। আর ইনডোরে গড়ে প্রায় ৫০০ জন রোগীও ভর্তি থাকে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। তবে, শুরুর দিকে এমন পরিস্থিতি ছিল না কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। ২০১২ সালের ১৩ই মে উদ্বোধনের পর আংশিকভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয় এখানে। পুরোদমে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হওয়া পর্যন্ত রোগীদের তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যেত না। সুউচ্চ ভবন আর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকা হওয়ায় অনেকেই ভাবতেন হাসপাতালটি সাধারণের জন্য নয়। আশানুরূপ হারে রোগী না পাওয়ায় সে সময় ‘সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত’ লেখা সাইনবোর্ড টানায় কর্তৃপক্ষ। সেবা আর হাসপাতালের কর্মীদের আন্তরিকতার খবর পৌঁছে যায় ঢাকার নাগরিকদের কাছে। মিরপুর, বাড্ডা, উত্তরা, টঙ্গী এলাকার মানুষের এখন ভরসা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেও অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন এখানে।
১২ তলা ভবনে ৫০০ শয্যার হাসপাতালটিতে মেডিসিন, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি এবং সার্জারি পূর্ণাঙ্গ বিভাগের সঙ্গে আছে শিশুরোগ, চক্ষু, প্যাথলজি, হৃদরোগ, অর্থোপেডিক্স, অনকোলজি, রেডিওলজি, নাক-কান-গলা, চর্ম ও যৌন, রক্ত পরিসঞ্চালন, দন্তরোগ ও ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ। আরো আছে বিশেষ ফিজিওথেরাপি বিভাগ, ব্রেস্ট ক্লিনিক, ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক, কেমোথেরাপি ডে কেয়ার সেন্টার, যক্ষ্মা শনাক্তকরণ সেন্টার, ইউনানী, আয়ুবের্দিক ও হোমিওপ্যাথি বিভাগ। বহির্বিভাগে সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত সেবা নিতে পারেন রোগীরা। আউটডোরে শতকরা ৯০ ভাগ ও ইনডোরের রোগীদের ৭০ ভাগ ওষুধ হাসপাতাল ফার্মেসি থেকেই দেয়া হয়। আর এতসব কিছু সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশীদ-উন নবী। গতকাল সেবার মান আরো বাড়াতে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করায় সরাসরি সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।
পরে  টেলিফোনে তিনি মানবজমিনকে বলেন, সব কৃতিত্বের দাবিদার হাসপাতালের রোগীবান্ধব চিকিৎসকরা। আউটডোরে সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত একটানা রোগী দেখেন তারা। ইনডোরেও চিকিৎসকদের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। সারা দিন বিভাগ থেকে ওয়ার্র্ডে ঘুরে ঘুরে রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন হাসপাতালের পরিচালক। চিকিৎসা ও সেবার বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন নিয়মিত। কারো কোনো অভিযোগ থাকলে আলাদা করে বসেন সেই রোগীর সঙ্গে। তিনি জানান, এমনও হয়েছে কোনো রোগী একটি বিষয়ে অস্পষ্ট অভিযোগ দিয়েছেন। তারপরও আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কয়েক দফা মেইলে যোগাযোগ করেছি। যে কোনো অভিযোগকেই আমরা গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখি। প্রমাণ পেলে সঙ্গে সঙ্গে সমাধান করার চেষ্টা করি।

No comments

Powered by Blogger.